নিরর্থক এই জীবনে অর্থকতার খোঁজে চলেছি অজানায় আজ লিখব একজন লক্ষ্মী বা আদর্শ(!) প্রকৃতির ছেলে সমগ্র জীবনে সাধারণত কি কি করে থাকে এটা নিয়ে। তথাকথিত লক্ষ্মী ছেলেদের বিভিন্ন মনোভাবও নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব। আমি স্বীকার করি ব্যতিক্রম আছে অনেক তবে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের নিয়েই এই লেখা। সরাসরি বিষয়বস্তুতে চলে আসি।
ধরে নেই আমাদের লক্ষ্মী ছেলেটা কোন হিন্দু ঘরে জন্ম নেয় ; তার একটা নাম দেয়া প্রয়োজন - দিলাম সুকান্ত ।
সুকান্ত বাবা মা এর পরম আদরে শৈশব পার করে। তার বাবা মা জন্ম থেকেই ঠিক করে রেখেছে সে ডাক্তার হবে-সুকান্ত জিজ্ঞাসা করে মা আমি ডাক্তার কেন হব? মা বলে "বোকা ছেলে, ডাক্তার হলে বস্তাভর্তি টাকা আয় করতে পারবি, ডাক্তারের সমাজে কত সম্মান জানিস!" সুকান্ত মেনে নেয় কারণ সে লক্ষ্মী ছেলে - বড়দের মুখেমুখে তর্ক করা অপরাধ সে জানে। মনে মনে স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হয়ে সে একগাদা টাকার একটা বস্তা হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, এক বান্ডিল টাকা বাবা, একটা মা আরেকটা দাদু দিদিমার হাতে তুলে দিচ্ছে, কয়েক বান্ডিল আবার ছাদের উপর উঠে রাস্তার গরিবদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিচ্ছে।
সুকান্ত বড় হতে থাকে। এতকাল সবার দেখাদেখি সে ধর্মকর্ম করে আসছে ।
বাবা মা পূজা অর্চনার সময় তাকে হাত জোড় করে প্রণাম করা শেখায় , ঈশ্বর আরাধনার উপায় শিক্ষা দেয়। লক্ষ্মী সুকান্ত কিন্তু সবসময় পুজার থালায় উপাদেয় প্রসাদ ও মিষ্টান্ন এর দিকে চেয়ে থাকে । তার মনে আকূল প্রার্থনা পূজা কখন শেষ হবে; কখন তার পেটপূজা শুরু হবে। ধর্মের সব ই তার ভাল লাগে কিন্তু ধর্মের বইগুলোর দৈব কাহিনী তাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে। একদিন মায়ের কাছে সে সাহস করে প্রশ্নগুলো করেই বসে- "মা ঈশ্বর দেখা যায় না কেন?ঈশ্বর মানুষকে তৈরি করেছেন ও নিয়ন্ত্রণ করছেন অথচ মানুষেরই কৃতকর্মের জন্য তাকে আবার শাস্তি দিচ্ছেন কেন? ঈশ্বর যদি এক ও অদ্বিতীয় হয় তবে আমরা কেন এতজন দেবতার পূজা করি?..ইত্যাদি ইত্যাদি " ।
মা তাকে ইঞ্জেকশন এর মত করে উত্তরগুলো গলধকরণ করায়।
লক্ষ্মী ছেলে মনে বল পায়, সে ভাবে ধর্ম এত ভাল(!) জিনিস- মানুষের কল্যাণের জন্য ঈশ্বর এত সুন্দর(!) নিয়মকানুন করে দিয়েছেন। আর ধর্মে তো সব ভাল(!) কথাই বলা আছে - সত্য কথা বল, মা বাবার সেবা কর ইত্যাদি। কিন্তু একটা জিনিস সে বুঝতে পারে না যে ঈশ্বর কেন ধর্মগ্রন্থে নিজেই তার নিজের সেবা করতে বলেছেন; মহৎ ব্যক্তিরা তো কখনও নিজের দাসবৃত্তি প্রার্থনা করেন না। ঈশ্বর যদি এক ও অভিন্ন ই হন তবে পৃথিবী তে এত সহস্র ধর্মই বা কেন আর তারা কেন একে অপরের ধর্মে বর্ণিত ঈশ্বরকে অস্বীকার করে? যাই হোক এসব নিয়ে সে আর বেশি মাথা ঘামায় না।
দুহাত জোড় করে সে নিয়মিত ঈশ্বরের প্রার্থনা করতে থাকে। ঈশ্বর এর কাছে সে অনেক অনেক টাকা, অনেক খাবার আর নিরঙ্কুশ অবসর সময় প্রার্থনা করে। তার বিশ্বাস অটল - একদিন ঈশ্বর তার ইচ্ছা পূরণ করবেই।
একদিন পাড়ার এক মুসলিম ছেলের সাথে তার কলহ বাঁধে। ছেলেটা অকারণেই তাকে একটা ছড়া বলে তাকে ক্ষেপায় -"হিন্দু হিন্দু তুলসি পাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা"।
শুনে সুকান্ত দিগবিদিক শুন্য হয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মারামারি করে রক্তাক্ত অবস্থায় সে বাড়ি ফেরে। মা শুনে তাকে বারবার করে মানা করে দেয় ওই ছেলের সাথে মিশতে। তাকে এটাও বলে, "বাবা আমরা মুসলমানদের দেশে বাস করি, তাদের সাথে যুদ্ধ করে আমরা পারবনা, আমরা যে সংখ্যালঘু । মুসলমানদের মত খারাপ জাত ও তো পৃথিবীতে দুইটা নেই- ওরা যে আমাদের জাত শত্রু ।
