সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...
কে যায়রে পালকী চড়িয়া...। ভাবতেই অবাক লাগে এভাবে যদি আমার বিয়েটাও পালকিতে চড়ে হত ,তাহলে কি মজাই না হত। কিন্তু তা কি আর সম্ভব। এখনতো পালকি আর দেখাই যায়না। তাই এবার পালকির সেমসাইড।
পালকি আমাদের হাজার বছরের লোক সংস্কৃতির অন্যতম বাহন। পালকিকে নিয়ে কত কবিতা, গান, নাটক আছে। সে সব কবিতা গান এখন আমাদের ঐতিহাসিক লোক সংস্ড়্গৃতির সাথে মিশে আছে। যেমন পালকি বেহারারা এক সময় গেয়ে চলতো ‘হু-হুমনারে, হুমনা বা আল্লা বলরে····· কন্যার ভাবীগো আগাগ্যাইয়া নেনাতো। এসব গান এখন আমাদের লোক সঙ্গীতের ঐতিহ্যের কথা।
গ্রাম-বাংলার একটি পরিচিত নাম ও ঐতিহ্যবাহী অভিজাত বাহন পালকি। একসময় গ্রামাঞ্চলে বাহন হিসাবে পালকির ব্যাপক প্রচলন ছিল। তখন বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মুসলিম পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা-নেওয়ার জন্য পালকী ব্যবহার হতো। রণশীল হিন্দু পরিবারের মহিলাদেরকে গঙ্গা স্নানে পালকিতে করে নিয়ে যাওয়া হতো। জমিদার, জোতদারও পালকিতে চড়েই জমিদারী দেখাশুনা করতো।
তাছাড়া মুর্শিদরাও পালকিতে চড়েই তাদের ভক্তদের বাড়ীতে যাতায়াত করতেন। পালকি দেখতে একটি বড় বাঙ্রে মতো। টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরী পালকিতে বিভিন্ন কারুকাজ করা হয়। ফলে সুন্দর কারুকাজ খচিত একটি পালকী সবার দৃষ্টি কাড়ে। প্রতিটি পালকিতেই দু’জন লোক অনায়াসে বসতে পারে।
এতে বসার পর সামনে ও পিছনে একাধিক লোক কাঁধে নিয়ে পালকি বহন করে।
যারা পালকি বহন করে তাদের বলা হয় বেহারা। একসময় গ্রামবাংলার প্রতিটি স্থানেই বাস করত বেহারা সম্প্রদায়। এই বেহারা সম্প্রদায় পালকি বহনের কাজে নিয়োজিত থেকে জিবীকার নির্বাহ করতো। বংশ পরম্পরায় এ শ্রেনীর লোক তাদের বাপ-দাদার এ পেশাটি ধরে রাখতো।
একটি পালকি বহনের জন্য পালকির সামনে দু’জন পেছনে দু’জন বেহারা পালকি কাঁধে নিয়ে বহন করে থাকে। পালকি যাবার সময় বেহারা কষ্ট লাঘবের জন্য এক ধরনের জারিগান পরিবেশন করে থাকে। এ গান সকলকে আনন্দ যোগায়। এ ছাড়া বেহারাগণ লাঠি খেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শারিরীক কসরত দেখাতেও পারদর্শী।
পালকির সাথে গ্রাম এলাকার বিয়ের অনুষ্ঠানটি যেন জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।
পালকিতে চড়ে বর-কনে শ্বশুর বাড়ীতে না গেলে এক সময় বিয়েই হতো না। পালকির বাহক বেহারার নানান রং এর পোষাকে নেজেরা সেজে পালকি সাজিয়ে বিভিন্ন জারিগানের তালে তালে পথ চলতো। এ মনোরম দৃশ্য উপভোগের জন্য বেহারার পিছু নিত ছেলে, বুড়ো অনেকে। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনে আনা নেয়া ছাড়াও এমন এক সময় ছিল যখন জামিদার, মহাজন, রায়বাহাদুর তথা অভিজাত শ্রেণীর অভিজাত্য ও গৌরবের প্রতীক হিসাবে পালকি ব্যবহার করা হতো। সাধারণ যখন তখন ইচ্ছা করলেই পালকিতে চড়তে পারতো না।
বেহারাও এতে আনন্দ বোধ করতো। বেহারা পালকি নিয়ে আসতো প্রথমে বরের বাড়ী। বর নতুন সাজে সেজে পালকিতে উঠতো। বরের সাথে পালকিতে তুলতো বৃদ্ধ নানী কিংবা ছোট শিশুকে। তারপর বেহারা বরের বাড়ী থেকে পালকি নিয়ে চলত কনের বাড়ীতে।
পালকিতে বসে তারা অহংকার ও গৌরব বোধ করতো। তাই যে কেউ পালকিতে চড়লে তখনকার সময় জমিদার তাকে ডেকে এনে শাস্তিও প্রদান করতেন।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে পালকির কদরও কমে গেছে। গ্রাম বাংলার বিয়ে বা অনুষ্ঠানে এখন আর পালকি চোখে পড়ে না। যদিও বা কেউ পালকি আনেন বিয়েতে তা হবে হাসির খোরাক।
শিতি সমাজ এখন পালকিতে চড়লে নীচু সমাজ বলে মনে করেন।
বিয়ে অনুষ্ঠানে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাইভেট কার, বাস, টেম্পু, মাইক্রোবাস প্রভৃতি। ফলে পালকির এই কদর এখন আর নেই।
আমাদের দেশ থেকে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী পালকি এখন বিদায় নিতে চলেছে। পালকির ঠাঁই হয়েছে এখন দেশের বিভিন্ন যাদুঘরে।
ফলে পালকির সেই বাহক বেহারা সম্প্রদায়ও বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দিয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে রাস্তায় নেমেছে। তাই আমাদের উচিত হাজার বছরের বাঙালীর ঐতিহ্য পালকিকে টিকিয়ে রাখা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।