ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
৩.
'নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে
আমার লুকায় বেদনা অধরা অশ্রুনীরে
অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে...'
দিনরাত্রি তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে সুর খেলা করে, অথচ গলায় সুর নেই। সবার থাকে না। কিন্তু গান শুনতে বা ভালোবাসতে নিজের গলায় সুর না থাকলে কোনো ঊনিশ-বিশ হয় না। এই অন্ধকারে রবির পাশে রিকশায় বসে যখন বুকের তীব্র ব্যথার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, সেই সময়েও এবারক হোসেনের মাথার ভেতরে তাঁর প্রিয় কবির গান বেজে যায়।
হাজীপাড়া ছাড়িয়ে রিকশা কানচগাড়ির রাস্তায় উঠেছে।
হাতের ডানে একটা ছোটো একতলা বাড়ির দিকে চোখ পড়ে এবারক হোসেনের। কোনো আলো নেই বাড়িতে, ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার অন্ধকার বাড়িটাকে আরো ভুতুড়ে চেহারা দিয়েছে। বাবুদের বাড়ি। সাতমাথায় সপ্তপদী মার্কেটে দোকান আছে বাবুর।
আলাপ-পরিচয় তেমন ছিলো না। এক বিকেলে এই রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন এবারক হোসেন। আকাশ মেঘলা ছিলো, এই বাড়ির সামনে আসতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামে। গা বাঁচাতে বাবুর বাড়ির বাইরের বারান্দায় গিয়ে উঠেছিলেন, বৃষ্টি থামলে চলে যাবেন। একটা খালি রিকশা পেলেও উঠে পড়া যায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন, এইসময় হঠাৎ তাঁর পেছনে দরজা খুলে যায়। তাকিয়ে দেখেন, ছোট্টো একটি বাচ্চা মেয়ে, বছর ছয়-সাতেকের হবে, দরজায় দাঁড়িয়ে। আধা-চেনা কারো বাড়ির বারান্দায় উঠে একটু অস্বস্তি হচ্ছিলোই, এখন দরজা খুলে যেতে অস্বস্তি আরো বেড়ে যায়। মেয়েটি অসংকোচে বেরিয়ে এসে তাঁর হাত ধরে ফেলে, ভেতরে এসে বসো, দাদু। বৃষ্টিতে ভিজে যাবে যে! বাবুরই মেয়ে হবে।
একটু ইতস্তত করছিলেন, মেয়েটি একরকম টানতে টানতে ভেতরে এনে বসিয়েছিলো।
খানিক পরে ওর মা এলে জানা যায়, মেয়েটিকে দাদু ডাকতে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। ও যে দরজা খুলে কাউকে ঘরে নিয়ে বসিয়েছে, ভেতরে কেউ জানেও না। মায়া পড়ে গিয়েছিলো, সেদিনের পরে আরো অনেকবার এসেছেন এ বাড়িতে। বাচ্চা মেয়েটি কী সুন্দর পুটপুট করে কথা বলে! আজ রিকশায় বসে ওদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে এবারক হোসেন মনে মনে বললেন, চলি রে দাদু, আর দেখা হবে না!
রিকশা শেরপুর রোডে উঠে এলে রাস্তায় আলো দেখা যায়।
ছোটো শহরের রাস্তার মলিন আলোয় এবারক হোসেনের কাছে সবকিছু বড়ো অবাস্তব লাগে। এই যে রবি ছেলেটি তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে, এর সঙ্গে কি তাঁর যাওয়ার কথা ছিলো? রবিকে এই সেদিনও চিনতেন না। তরুণ ডাক্তার, স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে বদলি হয়ে এসেছে। ভাড়া বাড়ির খোঁজে এসেছিলো, তখন এবারক হোসেন নিচেরতলার বাড়তি ঘর দুটো ভাড়া দেবেন ঠিক করেছেন। ঘর দুটো প্রয়োজনের তুলনায় ছোটো বলে রবি কাছাকাছি অন্য বাসা নিয়েছিলো।
ক'দিন পরে আবার রবি এসে হাজির। বলেছিলো, বাসা পছন্দ না হলেও দাদু আর দিদাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সেই থেকে তো ঘরের মানুষ হয়ে উঠলো রবি আর তার বউ ছায়া। দু’জনকে তিনি রবিচ্ছায়া বলে ডাকেন। শুধু ঘরের মানুষ হয়ে থাকলো না সে, দাদু-দিদার ডাক্তারিও নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলো।
ব্লাড শ্যুগার দেখা, হার্ট চেক-আপ করানো তাগিদ দিয়ে দিয়ে সে-ই করাতে থাকে। এবারক হোসেন বরাবর চিকিৎসাবিমুখ, কখনো কখনো রবির অবাধ্য হওয়ারও চেষ্টা করেছেন। তখন রবি একেবারে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেললে এবারক হোসেন নিরুপায় হয়ে পড়েছেন।
