ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
২.৩
মেয়েটাই সবসময় খোঁজখবর রাখে। একদিন-দু'দিন পরপর ঢাকা থেকে ফোন করে ঝর্ণা, ঈদে-পরবে আসে। রঙ্গন দাদু-নানীর বড়ো ভক্ত। ও-ই প্রথম নাতি, আর ওকেই তো সবসময় চোখের সামনে পাওয়া যায়। বড়ো ছেলেটির ঘরে ছেলেমেয়ে এলো ওরা দেশের বাইরে যাওয়ার পর।
নাতনিকে প্রথম দেখলেন ওরা দেশে বেড়াতে এলে, ডোরার তখন তিন বছর। খানিক পরপর ভুরু-মুখ কুঁচকে হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে বলতো, আমি রাগ করেছি! এক সকালে গুনেছিলেন, ঊনচল্লিশবার এরকম রাগ করেছিলো সে।
অর্ণব হলো তারও কয়েক বছর পর। তাকে দেখতে দূরদেশে উড়ে যেতে হয়েছিলো। দু’বছর বয়স তখন ওর।
দাদুর দেখাদেখি বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর পা তুলে বুকের ওপর বই খুলে পড়ার অভিনয় করতো। ডাইনোসরের ছবি দেখতো বই খুলে। ওকে দেখে ভাবতেন, ওর বয়সে আমরা ডাইনোসর বলে কোনোকিছুর নামও জানতাম না। তার ডাইনোসরপ্রীতি এখন আরো বেড়েছে, একদিন ফোনে কথা বলতে বলতে অর্ণব ঘোষণা দিয়েছিলো, বড়ো হয়ে সে ডাইনোসর হবে! ফিরোজ-রুবার ছেলেমেয়ে হয়নি এখনো, কেন কে জানে মিসক্যারেজ হয়ে গেলো কয়েকবার।
রুবার বাবা তরিকুল সাহেব কলেজে তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
তিনি বাংলায়, তরিকুল সাহেব ইংরেজিতে। একসময় মালতীনগরে তরিকুল সাহেবের করতোয়ার পাড়ের বাড়িতে রোজ বিকেলে ব্রীজ খেলতে যাওয়া হতো। চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পরও অনেক দিন বিকেলে তাসের আসর বসতো। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে তরিকুল সাহেব চলে গেলেন বছর দুয়েক হয়। এ পাড়ার তাস খেলার সঙ্গী আফসার খোন্দকার, পণ্ডিত সাহেবও আর নেই, এবারক হোসেনের কর্মহীন দীর্ঘ বিকেলগুলো এখন আরো দীর্ঘ হয়েছে।
ব্রীজ খেলায় মনমতো তাস কোনোসময়ই পাওয়া যায় না, এটা আছে তো ওটা নেই। নিজের হাত ভালো তো পার্টনারের হাতভর্তি রাজ্যের জঞ্জাল। তবু তাস বেঁটে দেওয়ার পর হাতে যা আসে, তাই নিয়ে খেলে যেতে হয়। এবারক হোসেন দেখেছেন, মানুষের জীবনও ওরকমই। বড়ো ছেলে লেখাপড়া শেষ করলো, চাকরি-বাকরি করবে না।
বছর কয়েক ধরে কীসব ব্যবসাপত্র করার চেষ্টা করলো, বিশেষ সুবিধা হয়নি। বিয়েও করে ফেলেছিলো ততোদিনে। খুব হাসিখুশি বউটি, খানিকটা পাগলাটেও। ব্যবসায় কিছুতেই কিছু ঘটে উঠছিলো না দেখে ওরা দেশের বাইরে চলে গেলো বিয়ের বছর তিনেক পরে।
ঝর্ণার বিয়ে হয়েছিলো পাশ করার পরপরই।
সরকারি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পেয়েও করলো না, রঞ্জুর মত নেই বলে। চমৎকার ছেলে রঞ্জু, কখনো কখনো তাঁর নিজের ছেলেদের চেয়েও বেশি সে। কিন্তু এই একটি ব্যাপার নিয়ে ওর ওপরে কিছু ক্ষোভ জন্মেছিলো তাঁর। এবারক হোসেনের মতে মেয়েদের জন্যে অধ্যাপনার মতো ভালো পেশা আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট করেও ঝর্ণা পড়াশোনাটা কোনো কাজে লাগালো না, এই অনুযোগটি খুব ছিলো তখন।
