ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
চায়ে চুমুক দিয়ে রশিদ রিমোট টিপে টিভি অন করে। কাপ নামিয়ে রেখে সিগারেট ধরিয়ে বলে, তাইলে যা, রেডি হইয়া আয়।
আসাদ উঠে দাঁড়ায়, হ যাই।
এখনো সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে আসাদকে। সিঁড়িতে ওঠানামা করতে একটু বেশি কষ্ট হয়।
পায়ের পাতায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দুই রকম গল্প বানিয়ে বলতে হয়েছে। কাজের সবাই জানে, রিক্রিয়েশন সেন্টারে বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে পা মচকে গেছে। কাজের বাইরে সবাইকে বলতে হয়েছে, কাজে একটা ভারী বাক্স পায়ের ওপর পড়েছে। এ বাসার বাইরে কেউ আসল ঘটনা জানে না। বলার মতো কথা নয়।
দিনকয়েক আগে সন্ধ্যায় ক্যারলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি। খাবার টেবিলের তর্ক ঝগড়ায় গড়াতে সময় লাগেনি। ঝগড়াঝাটির সময় ক্যারল খুবই আক্রমণাত্মক ও হিংস্র হয়ে ওঠে, আসাদ জানে। বেশ আগে একবার কিচেনের বড়ো ছুরি নিয়ে আসাদের দিকে তেড়ে গিয়েছিলো। রশিদ ভাই ওপরে নিজের ঘরে ছিলো, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে নেমে আসে।
ক্যারলের কব্জি চেপে ধরে রশিদ ভাই ছুরিটা কেড়ে না নিলে সেদিন কী হতো, কে জানে। তবু ঝগড়ার সময় সেসব আর কে মনে রাখে! আসাদও রাখেনি। এক সময় ক্যারল খাবার টেবিলের কাচের টপটা ঠেলে উল্টে দিলে তা পড়ে আসাদের ডান পায়ের পাতায়।
অসহ্য ব্যথায় মনে হয়েছিলো, তার পায়ের পাতা দু’ফাঁক হয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ে সে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে।
ক্যারলের হুঁশ হয় তখন। আসাদকে জড়িয়ে ধরে মিনিটের মধ্যে এক কোটিবার দুঃখিত হয় সে। সম্ভবত অপরাধবোধের তাড়নায় শুশ্রুষার কথাও মনে আসে না। সেই সময়ে রশিদ কাজ থেকে ফিরে কাণ্ড দেখে হতভম্ব। তারপর দৌড়াও হাসপাতালে।
কাপড় পাল্টে সাবধানে ডান পায়ের ভর বাঁচিয়ে নিচে নামে আসাদ। এই টাউনহাউসে ওপরতলায় দুই বেডরুমের মাঝখানে কমন বাথরুম। মাস্টার বেডরুম আসাদ আর ক্যারলের, অন্যটাতে রশিদ থাকে। নিচে আরেকটা বাথরুম, কিচেন, ডাইনিং স্পেস আর লিভিং রুম। রশিদের চা-সিগারেট তখনো শেষ হয়নি।
আসাদ ফ্রিজ থেকে অরেঞ্জ জুস বের করে ঢালে কাচের গ্লাসে, তার পছন্দের পানীয়।
কিচেন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো চুমুক দেয় আসাদ। রশিদ ভাইয়ের কাছেই টাকা চাইতে হবে। আর কোনো উপায় চোখে পড়ছে না। বন্ধুবান্ধব কারো কাছে বাড়তি টাকা থাকার কথা নয়, সবারই কায়ক্লেশে দিন চলে।
অল্পবিস্তর ধার বন্ধুদের কাছেও আছে, চাওয়া যায় না।
এক হিসেবে টাকা-পয়সায় তারই সবচেয়ে ভালো থাকার কথা। আর সবাইকে লেখাপড়া সামলে পার্ট টাইম কাজ করতে হয়। পড়ার খরচ আছে, তার ওপর আহার-বাসস্থান ও গাড়ির খরচ।
তার স্কুলে হাজিরা দেওয়া নেই, পয়সাও দিতে হয় না।
ফুলটাইম কাজ সে করতে পারে। স্টপ অ্যান্ড গো চেন কনভেনিয়েন্স স্টোরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে তার রোজগারও সবার চেয়ে বেশি।
ক্যারল এক ডাক্তারের মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ঘরে আনা তার টাকার পরিমাণও খারাপ নয়। ক্যারলের অবশ্য হুটহাট চাকরি ছেড়ে দেওয়ার বাতিক আছে, কোনো কাজ তার একটানা বেশিদিন ভালো লাগে না। লম্বা সময় বসেও থাকে না, কীভাবে কেমন করে আরেকটা কাজ খুব তাড়াতাড়ি জুটিয়েও ফেলে।
রশিদ সেভেন ইলেভেনে ক্যাশিয়ার। বাসাভাড়াসহ অন্যসব সাংসারিক খরচ সে আধাআধি দেয়। অথচ দু’জনের রোজগারেও আসাদ তার অর্ধেক সময়মতো গুছিয়ে আনতে হিমশিম খায়। পকেটে থাকা টাকার হিসেবে আসাদই বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে দুঃস্থ। কোনো মানে হয় না।
খেলাধুলায় আসাদ বরাবর ভালো ছিলো - স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় ঢাকা হকি লীগে খেলেছে। টেবিল টেনিসে জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে একবার সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলো। ফুটবল-ক্রিকেটেও অনায়াস দক্ষতা, লীগে খেলার সুযোগও এসে যেতো সময়ে। তার আগেই দেশ ছেড়ে সেসব বিসর্জন দিতে হয়েছে - এখন সুযোগ নেই, চর্চাও না।
এ দেশে এক টেবিল টেনিসই কিছু খেলা হয়, এরা বলে পিং পং, তা-ও কদর কম।
ফিল্ড হকি খেলার চল নেই, এরা খেলে আইস হকি। ক্রিকেটের নামও শোনেনি কেউ। ফুটবলে আগ্রহ মোটে তৈরি হচ্ছে, স্কুলের বাচ্চারা খেলে, নাম সকার। এ দেশে যার নাম ফুটবল, তা একেবারে অন্য জাতের খেলা, উন্মুক্ত ময়দানে দলবদ্ধ কুস্তি।
বিষণœ ও মন খারাপ লাগলে আসাদ মাঝে মাঝে ভাবে, এ দেশে না এলেই হয়তো ভালো হতো।
যেসবে তার দক্ষতা, দেশে সেগুলো সম্বল করেই জ্বলে উঠতে পারতো। কেউ একজন হয়ে উঠে অনেক মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা সম্ভব হতো।
জৌলুসের জীবনযাপন, স্পোর্টস কার, এন্তার ফুর্তি এইসব সম্ভাবনা তাকে টেনে এনেছিলো আমেরিকায়। লেখাপড়া তাকে দিয়ে হবে না, সে জানতো। অথচ গ্লানিময় এই অনুল্লেখ্য অকিঞ্চিৎকর জীবনের ভেতরে সে কী করে যে জড়িয়ে পড়লো!
তার সমস্যা কী একটা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।