আমি কাক নই, আমি মানুষ...
সামনের দরজাটা হুট করে খুলে গেল। একটু ঠাণ্ডা হাওয়া এসে পর্দাটা নাড়িয়ে দেয়। ঠিক পর্দা না, একটা পুরোনো কাপড় দিয়ে পর্দার কাজ চালানো। ও দিকটায় চোখ ফেরালেন তিনি। নাহ্! কেউ নেই।
এই ঘরটায় তেমন কেউ আসে না।
এ ঘরটাতে আসার তেমন কোনো কারণ নেই। এখানে দেখার মতো কিছু নেই। পাওয়ার মতোও কিছু নেই। কোনকালে ছিলও না।
ঘরটা ছনের। গেল বর্ষায় উত্তর পাশের ছন পচে গেছে। তারপর আর ঠিক করা হয়নি। বৃষ্টি এলেই পানি পড়ে। গতকাল রাতেও পানি পড়েছে।
কিন্তু ঘরটা ঠিক করাহয় না। করবেই বা কে? ঠিক করারও তো কেই নেই।
ঘরটাতে বাস করে ৮১ বছরের বৃদ্ধা হাউসী বেগম। গত ১৩ বছর হলো খড়ের বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। ইদানীং তার ঘুম আসে না।
গভীর রাতে তন্দ্রার মধ্যে চোখ বুজে থাকেনÑ এই যা। কোন নতুনত্ব নেই তার জীবনে।
হাউসী বেগমের ছোট ছেলে মফজল এক মাস আগে তার ঘরে এসেছিল। নাক চেপে এদিক-ওদিক তাকায়। তারপর চলে যায়।
সে থাকে দুই গ্রাম পর শ্বশুরবাড়িতে। তার শ্বশুর হারু মণ্ডল। দু’টি রাইস মিল আছে। মফজল রাইস মিলে ধান ভাঙায়। বেশ সুখেই আছে সে।
হাউসী বেগমের বড় ছেলে কালাজ্বরে মারা গেছে ২৩ বছর আগে। মরার আগে নাক ফুলে গেল। নিঃশ্বাস নিলে বাঁশির মতো শব্দ হতো। সে কি কষ্ট! কোন পাপে এমন শাস্তি, কে জানে?
গ্রামের সবাই এই বাড়িকে এখন সবাই ভূতের বাড়ি বলে। কেউ কেউ ভয় পায়।
বলে সে নাকি ডাইনি বুড়ি। নইলে অমন নাদুস নুদুস ছেলে ওভাবে মারা যাবে কেন? তাছাড়া ডাইনী বুড়িরা নাকি সহজে মরে না। কথাটা সত্য কিনা তা তিনি জানেন না।
স্বামী নেই, সন্তান নেইÑ নিঃসঙ্গ একটা মানুষ, একা একা থাকে। এই একা একা থাকার সময়ও কম নয়।
তের বছর। এই তের বছর বুড়ি হাঁটাচলা করতে পারত। বাড়ির পাশ থেকে শাক-লতাপাতা তুলে খেত। অবশ্য কি খেত, কি না খেত কেউ দেখতে আসত না। কিন্তু হঠাৎ কয়েকদিন আগে বিছানায় পড়ে গেলেন তিনি।
কেউ তাকে দেখতেও আসেননি।
আসবেই বা কে? কে আছে তার? একটা ছেলে সেও ঘরজামাই। অসুখের খবর শুনে এসে নাক চেপে ধরে থাকে। তার দুই নাতী নাকি দাদীকে দেখতে আসতে চায়। কিন্তু ছেলের বউয়ের ভয়ে আসতে পারে না।
তিনি ভাবেন, আসল ডাইনী কে? তিনি নাকি নিঃসঙ্গ এক মহিলার সাথে সর্ম্পক ছিন্নকারী তার ছেলের বউ। বুঝেন না তিনি।
বর্ষার পানি জমেছে বাড়ির পাশে। ব্যাঙ ডাকে গভীর রাতে। হাউসী বেগম মাথা তুলে তাকায় বাইরে।
আকাশে মেঘের দৌড়। অঝোরে ঝড়বে বৃষ্টি। ঘরটা টিকবে তো? একটা ভয় নাড়া দেয় মনে। অবশ্য না টিকলেই কি? তার যা জীবন, তা ঘরের মধ্যেও যেমন বাইরেও তেমন।
তিনি অপেক্ষা করেন, একদিন তার ছেলে আসবে।
তাকে শেষ বয়সে একটু শান্তি দেবে। হয়তো সেই আগের মতো তাকে মা বলে ডাকবে, বাজার থেকে শোল মাছ কিনে আনবে। তিনি রান্না করবেন। ছেলে পেটপুরে খাবে। তিনি বাড়ির উঠানে বসে দণিা বাতাস খাবেন।
বলবেন, মফজন, আজ হাট থেকে বাতাসা কিনে আনিস। কতদিন বাতাসা খাই না। কিন্তু এসবই এখন স্মৃতি। এখন আর বাড়ির চারপাশ ঘুরে বেড়ানো হবে না। শুধু চোখ বুজে অপেক্ষা।
কিন্তু কার অপেক্ষা? কিসের অপেক্ষা?