" কথাগুলো সুকান্তর মনে গাঁথা থাকে । সে মুসলিমদের মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করে। পাড়ার মুসলিম ছেলেদের সাথে গায়ে পড়ে আর কখনও সে কথা বলতে যায় না। ওদের দেখলে চেষ্টা করে যাতে মুখোমুখি সাক্ষাত না হয় । হিন্দু ছেলেগুলোকে তার আরও আপন বলে মনে হতে থাকে।
আমাদের লক্ষ্মী ছেলে স্কুল এ ভর্তি হয় বহু ঝক্কিঝামেলা(কোচিং , ভর্তি পরীক্ষা) এর পর। স্কুল এ যথারীতি সে প্রথম বেঞ্চে বসার জন্য প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। শেষ বেঞ্চে বসা ছাত্রগুলোর দিকে সে বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টিতে তাকায়-যেন ওরা নিম্নজাতের প্রাণী। প্রথম প্রথম সে বোঝেনা - স্যাররা তাকে অকারণেই ক্লাস এ অপদস্ত করতে থাকে। ক্রমেই সে সহপাঠী দের কাছ বুঝতে পারে- স্যারদের সুনজর পাওয়া যায় স্যারদের কোচিং সেন্টার এ গেলে।
স্কুলের স্যারদের কোচিং সেন্টার এ দিনরাত কোচিং শুরু করে। আবার সে ও তার বাবা মা এটাও জানে স্কুল এর স্যাররা কোচিং এও যা পড়ায় তা মানের দিক দিয়ে যথেষ্ট না। তাদের কয়েকজনকে আবার বাড়িতেও পড়ানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। স্যারদেরও দয়ার শরীর, নিতান্ত অপারগ(!) না হলে তারা না করতে পারেন না। দুই একজন শিক্ষক যাদের কাছে প্রাইভেট পড়া হয় না তারা ক্লাস এ প্রায়ই সুকান্তকে অকারণে বকাঝকা করেন ।
সুকান্ত নিরুপায় হয়ে স্বপ্ন দেখে একদিন সে বড় হয়ে এর প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু লেখাপড়া বাদে আর কিছুই করা হয় না তার। ছুটির দিন বিকালে সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে তার বয়সি অনেকেই মাঠে খেলছে, কিন্তু তার খেলার কোন উপায় নেই। বন্দি জীবনে কষ্টবোধ করার সময়ও যে তার নেই!
স্কুল এ প্রথম পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়। সুকান্ত দ্বিতীয় হয়।
সে খুশিমনে বাবা মা কে গিয়ে রেজাল্টকার্ড দেখায় , কিন্তু বাবা মার মুখ কাল দেখে সে অবাক হয়। বিনা মেঘে বজ্রপাত এর মত তার পিঠে দু'ঘা বসিয়ে তার বাবা বলে "পাঁজি কোথাকার, সেকেন্ড হয়ে এমন ভাব করছিস যেন পুরো স্কুল এ ফার্স্ট হয়ে এসেছিস। এত গুলো টিচার রেখেছিলাম এই বাজে রেজাল্ট এর জন্য? আমার কলিগ এর ছেলে ঠিক ই ফার্স্ট হয়েছে আর তুই? আমার মান সম্মান পুরো জলে ডুবিয়েছিস । " সুকান্ত অনেক কান্নাকাটি করে, হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। সে তো কম পড়ে নি, তার ত্রুটি কোথায় ছিল?
নতুন টার্ম এর জন্য নতুন উদ্যমে পড়া শুরু করে সে, স্যারদের দেয়া নোট সংযোজন বিয়োজন করে সে নিজে নোট তৈরি করে।
তার চেহারা ও কাজকর্মের জন্য লাস্ট বেঞ্চে বসা ছেলেগুলো তাকে উত্যক্ত করা শুরু করে "মুরগী" "মুরগী" বলে ডেকে। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সে আরও বেশি পড়তে শুরু করে। তার কিছু বন্ধু তার করা নোট এর খোঁজ পায় একদিন - চেয়েও বসে। সুকান্ত দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। তার কষ্টের জিনিস সে কাউকে কেন দেবে? অবশেষে সে ফার্স্ট হয়।
কিন্তু তার মনে তখনও দুঃখ কারণ সে অঙ্কে ৯৯ পেয়েছে- এক মার্ক স্যার ইচ্ছা করে কেটে রেখেছেন। তার বাবা কলিগ এর সামনে বুক ফুলিয়ে গল্প করে। আত্মীয় স্বজনদের একে একে ফোন করে এই কৃতিত্বের খবর জানান হতে থাকে। তার মা পাড়া- প্রতিবেশিদের সাথে সুযোগ পেলেই গল্পের ছলে তার ছেলের কৃতিত্ব প্রচার করে।
........(চলবে)
একজন লক্ষ্মী(!) ছেলের স্বরূপকাহন -২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।