ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
১.৩
তাঁর জানা হয়ে গেছে, এই রাতের পরের ভোরটি আর দেখা হবে নাÑ- ‘ঢাকো তবে ঢাকো মুখ, নিয়ে যাও দুঃখ সুখ / চেয়ো না চেয়ো না ফিরে Ñ / হেথায় আলয় নাহি Ñ অনন্তের পানে চাহি / আঁধারে মিলাও ধীরে...’। এখন শুধু সহ্য করে যাওয়া আর অপেক্ষা করা। শেষের সে সময়টা কেমন হবে? ‘হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি/স্তব্ধ আকাশ নীরব শশী রবি...’।
একজন কবিকে মনে পড়ছে তাঁর। মনে পড়ার ব্যাপারও ঠিক নয়, কবি তাঁর জীবন ঘিরে আছেন সেই কবে থেকে! খঞ্জনপুর হাই স্কুলের নিচের ক্লাসের ছাত্র তখন এবারক হোসেন।
বীরেন স্যার ক্লাসে এসে কবির মৃত্যুর খবর দিয়ে বলেছিলেন, আজ আমি আর কিছুই পড়াবো না। ক্লাসের পুরোটা সময় তিনি সেই কবির কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। সব কবিতা বোঝার বয়স তাঁর তখনো হয়নি। বীরেন স্যারের আবৃত্তির গুণে বা আর যে কোনো কারণেই হোক, কবি তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কবির তখন খ্যাতি প্রচুর, কিন্তু একজন কবির মৃত্যুতে ক্লাসের পড়া বন্ধ রাখা খুব অভিনব মনে হয়েছিলো।
পৃথিবীর শেষ বড়ো যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর চলছে তখন, ঋতু বর্ষা।
কিন্তু কবির কি মৃত্যু হয়? সেই দিনের পরে খুঁজে খুঁজে কবির কবিতা পড়ার শুরু তাঁর। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে উঁচু দেওয়ালঘেরা এক বাড়ির ভেতর থেকে কিশোরীকণ্ঠের গান ভেসে আসতে শুনেছিলেন Ñ ‘আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে...’। আগের শোনা কোনো গানের সঙ্গে এই গানের মিল নেই। একেবারে নতুন।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গানটা শুনতে হয়েছিলো। পরে জেনেছিলেন, এ-ও সেই কবির গান। দেওয়ালঘেরা বাড়িটি ছিলো এক সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের, মুসলমান বাড়িতে তখনো মেয়েরা গান করে না। সেই গান গাওয়া কিশোরী মেয়েটিকে কোনোদিন চোখে দেখেননি, কিন্তু সেই গান যে কী সুধারস ঢেলেছিলো, আজও তা তাঁর কানে লেগে আছে।
কবির কবিতা আর গান বুকের ভেতরে খোদাই হয়ে যাচ্ছিলো।
কলেজ পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া, সাহিত্যের শিক্ষকতা Ñ- সে-ও কবির কারণে। আজ ষাট বছরের ওপরে কবি তাঁর নিত্যদিনের সখা।
‘কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে Ñ
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়
তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
’
আজ এই রাতে, যখন তিনি জেনে গেছেন, যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, কবিকে কি তাঁর মনে পড়বে না! কবি বলেছিলেন, আমার কিছুই না থাকলেও গান থেকে যাবে। কবিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও হয়ে থাকেন। কবির গান আজও ঠিকই রয়ে গেছে, আজও নতুন।
এবারক হোসেনের অকস্মাৎ মনে হয়, আচ্ছা, আমি চলে গেলে আমার কী থাকবে? কিছু থাকবে কি? এই যে এতোগুলো বছর কাটলো এই ধূলি-ধূসরিত পৃথিবীতে, তার যোগফল কি? আনন্দ-সুখ-বেদনা-দুঃখ-চাওয়া-হতাশা-ভয়-দুরাশা-পাওয়া এইসব মিলিয়ে জীবন নামের অত্যাশ্চর্য মহার্ঘ্য একখানা জিনিস, এই তো! ধরাছোঁয়া যায় না, কেবল যাপন করে যেতে হয়। কী পাওয়া হলো?
কবি বলেছিলেন, ‘...কী পাইনি, তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি...’।
সময় নেই, এসব হিসেব মিলিয়ে আর কী হবে? যা পাওয়া গেলো, যা দেওয়া হলো, সবটুকুর শেষ যোগফল এই সত্যে এসে স্থির হয় -- চলে যেতে হবে। ‘ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে...’। '
হাজীপাড়ায় এসে রিকশার চেন পড়ে গেলে রবি বলে, তাড়াতাড়ি কর রে, বাবা। তোর চেন পড়ার আর সময় পেলো না!
রিকশাওয়ালা কোনো জবাব দেয় না। এবারক হোসেন অন্ধকারে চোখ ফেলে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন।
রাস্তার বাঁদিকে ছোটোমতো একটা মাঠ, ছেলেরা দিনের বেলায় হৈ-হল্লা করে খেলে। খেলাধুলা নিয়ে তাঁর বিশেষ উৎসাহ কোনোদিন ছিলো না, এই মাঠের পাশ দিয়ে যেতে লক্ষ্য করেও দেখেননি তেমন। আজ এখন মনে হলো, আর দেখা হবে না! ‘এতো কামনা এতো সাধনা, কোথায় মেশে...। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।