ছোটবেলায় বেণী দুলিয়ে এ পাড়া-ওপাড়া দৌড়াতেন তিনি। এর বাড়ির পেয়ারা চুরি, ও বাড়ির কদবেল চুরিÑ এই ছিল তার দুরন্ত শৈশব। হঠাৎ একদিন তার বিয়ে হয়ে গেল। তখন তার বয়স দশ। একটা বড়সড় স্বাস্থ্যবান মানুষ তাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল।
হাউসী ভয় পেয়ে বলল, আফনের চুল পাকছে, তুইলা দেই।
ঠাস করে একটা চড় খায় সে। জানে না স্বামী কাকে বলে? সংসার কাকে বলে? সংসারের কী ধর্ম? সবই এলোমেলো সময়। এলোমেলো ভাবনায় ভয়। অন্ধকারের ভয়।
শরীরে রক্তের দাগ। তবু চিৎকার করা যাবে না।
হাউসী বেগমের স্বামীর নাম ছিল মতলব আলী। আসলেই মতলববাজ ছিলেন তিনি। দালালীর কাজ করত।
মাথা গরম হলে রাত বিরাতে পেটাত তাকে। সে সময় স্বামীর নাম মুখে নেয়া ছিল অন্যায়। অমঙ্গলের পাখি ঘরে ডেকে আনা যাবে না। তাই স্বামী ছিল প্রভু। প্রভুর মতোই মান্য করত হাউসী।
রাত এলেই অজানা ভয়ে কুকরে যেত। প্রতীক্ষা করত কবে সে মুক্তি পাবে।
মুক্তি মেলে পনের বছর পর। যখন মুক্তি মেলে তখন তার ভরা যৌবন। যে অন্ধকারের ভয়ে মুক্তির প্রত্যাশা ছিল তার, সেই অন্ধকার হয়ে যায় তার একান্ত কাম্য।
কিন্তু কে আসবে সে শূন্যতা পূর্ণ করতে? কেউ আসেনি।
যৌবনের কষ্ট নিয়ে অপেক্ষার প্রহর কেটেছে। কবে এ যন্ত্রণা শেষ হবে সেই প্রত্যাশা। শেষও হয়েছে সব। এক অপেক্ষা গেলে আরেক অপেক্ষা আসে।
দুই ছেলের সুদিনের অপেক্ষাও কম ছিল না। কিন্তু বড় ছেলে একদিন মুখে চুনকালি দিল। সোনাডাঙ্গায় গরু চুরি করে ধরা পড়ল। সে কি গলাবাজি সবারÑ ব্যাটাকে লাঠিপেটা কর, গুই সাপের থুথু খাওয়া, আরো কত কথা। সেই থেকে গ্রামের সবাই তাকে ‘চোরের মা’ ডাকে।
কি লজ্জা! মুখ কাটা যায়।
বড় ছেলের জেল হলো তিন বছর। অপেক্ষায় থেকে থেকে কেটে গেল সেই সময়ও। কিন্তু ঘুচল না চোরের মায়ের অপবাদ। বুকে বান মারার মতো কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসত তার।
ছেলেও শুধরাল না। চুরি করা যেন তার শরীরের রক্তে মিশে গেছে। কিন্তু এই রক্ত কি তার রক্ত? যে রক্তে তিনি তাকে দশ মাস পেটে ধরেছিলেন? বিশ্বাস হয় না।
অপবাদটা ঘুচেছিল তার। অবশেষে বড় ছেলের মৃত্যুই এই অপবাদ ঘুচে দেয়।
কিন্তু বদলে যায় সময়। চুরি করে হলেও সে পেটের কষ্ট মিটিয়েছিল। তারপর উপোষে কাটে সকাল-দুপুর। পেটের কষ্ট বড্ড ভয়াবহ। লাজ লজ্জা এক মুহূর্তে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়।
সম্ভবত এ কারণেই নতুন পরিচয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে হাউসী বেগম। একটা ছেঁড়া ঝুলি কাঁধে এ বাড়ি ও বাড়ি। পেটের কষ্ট না থাকলে এভাবে ছুটতে হতো না তার।
ছোট ছেলেটার অকৃতজ্ঞতা আরো বেশি কষ্টসন্ধানী করে তাকে। দুপুরের রোদে বেঁচে থাকার জন্য ছুটে চলা।
এ বাড়ি ও বাড়িতে দুমুঠো চাল। তাই নিয়ে আঁধারে ঘরে ফেরা।
গভীর রাতে শুনশান পুরীর মতো এ ঘরটায় তিনি ভয় পান। সেই ছোট বয়সেও তিনি অন্ধকারের ভয় পেতেন। যদিও একটা মানুষ তাকে জড়িয়ে ধরে রাখত।
কিন্তু কে এই মানুষ? তার সাথে কিসের সম্পর্ক? তখন বুঝতে পারতেন না তিনি। আজ তার কথা খুব মনে পড়ে। তাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। যদিও এখন চোখ বুজলে তার মুখটা সেভাবে ভেসে উঠে না। কেমন যেন মলিন একটা মুখ, যেন হাজার বছরের পুরনো।
এখনো ভয় সেই অন্ধকারের। এখনো সেই আগের মতোই তার মুক্তির প্রতীক্ষা। কিন্তু এক জীবনে তার সঞ্চয় কি? দীর্ঘশ্বাস, অপবাদ, আর কষ্ট ছাড়া আর কি কোনো সঞ্চয় আছে?
