আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মায়ের পাপে ছেলের প্রায়শ্চিত্ত!!!!!

আমাদের চারপাশে নিত্য ঘটে যাওয়া ছোট খাট ঘটনাগুলোও দিতে পারে অনেক অসাধারন শিক্ষা। অন্তর্দৃষ্টি মেলে দেখিনা আমাদের চারপাশে একটু তাকিয়ে............... ভালোবাসা ও বিশ্বাসের মূল্য যে এত নিষ্ঠুরভাবে পরিশোধ করতে হবে অয়ন কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। আজ যখন তাঁকে নিজের বাড়ি থেকেই বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলা হল তখন ও কিংকর্তব্যবিমুড়। ১২ বছরের সাজানো সংসারটা আজ ভেঙ্গে গেলো! কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া অয়নের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই। দু’জন দু’জনকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলো ।

পাঁচ বছর প্রেম করার পরে যখন ওরা বিয়ে করেছিল তখন অয়ন কলেজের প্রভাষক, সবে চার বছর হল অধ্যাপনা শুরু করেছে। ইংরেজির প্রভাষক হওয়ার সুবাদে কোচিং সেন্টারটা বেশ জমে উঠেছে। ছায়া সবেমাত্র হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে বেকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওদের ঘর আলো করে এলো ওঁদের ফুটফুটে মেয়ে বীথি। এর কিছুদিন পরেই ছায়া’র চাকরি হল এক সরকারি ব্যাংকে।

ইতিমধ্যে অয়নের সুনাম ও খ্যাতির চূড়া তীক্ষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে ব্যাংক ব্যালেন্সটাও বেশ ভারী হয়ে উঠলো। সব মিলিয়ে ওদের সংসারে তখন লক্ষ্মী এসে যেন সব নিজ হাতে সাজাতে শুরু করেছে। বিয়ের চার বছর পরে থানা সদরে জায়গা কিনে ওরা একটা বাড়ি করল যাতে করে দু’জনের কর্মক্ষেত্রে যেতে সুবিধা হয়। ছোট্ট হলেও খুব সুন্দর সাজানো গোছানো একটা মনোরম বাড়ি। বাড়ির নাম “ছায়া- বীথি ”।

শুধু বাড়ির নামই নয়, বাড়ির দলিলেও মালিক হিসেবে ছায়া’র নাম খচিত। এতদিনের যা কিছু সঞ্চয় সব বিনিয়োগ করে ভালোবাসার মানুষটির নামে বাড়িটি করতে পারার সুখ সবসময় অয়নের চোখেমুখে ভাসতো। ওঁদের মেয়ের বয়স যখন সবে চার ঠিক তখনই অয়নের জন্য আর এক সুখের খবর হয়ে এলো নতুন এক কলেজের উপাধ্যক্ষ হয়ে যোগদানের নিয়োগপত্র। বাড়ি থেকে অনেক দূরে অবস্থান হওয়ায় প্রথমত একটু দ্বিধা দ্বন্দের দোলাচলে দুললেও শেষ পর্যন্ত সকলের মতামত বিশ্লেষণ সাপেক্ষে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেই ফেলল। এত কম বয়সে উপাধ্যক্ষ হওয়ার লোভটাও যে বেশ ছিল তাও কিন্তু অস্বীকার করার নয়।

প্রথমত বেশ কষ্ট হত ভালোবাসার মানুষটিকে এবং ছোট্ট মেয়েটাকে ছেঁড়ে দূরে থাকতে। তাই প্রতি সপ্তাহেই বাড়িতে ছুটত। কিন্তু নতুন দায়িত্ব পেয়ে কাজে মনযোগী হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেয়নি অয়ন। খুব অল্প দিনেই ওর দ্বায়ীত্বশিলতার এবং দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হল। তবে পাশাপাশি যা হল পরিবারের সাথে একত্রে কাটানোর সময় সংকুচিত হতে লাগলো।

কোন মাসে একবার, কখনো দুই মাসে একবার বাড়িতে যায়। কিন্তু যেহেতু ছায়া’র উপর ওর সম্পূর্ণ ভরসা আছে তাই ও মনে করত ছায়া ঠিক সব সামলে নেবে। বরঞ্চ বাড়িতে ফিরে কখনো মন খারাপ করলে ছায়াই ওঁকে সান্ত্বনা দিতো। এখন এ নিয়ে ওঁদের কারো খুব একটা মন খারাপ হয়না, এমনকি ওঁদের মেয়েরও না। ওঁদের মেয়ের বয়স এখন ১২ বছর, সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ।

ওর ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছায়া’র মা ওঁদের সাথে থাকতো। তাঁর নিজের ছেলের একটা ছেলে হওয়ার পর থেকে তিনি ছেলের কাছে আছেন। অয়নের বাবা মা অনেক আগেই গত হয়েছেন। এই চার বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। ওঁদের সংসারে নতুন অতিথি এসেছে।

