যুক্তি ও প্রমাণে বিশ্বাসী
আজও বৃষ্টি হচ্ছে! দুইদিন ধরে একটানা বৃষ্টি। থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ঘরের পুরানো চাল দিয়ে দু’তিন জায়গা থেকে পানি চুয়ে চুয়ে পড়ছে। অবশ্য একটি থেকে ভালোই পড়ছে। এই দুই দিনে একবারের জন্যও ভ্যান গাড়িটি ঘর থেকে বের করতে পারিনি।
তাই আর ক্ষেপ মারা যাচ্ছে না। বৃষ্টি আর ঘরের স্যাঁত স্যাঁত ভাবের জন্য শবীরটা কেমন জানি ম্যাচ ম্যাচ করছে? শেষদিন আবার আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজে একটু জ্বরও এসেছিল। এখনো তেমন কমেনি। তাই হয়তো খারাপ লাগছে। যাই হোক, আজ একবার হলেও বের হতে হবে।
ঘরে নাকি চাল নাই। বউ কালকেই বলে দিয়েছে। এইবেলাটা কষ্ট করে যাবে। কষ্ট আর কি? বউটা খা’বে বলে মনে হয় না ! মা’রা তাইতো করছে আদিকাল থেকে !! দেখি বিকেলের দিকে গাড়িটা নিয়ে বের হব !
বাজান, জানলা দিয়া কি দেহো? মেয়ের ডাক শুনে পিছনে ফিরে দেখি, মেয়েটা আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েছে। তার একটা হাত আমার বুক জড়িয়ে।
বাজান, তুমি কি আইজ বাইর হইবা?
দেহি, বৃষ্টি কমলে বিহালের দিকে বাইর হবু।
ক্যান কিছু আনবার লাগবো?
মেয়েটা আমার খুব ভাল। বয়স ৪ বছর ২ মাস। লম্বা, স্বাস্থ্য তেমন নাই, রংটা শ্যামলা। তার তেমন চাহিদা বা বাইরে যাবার ইচ্ছা নাই।
এই বললো, লাগবে, একটু পরে আবার তা ভুলে শেষ। ভাবছি আগামী বছরের শুরুতে পাশের স্কুলে ভর্তি করে দিমু।
আমি আবার জানতে চাই, কিরে, কইলি না? কিছু আনুম কিনা?
কাইল না, শেফালির মায় খিচুরি রানছিল! আমারও খাইতে মন চাইছিল !
ঢং! ভাত খাইবার পারো না, আবার খিচুরি !
দরজার পাশে বসে কঁচু শাক কাঁটতে কাঁটতে ফোস করে উঠে, তার মা।
যদিও বউটার কোন দোষ নাই। এই বৃষ্টির মধ্যেও দূরের বাজার থেকে শাক আর কিছু তরকারি নিয়ে এসেছে।
আমিতো আর বের হতে পারিনি। যদিও বলেছিলাম, ‘যাবু নাহি, বাজারের দিহে?’
‘থাক, জ্বর লইয়া আর তোমার বাইর হওন লাগতো না। হুইয়া থাকো। ’
অহন যাও, বাপ-মাইয়া গিয়ে গোসল করে আমারে উদ্ধার করো। আমি শাকটা রান্না কইরা ভাত দিমু।
হ, ঠিক কইছো। আমার আবার বাহির হওন লাগব।
দুপুরে খেয়ে অসল দেহে কিছুক্ষণ বিছনায় এপাশ-ওপাশ করতে থাকি। হালকা ঠাণ্ডা দিনে ঘুম তেমন আসে না। মনে হয়, বৃষ্টি একটু কমছে ! বাহিরে ভালো আলো দেখা যাচ্ছে।
যাই, ভ্যান গাড়িটি নিয়ে একটা চক্কর দিয়ে আসি। মেয়েটার জন্য কিছু কম দামের পোলাউয়ের চাল আর এক কেজি বেগুন নিয়ে আসতে হবে। রাতে সবাই এক সাথে গরম গরম খিচুরি খাওয়া যাবে !
পান্থপথের কাঠের দোকানগুলোর সামনে গাড়িটা রেখে, যে দোকানের সাথে আমার পরিচিতি তার ভিতরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাইরে এখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আসার সময় তাই ভিজে গিয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর, পাশের দোকান থেকে লোক এসে বলল, ‘কিরে যাবি নাকি? একটা পার্টি কিছু চেয়ার কিনছে, মাল গুলি দিয়ে আয়। ’
বৃষ্টি আছে, বেশি টাকা চাইবি। বেটার না যাইয়া উপায় নাই। আর কোন গাড়ি পাইতাছি না।
বেটা কি বৃষ্টি মধ্যে চেয়ার নিয়ে যাইব? - আমি অবাক হয়ে জানতে চাই।
আরে প্লাষ্টিকের চেয়ার! তাড়াতাড়ি আয়। বেটা দাঁড়ায় আছে।
দাঁড়া, আসি।
দূর থেকেই দেখলাম, দোকানে সামনে একজন মধ্য বয়স্ক লোক এক হাত কোমড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে চিন্তা আর বিরক্তি।
কারণ বৃষ্টিটা আবার শুরু হবে। চারিপাশ ঘণ কালো হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে অনেক জোড়েই নামবে। আমাদেরকে আসতে দেখে, লোকটি নিজেই এগিয়ে এসে, জিজ্ঞেস করল, ‘মিরপুর রূপনগর যাবে?’
আমি আকাশের দিকে দু’চোখ ভাঁজ করে বললাম, ‘এহন তো জোড়ে বৃষ্টি নামব। কেমনে যাবু?’
বাবা একটু কষ্ট করে যাও, পয়সা বাড়াইয়া দিমু নে -উনি আকুতি করে বলল।
৪০০ টাকা লাগব। এহন রাস্তা বন্ধ। তাই ঘুরে যাওয়া লাগব। হেরমধ্যে আবার বৃষ্টি নাইম্যা গেছে। - আমি একটানে বলে যেন স্বস্তি পেলাম !
লোকটি কথা না বাড়িয়ে আমাকে ঠিকানাটা বুঝিয়ে, কাগজে ঠিকানা আর একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে, সঙ্গে থাকা ভাড়া করা সিএনজি করে চলে গেল।
বৃষ্টি অনেক জোড়েই হচ্ছে। মাঝে মাঝে বজ্রপাত আর দমকা বাতাস যেন বৃষ্টিকে ভয়ংকর করে তুলছে। শরীরে জমে থাকা জ্বর এখন হার-কাঁপুনি হয়ে পিঠে চাবুক মারছে। আর শিরদাঁড়া কেঁপে কেঁপে উঠছিল। চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিশে আমার চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল।
তেমন দেখতে পারছিলাম না, শুধু আমার মেয়ের মিষ্টি মুখটা ভেসে উঠছিল। সে আজ খিচুরি খেতে চেয়েছিল ! প্রচণ্ড সাদা আলো এসে আমার চোখ অন্ধকার করে দেয়। মনে হয়, ওপাশ থেকে আসা একটি বাস আমার উপর দিয়ে চলে যায়। আচ্ছা ! ওটা কিসের দরজা !!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।