শুধু ঘরসংসারই যদি করবে, তাহলে আর এতোদূর লেখাপড়ার কী দরকার ছিলো? এখন অবশ্য মাঝে মাঝে মনে হয়, চাকরিতে ঢুকে পড়লে ঝর্ণার জীবনটা কীরকম হতো? বাইরের কাজকর্ম করে না বলে তাঁরা ঢাকায় গেলে অখণ্ডভাবে সময় দিতে পেরেছে সে বরাবর। যখন-তখন যে কোনো সঙ্কটে-সমস্যায় তাকে পাওয়া গেছে সহজে।
ফিরোজকে নিয়ে ঝামেলা কম হয়নি, শুরু তার স্কুলে পড়ার সময় থেকে। পড়াশোনায় সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ধারালো, অথচ মনোযোগ নেই মোটে। কোনো কারণ ছাড়া সে প্রথমবার বাড়ি থেকে পালায় ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়।
তারপর প্রশ্নবোধক চেহারার বন্ধুবান্ধব, তাদের নিয়ে দলপাকানো, মারপিটে জড়িয়ে পড়া কোনোটাই বাদ যায়নি। এক রাতে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাকে ছাড়া তার এক মুহূর্ত চলে না, খুন হয়ে যায় প্রকাশ্য রাস্তায়। সেবার ফিরোজকে রাতারাতি ঢাকায় পাচার করে দিতে হয়েছিলো। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে মুষ্টিযুদ্ধ পর্যন্ত অগণিত বিষয়ে তার প্রবল উৎসাহ এবং এক ধরনের সহজ দক্ষতা, কিন্তু যোগফলে তেমন কিছু দাঁড়ালো না। ধরে-বেঁধে একরকম জোর করে তাকে বি.এ. পরীক্ষা দেওয়ানো হলো, অপ্রত্যাশিত রকমের ভালো ফল করলেও আর পড়াশোনা করলো না।
অনেক বছর ধরে অনায়াসে একেকটা চাকরি ধরেছে, তখন তার কী উচ্ছ্বাস-উৎসাহ। কোনোকিছুতে উৎসাহ তার বেশিদিন থাকে না, নির্বিকারভাবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আবার নতুন কোনো একটায় লেগে পড়তেও তার সময় লাগেনি। বয়স বাড়ছে, কিন্তু এখনো বদলায়নি সে তেমন।
জীবনভর দূরে দূরে থাকা ছাড়া ছোটোটিকে নিয়ে কোনো গোলমাল ছিলো না।
তারপরেও কোথায় কী যে একটা না-বোঝা জট পাকিয়ে গেলো, সে আরো দূরের মানুষ হয়ে উঠলো। হয়তো সবচেয়ে দূরের।
সবাই বাড়িছাড়া হওয়ার পরেও অন্তত রীতা ছিলো, তখনো বাড়ি এতো ফাঁকা ফাঁকা লাগতো না। জোহরা বেগমের ফুপাতো বোনের মেয়ে রীতা, এক্কেবারে শিশুকাল থেকে সে এ বাড়ির একজন হয়ে উঠেছিলো। শান্তাহারে নিজের বাবা-মা'র কাছে মাঝেমধ্যে গেলেও সে এবারক হোসেন আর জোহরা বেগমকে আব্বা-আম্মা জেনেছে।
তখন এক বাড়িতে দুই রীতা নিয়ে বেশ গোলমাল লেগে যেতো। নিচে এক রীতা, ওপরে অসীমের বউ রীতা। কখনো নাম ধরে ডাকলে একসঙ্গে দুই রীতাই সাড়া দিয়ে ফেলতো।
ছেলেমেয়েরাও রীতাকে নিজেদের ছোটো বোনটি ছাড়া কিছু ভাবেনি কোনোদিন। একবার তিন ছেলেকে একসঙ্গে পেয়ে এবারক হোসেন বলেছিলেন, আমাদের তো বয়স হচ্ছে, বাড়িঘর আর সামান্য যা কিছু আছে তার একটা ব্যবস্থা কাগজে-কলমে করে রাখতে চাই।