এই শেষ যাত্রায় এবারক হোসেনের সঙ্গী হয়েছে যে মানুষটি, তার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক কিছু নেই। ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-পরিজন কে কোথায়, কেউ এখনো জানেও না।
ভাগ্যের লিখন? না হলে আর কী, জোহরা বেগম এই সময়ে পাশে নেই। সারা জীবনভর যখন যেখানে গেছেন, একসঙ্গেই। বেড়ানো, দেশ দেখার নেশা তাঁর চিরদিনের, রিটায়ার করার পর সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, নেপাল ভুটান বেড়াতে গেছেন দু’জনে। দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর-কলকাতা-দার্জিলিং মিলিয়ে ইন্ডিয়াতে অনেকবার। আগ্রায় তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ভেবেছিলেন, শত শত বছর পরেও মানুষেরই কীর্তি কী গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে! সোভিয়েত ইউনিয়নে গেছেন ছোটো ছেলের কাছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনও অখণ্ড।
লেনিনগ্রাডে গিয়ে মনে হয়েছিলো, এই দেশের মানুষগুলো পৃথিবীতেই স্বর্গ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলো। আমেরিকায়ও দু'বার যাওয়া হয়েছে বড়ো ছেলের কাছে। নায়াগ্রা ঘুরে এসে ছেলের বউকে বলেছিলেন, জানো মা, পূর্ণিমার রাতে জলপ্রপাতের ওই অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য দেখে আমার মনটা ভরে গিয়েছিলো। এমন সুন্দর কোনোকিছু আমি এ জীবনে দেখিনি। মনে হচ্ছিলো, এখন আমার মরে যেতে একটুও দুঃখ হবে না।
সবসময় সব যাত্রায় দু'জনে একসঙ্গে ছিলেন, আজই আলাদা হতে হলো! এই তবে বিচ্ছেদের শুরু?
বুকের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠেছে এখন, খানিক পরপর একটা দংশনের মতো লাগে। শ্বাস নিতেও কষ্ট, মুখ খুলে হাঁ করে শ্বাস নিতে হচ্ছে, শরীর ঘেমে উঠেছে। কোনোমতে বললেন, হাসপাতাল পর্যন্ত বোধহয় যাওয়া যাবে না, রবি।
রবি নিজেও খুব একটা ভরসা পায় না। তবু বলে, এই তো এসে গেছি, দাদু।
পৌঁছে গেলে আর ভয় নেই।
রবির মুখে ঘুরে তাকিয়ে এবারক হোসেনের একটা অদ্ভুত কথা মনে এলো, শেষ যাত্রায়ও তাঁর সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই তাঁকে এই দুয়ারটুকু পার হতে হবে!
৪.
রবির সঙ্গে এবারক হোসেন চলে যাওয়ার পরে জোহরা বেগম কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। দিনের বেলা হলে রিকশা না পেলেও পায়ে হেঁটেই হাসপাতালে যাওয়া যেতো, খুব বেশি দূরের পথ নয়। মজিবর গেছে রিকশা খুঁজতে, এখনো ফেরেনি। তিনি ওপরতলায় উঠে অসীমদের দরজায় টোকা দিলেন।
ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আরো জোরে ধাক্কা দিলেন এবার, লজ্জা-সংকোচের সময় নয় এখন। আরো বার দু'তিনেক ধাক্কা দিতে ঘুমচোখে দরজা খুলে দেয় রীতা। জোহরা বেগমের ভেজা চোখ দেখে কী বুঝলো, কে জানে। বললো, কী হয়েছে? কাকার শরীর...
রবির সঙ্গে হাসপাতালে গেলো একটু আগে।
মজিবর ফিরলো রিকশা নিয়ে। শব্দ পেয়ে জোহরা বেগম নিচে নেমে এলেন। মজিবর তাঁকে একা কিছুতেই ছাড়বে না, সে-ও উঠে আসে রিকশায়।
এবারক হোসেনকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। জোহরা বেগম কাছে আসতেই তাকিয়ে দেখলেন একবার।
বড়ো ক্লান্ত লাগে তাঁর, ঘুম পায়। অথচ বুকের ভেতরের অসহ্য দংশন তাঁকে জাগিয়ে রাখে। হাত বাড়িয়ে জোহরা বেগমের একটা হাত তুলে নিলেন। 'আজি কোনোখানে কারেও না জানি / শুনিতে না পাই আজি কারো বাণী হে...'। 'মুখের পানে তাকাতে চাই, দেখি দেখি দেখতে না পাই...'।
এবারক হোসেন চোখ বুজলেন। ভেবে রেখেছিলেন, ''আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো' এই শেষ কথা ব'লে / যাব আমি চলে'।
হলো না। হয় না, তা-ও জানাই ছিলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।