ছায়া’র একটা ছেলে হয়েছে কিছুদিন হল। ছেলেটার জন্মের পর থেকেই ছায়া’র আচরনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে যার সুত্রপাত হয়েছিলো ছেলেটার জন্মের প্রায় দু বছর পূর্বে থেকে । অয়ন ওর মেয়ের আচরণেও কিছু একটা পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পেরেছিল, কিন্তু কাছে না থাকায় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। আজ অপ্রত্যাশিতভাবে কোন কিছু না জানিয়ে শুধুমাত্র পরিবারের সকলকে চমকে দেবার জন্য হঠাৎ করে বাড়িতে পৌঁছল, কিন্তু যা দেখল তাতে করে অয়ন নিজেই বিস্মিত হয়ে গেলো। বাড়িতে পৌছতে অয়নের রাত ১১ টা বেজে গেলো।

বাড়িতে ঢুকতেই চিৎকার করে মেয়ের কান্না শুনতে পেলো। ও ঘরে ঢুকতেই সবাই অপ্রস্তুত। সবাই বলতে ছায়া, ওর মেয়ে এবং ছায়া’র অফিসের নৈশপ্রহরী আব্দুল। ছায়া এবং আব্দুল দু’জনে মিলে মেয়েকে মারছে। মেয়ের অপরাধ সে ওষুধ খেতে চাচ্ছেনা।

গিয়ে দেখল ওকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অয়ন কিছুক্ষণের জন্য অনুভুতিশুন্য হয়ে গেলো। কিছুই মাথায় কাজ করছেনা। ভেবে পাচ্ছেনা মেয়েকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর কারন কি আর এত রাতে আব্দুলই বা কেন ওঁদের বাসায় ? আর ওর মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস কি করে হয় আব্দুলের? এতক্ষণে বাবাকে দেখে মেয়ে যেন ডুবতে ডুবতে জীবন তরী খুঁজে পেলো। দৌড়ে এসে বাবার কোলে মাথা গুঁজে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল আর বলতে লাগলো “ বাবা ,আমি আর মার কাছে থাকবনা,তোমার সাথে চলে যাবো।

” বাবা মেয়ের এই আবেগ বিনিময়ের সুযোগে আব্দুল সটকে পরার পায়তারা করতেই অয়ন বলল, “দাঁড়াও ,কোথায় যাচ্ছ ? এত রাতে এখানে কি করছিলে ? আর আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস কোথায় পেলে ?” আব্দুল বলল, “ ম্যাডামের কাছে অফিসের চাবি নিতে এসেছিলাম। ” অয়নের মেয়ে সাথে সাথে বলল “না বাবা, ও মিথ্যে কথা বলছে, ও প্রতিদিন এইসময় আসে। আর ও এলেই মা আমাকে ঘুমাতে বলে। আমি টেলিভিশন দেখি বলে মা আমাকে মারে। আমার কিছুই হয়নি তবুও আমাকে ওষুধ খেতে বলে, না খেলে জোর করে খাওয়ায় আর দু’জনে মিলে আমাকে মারে।

” অয়নের বুঝতে আর কিছু বাকি থাকলোনা। কিন্তু ওর বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে ছায়া ওর সাথে এইরকম......! সবকিছু যেন গোলমাল হয়ে গেলো, ঠাণ্ডা মাথাটা গরম হয়ে গেলো। অয়ন আব্দুলের কলার চেপে ধরে নাকের উপর গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ঘুষি মারতেই ও মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ইচ্ছে মতো লাথি মারতে লাগলো, হাতের কাছে পেয়েছিলো একটা ঝাঁটা তা দিয়েই মারতে শুরু করল। এতক্ষণ ছায়া দাঁড়িয়ে শুধু সব দেখছিল।

হঠাৎ করে অয়নের হাত ধরে বসল। বলল “অনেক হয়েছে, আর একবার যদি ওর গায়ে হাত তুলেছ............। ” অয়ন ছায়া’র দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলো। ছায়া’র এমন চেহারা ও আগে কখনো দেখেনি। মনে হচ্ছিলো ছায়া ওকে ছিড়ে ফেলবে।

ছায়া’র মনোভাব বুঝতে পেরে যে আব্দুল এতক্ষণ পড়ে মার খাচ্ছিল সে উঠে রুখে দাঁড়ালো। অয়ন দু’জনের মুখের দিকে তাকালো, বাধ্য হল বুঝে নিতে অনেক কিছু। আব্দুলকে বলল বের হ আমার বাড়ি থেকে, আর কখনো তোকে যেন না দেখি। ছায়া গর্জে বলে উঠলো, ও কোথাও যাবেনা এখানেই থাকবে। যেতে হলে আমার বাড়ি থেকে তুমিই বেরিয়ে যাও।