তোমরা কী বলো? তিনজনই বলেছিলো, ওদের কিচ্ছু চাই না, সব যেন ঝর্ণা আর রীতার জন্যে থাকে। রীতাও বিয়ের পরে ঢাকায় চলে গেলো বছর পাঁচেক হয়। নাতি-নাতনিদের পাওনা যা-কিছু আদর-প্রশ্রয়, নাগালের মধ্যে আছে বলে রঙ্গন একা লুটেপুটে নিচ্ছিলো অনেকদিন ধরে। এখন ভাগ বসাচ্ছে রীতার মেয়ে শ্রেয়া।
মনে পড়ে, বড়ো ছেলে একবার চিঠিতে তার শোনা একটি ইংরেজি গানের কথা লিখেছিলো।
গায়ক বলছে, এই তো মাত্র সেদিনের কথা, আমার ছেলেটি এত্তোটুকু ছিলো। তখন ওর সঙ্গে বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করতাম। ছেলেটি কেবল আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করে আর বলে, বড়ো হলে আমি আমার বাবার মতো হবো। আমি সারাদিনমান কাজে কাজে বাইরে থাকি, মাঝেমধ্যে দীর্ঘ সময়ের জন্যে শহরের বাইরে চলে যাই, দেখা হয় না দিনের পর দিন। তবু যখনই ঘরে ফিরে আসি, সে ঝাঁপিয়ে চলে আসে আমার কোলে আর বলে, বড়ো হলে আমি ঠিক বাবার মতো হবো।
এই তো মোটে সেদিনের কথা...। এখন ছেলে বড়ো হয়েছে, দূরের শহরে থাকে কর্মস্থলে। কাজকর্ম, সংসার নিয়ে সে ব্যস্ত এখন, দেখা হয় কালেভদ্রে। এই তো মোটে সেদিনের কথা, ওর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিলো। বললো, ছেলেটার শরীর ভালো নয়।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবে দেখা হবে? ছেলে বললো, বাবা, বোঝোই তো, কতো ব্যস্ত থাকি! আমার তখন মনে হলো, আমার ছেলেটি ঠিক ঠিক তার বাবার মতো হয়েছে!
গানটি এবারক হোসেন শোনেননি। ভিনদেশী গান তিনি তেমন শোনেননি কোনোদিন, কিন্তু এই গানটি তাঁর খুব শুনতে ইচ্ছে হয়েছিলো। অদ্ভুত এক চক্র এই জীবন - যা নিচ্ছি, তা ফিরিয়েও দিতে হবে এই জীবনেই। ভেবেছিলেন, এরপরে ছেলে যখন আসবে দেশে, গানটি সঙ্গে করে আনতে বলবেন। বলা হয়নি, আর কি হবে?
এবারক হোসেন ভাবলেন, এতো অপূর্ণতার পরেও এক জীবনে যা পাওয়া হলো, তা-ও কি কম কিছু? 'জীবন হয়নি ফাঁকি, ফলে ফুলে ছিল ঢাকি / যদি কিছু রহে বাকি কে তাহা লবে! / দেওয়া-নেওয়া যাবে চুকে, বোঝা-খসে-যাওয়া বুকে / যাব চলে হাসিমুখে - যাব নীরবে।
' ঠাট্টা করে প্রায়ই বলেন, মরার পরে বেহেশত-দোজখ বা স্বর্গ-নরক যেখানেই যাই, কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে ঠিক ঠিক পেয়ে যাবো। আমার আর ভাবনা কীসের? আসলে ঠাট্টাও নয়, শিক্ষক হিসেবে প্রায় সর্বজনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা তিনি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন বরাবর। পুরনো অনেক প্রিয় ছাত্র তাঁর পরিবারের মানুষ হয়ে আছে দীর্ঘদিন, তিনিও তাদের ঘরের মানুষ। ঈদে-পরবে সালাম করতে আসে তারা, বাড়ির ভিত দেওয়ার জন্যে ডাকে, মেয়ের বিয়ে ঠিক করে স্যারের কাছে একবার পরামর্শ করে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।