একটা মানুষ পৃথিবীতে আসে, তারপর একদিন চলে যায়। কিন্তু মাঝের সময়টা কেবল সঞ্চয়ের। কেউ পরপারের সঞ্চয় করে, আর কেউ করে এ পারের।
কেবল ভাগ্যবানরাই দু’পাড়ের সঞ্চয় কুড়াতে পারে।
জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানুষের ভালোবাসা। আর অবিকৃত সুনাম। অল্প হোক আর বেশিই হোকÑ সবারই এ দুটো জিনিস দরকার। কিন্তু এ দুটোর কোনোটাই সঞ্চয়ে নেই হাউসী বেগমের।
পুরো জীবনটাই তার অর্থহীন হয়ে গেছে। মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকে। যখন স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়, তখন বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়।
বিছানায় পড়ার আগেও তিনি নানান স্বপ্ন দেখতেন। ভাবতেন, বাড়ির পেছনের ডেওয়া গাছে অনেক ডেওয়া ধরেছে।
ওগুলো বিক্রি করে ঘরটা ঠিক করবেন। বেঁচে থাকার একটা অদৃশ্য ইচ্ছা, মানুষের সহজাত স্বভাব। কিংবা এরচেয়েও বেশি কিছু।
একটা ঘর হবে। ছাউনি দেয়া ছিমছাম ঘর।
কাঠের নকশাওয়ালা একটা দরজা। একটা তোষকের বিছানা। তিনি শুয়ে থাকবেনÑ এমনই একটা ঘরের অপেক্ষা তার। কিন্তু এখন তার আর কোনো অপেক্ষা নেই। বরং বিছানায় পড়ে একটা ঘোরের মধ্যে আছেন তিনি।
গভীর রাতে একটা ডাহুক পাখির ডাক ভেসে আসে। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে যান। এক সময় ভয় কেটেও যায়। হঠাৎ মনে হয় তার তো কোনো কিছুই হারানোর নেই। ছেলে-সংসার নেই।
আত্মীয়-স্বজন নেই। কিছুই তো নেই। তবে আর হারাবেন কি? তাহলে ৮১ বছরের দীর্ঘ জীবনে তার কিসের প্রতীক্ষা? সন্তানের ভালোবাসা, মানুষের শ্রদ্ধা, একটা সংসারের বাঁধন, না অন্য কিছু।
আজ সন্ধ্যা থেকেই অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। সন্ধ্যাবাতি নিভে গেছে দমকা হাওয়ায়।
অবশ্য বাতির তেমন দরকার নেই। বাইরের আলো ঘরে পড়ছে। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। আকাশ ফেটে গর্জে উঠছে মেঘ।
বাড়ির চারদিকে থৈ থৈ পানি।
এ বছরও ভাসিয়ে নেবে সব। বৃষ্টি থামছেই না। হাউসী বেগম শুয়ে আছেন খড়ের বিছানায়। বইতার শাক দিয়ে এক থালা ভাত পড়ে আছে তার পাশে। খাওয়ার রুচি নেই।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে।
আজ আর তার কোনো ভয় নেই। কোনো কিছুর অপেক্ষা নেই। অন্ধকারের হোলি খেলা নেই। বেঁচে থাকার প্রত্যাশাও নেই।
তারপরও তিনি অপেক্ষা করছেন। অপার্থিব কোনো একজনের জন্য। তিনি দরজা খুলে রেখেছেন।
হাউসী বেগম জানেন না, তিনি পাপী না পুণ্যবান। অপার্থিব সেই একজন কখন আসবে।
কিরূপে সে আসবে। ভয়ঙ্কররূপে নাকি সুগন্ধী নিয়ে।
তিনি অপেক্ষা করছেন। আকাশে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে ঘর। খোলা দরজা দিয়ে দমকা হাওয়ায় তার শরীর শীতল হয়ে আসছে।
ওই তো দরজার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়ে। এগিয়ে আসছে দরজা দিয়ে। আবছা আলোয় তার মুখ অচেনা। কেন জানি আবছা মানুষটাকে তার ছোট ছেলে মনে হয়। কিন্তু তিনি তো তার ছেলের অপেক্ষা করে নেই।
এ পার্থিব কোনো কিছুই এখন তাকে আর কাছে টানে না।
হাউসী বেগম তাকিয়ে আছেন ছায়ামানবের দিকে। কে সে? তার ছেলে, নাকি অপার্থিব কেউ একজন।
তবে কি তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, নাকি আরো দীর্ঘ হলো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।