অয়নের মাথাটা টন করে উঠলো। ও কি সঠিক শুনছে? ওর মাথাটা যেন আর কাজ করছিলোনা। কিছুক্ষণ অসার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরে ও অনুভুতি ফিরে পেলো। বাড়িটা যে ছায়া’র নামে দলিল করা হয়েছিলো এতক্ষণে মনে পড়ল। পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে চরম সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিল।

এখানে বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন নয় বুঝতে পেরে মেয়েকে ডেকে বলল চল মা তোর ভাইকে নিয়ে আমরা এখান থেকে চলে যাই। এই বলে ও যখন ছেলেকে আনতে যাবে ( অন্য রুমে ঘুমাচ্ছিল)তখন ছায়া পথ আগলে দাঁড়ালো। কোথায় যাচ্ছ? অয়ন বলল, “আমি চলে যাচ্ছি, তবে আমার ছেলে মেয়েদেরকে আমি সাথে করে নিয়ে যাবো। ” “তোমার মেয়েকে তুমি নিয়ে যাও কিন্তু যে ছেলে তোমার নয় তাকে নিয়ে টানাটানি করবেনা। ও তোমার ছেলে নয়, আব্দুলের ছেলে।

” ছায়া’র এই কথা শোনার সাথে সাথে অয়নের পৃথিবীটাকে নরক বলে মনে হতে লাগলো। একটা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করার জন্য যে আঘাত একটিই যথেষ্ট তেমন আঘাত একসাথে এতগুল পেয়ে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে প্রথমত অয়নের উপর আত্মহত্যা করার প্রবনতা ভর করল। কিন্তু শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে জীবিত লাশ হয়ে বেঁচে থাকতে হল। মেয়েকে নিয়ে ঐ রাতেই অয়ন গ্রামে বাবার ভিটায় ফিরে গেলো। এদিকে স্বামীর গড়া বাড়িতেই সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছায়া নতুন সুখের সংসার শুরু করল নিজের অফিসের নৈশ প্রহরী আব্দুলের সাথে।

নতুন এই সুখের নদী খুব বেশি দূর প্রবাহিত হতে পারেনি। ছয় মাস পার না হতেই ছায়া’র উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করল আব্দুল। মাঝে মাঝে মেরে অজ্ঞান করে ফেলত ওকে। ওর অপরাধ বাড়িটা এখনও কেন আব্দুলের নামে লিখে দেওয়া হচ্ছেনা। অনেক চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি, জীবন বাঁচাতে বাড়িটা আব্দুলের নামে দলিল করে দিতেই হল।

মাঝ থেকে ছায়াকে হারাতে হল একটা চোখ এবং একটা পা। আব্দুলের অত্যাচারে একটা চোখ ওর নষ্ট হয়ে গেলো, ডান পা’টা পিটিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে অনেক আগেই যাতে করে ও বাড়ি থেকে বের হতে না পারে। ঠিক উল্টো কাজটা করল যখন বাড়ির দলিলটা নিজের নামে হয়ে গেলো, ছায়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিল আব্দুল। জীবনের তাগিদে জীবিকাটাকে ধরে রেখেছে অনেক কষ্টে। ভাঙ্গা পায়ের ক্ষতটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌছলে যখন ডাক্তারের কাছে গেলো ততক্ষণে গ্যাংরিন বাসা বেঁধেছে।

শেষ পর্যন্ত হাঁটুর কিছুটা উপরে কেটে ফেলতে হয়েছে। এখন হুইল চেয়ার কখনওবা ক্র্যাচ তাঁর চলার সঙ্গী। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের সহানুভূতির পরিবর্তে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকানো তাঁর মনে কতটা অনুশোচনার জন্ম দিয়েছে তা জানা যায়নি, কেননা সমাজের কারো সাথে তাঁর সুখ ,দুঃখের কথা হয়না। অফিসের বাইরে একমাত্র ছেলেকে নিয়েই তাঁর এ জগত। ৫ বছর পর...... ছেলের বয়স ছয় বছর হতে চলেছে, ওকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে গিয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি ছায়া।

ভর্তি ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে কলম আটকে গেলো বাবার নামের ঘরে এসে। অয়নকে একদিন ও অস্বীকার করে যে আব্দুলকে ঐ ছেলের বাবার স্বীকৃতি দিয়েছিলো সেই আব্দুলও বাড়ি থেকে বের করে দেবার সময় ঐ ছেলের পিতৃত্বকে অস্বীকার করেছে(ডি এন এ পরীক্ষা তখন অজানা শব্দ)। যে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে ছায়া আজো বাঁচার স্বপ্ন দেখছে সেই ছেলে বাঁচবে কার আশ্রয়ে? “তাহলে কি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমার ছেলেকে করতে হবে?” আজ ছায়ার মনে এই একটাই প্রশ্ন............... ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.