গভীর রাতে প্রত্যেকের ঘুমানো উচিৎ বলে আমি এ গলি ও গলি পেরিয়ে একটি দ্বিতল বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হই। বাড়িটি সাদামাটা;যদিও এর অঙ্গসজ্জায় বেশ একটা সপ্রতিভ ভাব দেখা যায়। দিনের বেলায় এ রাস্তা দিয়ে যতবারই হাঁটাচলা করেছি বাড়িটির দিকে ভালো করে তাকাতামও না,সাদামাটা বাড়ির দিকে কে তাকায়!আজ হঠাৎ লক্ষ্য করলাম,রাত ও দিন-যে সময়ই থাকুক না কেন,সদর দরজার পাশে যে বৈদ্যুতিক বাতিটি রয়েছে তা সব সময়ই জ্বলতে থাকে। বাড়িটিতে একজন দাড়োয়ান আছে বলে জানি,তবে সে যে কোন দায়িত্ব পালন করে না, এ থেকে বেশ বুঝা যায়। আমি লোহার গেটে বারকয়েক ধাক্কা দেই।
জোরালো শব্দ হলেও কারো কোন সাড়া পাওয়া যায় না। আবারো কয়েকবার ধাক্কা দেই এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি গেটে লাথি মারতে হবে।
লাথি মারা শুরু হলে প্রথমদিকে কিছু বুঝা যায় না। শুধু দড়াস দড়াস করে খানিকক্ষণ শব্দ হয়। তারপর আধমিনিট যেতে না যেতেই একটি কুকুরের হিংস্র ডাক শোনা যায় আর পর মুহূর্তেই কারো হেঁটে আসার শব্দ পাওয়া যায়।
সম্ভবত কুকুরের ডাকের কারণেই দাড়োয়ানটির ঘুম ভাংগে। মনে মনে কুকুরটিকে ধন্যবাদ জানাই।
অথচ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে প্রথমে কুকুরটিই এসে হাজির হয়। দেখলে খুব একটা হিংস্র মনে হয় না;তবে এর চোখ দুটি বেশ জ্বলজ্বলে। কুকুরটি আমাকে দেখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
সম্ভবত এটি হতভম্ব হয়ে যায় অথবা রাতে এ বাড়িতে নিয়মিত কেউ আসে এবং তার মুখের আদলের সাথে আমার সাদৃশ্য খুঁজতে থাকে। কুকুরটি আমার চারপাশে ঘুরাঘুরি করতে লাগলো পরিচিত গন্ধ পাবার আশায়। খুঁজে না পেয়ে এর হিংস্র ডাক আবারো জোরালো হয়ে উঠে এবং আমাকে ভড়কে যেতে হয়। এর চকচকে দাঁত সম্ভবত মাংস-কাতর হয়ে উঠে। এবার গেটের ভেতর থেকে একটি মুখকে উঁকি দিতে দেখা যায়।
মুখটির গোঁফ কোন এক আদ্যিকালের সম্রাটের মতো;তবে এর মাথায় কোন শিরস্ত্রাণ নেই;তার বদলে একটা বিশাল টাকের উপস্থিতি দেখা যায়। মুখটির গোঁফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুচকুচে কালো ঠোঁটটিকে ভয়ানক মনে হয়। চতুষ্পদী কুকুর আর দ্বিপদী দাড়োয়ান দুটোই একে অন্যের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায়।
কুকুরের প্রতিভূ হলেও দাড়োয়ানটির কন্ঠস্বর খুব কোমল। দাড়োয়ানটি জানতে চায়,
কে আপনি?
-মানুষ।
দাড়োয়ানটি ভড়কায় না। একটা দেঁতো হাসি দিয়ে বলে, একসময় বাউল আছিলাম, তখন নানা কতা বাইর হইত। আপনে যে উত্তর দিছেন, এইরকম উত্তর আমিও দিতাম। মানুষেরে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াইতাম। মজা পাইতাম।
আমি বললাম, আমি আপনাকে হতভম্ব করতে আসি নি।
-তাইলে কেন আইছেন?কার কাছে আইছেন?
-আমি আজকের রাতের জন্য একটি ঘর ভাড়া নিতে চাই।
এবার দাড়োয়ানটি ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তার পুরো শরীর আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর সে আবারো প্রশ্ন করে, কি কইলেন? আমি দ্বিতীয়বার কথাটি বলতেই দাড়োয়ানটির চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠে।
কিন্তু আমার নির্বিকার ভাব দেখে সে ক্রোধান্বিত হতে পারে না;তবে তার কন্ঠস্বর মারাত্নক ঠান্ডা হয়ে যায়। সে বলে, এক রাতের জন্য ভাড়া নিতে চাইলে কোন হোটেলে যান। ভদ্রলোকের বাড়িতে এত রাইতে কি কেউ ভাড়া নিতে আসে?আমি বলি, হোটেলের চেয়ে একটি বাড়ির ছোট একটি ঘর আমার খুবই দরকার। দাড়োয়ানের গলাটি এবার লম্বা হয় এবং আমার আশে পাশে উকিঝুঁকি দৃষ্টি খেলা করে। দাড়োয়ানটি এবার আমার দিকে তাকায়।
আমি দাড়োয়ানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সে বলে, সাথে কী মেয়ে নিয়া আইছেন?
-না।
-তাইলে?
-বুঝতে পারলাম না।
-তাইলে ঘর ভাড়া নিতে চান ক্যান?
-আমার দরকার।
-কি দরকার?
আমি উত্তর দেই না।
কেননা, এর কোন উত্তর আমার কাছে নেই। আমি মিথ্যে বলতে পারি;বলতে পারি যে, আমি গ্রাম থেকে শহরে এসে বিপদে পড়েছি। আমাকে রাতে থাকতে দিন। খুব ভোরে উঠেই চলে যাবো। কিন্তু, আমি জানি, এ অজুহাত তারা গ্রহণ করবে না।
আমি দাড়োয়ানটির দিকে তাকাই। দাড়োয়ানটি আমাকে খুব-পর্যবেক্ষণ করছে। অবশেষে সে বলে,আপনে খুব সম্ভব মদ খইছেন। বাড়িত গিয়া ঘুম দেন গা। সব ঠিক হ’য়া যাইব।
আমি স্বাভাবিক ভংগীতে বলি, আমি মাতাল নই। মদ স্পর্শও করি নি আজ রাতে।
দাড়োয়ানটি গেট বন্ধ করার উপক্রম করে। আমি এবার তাকে বলি,উপরে গিয়ে বলো আজ যার আসার কথা ছিলো সে আসতে পারবে না। তাই আমাকে পাঠিয়েছে
দাড়োয়ানটি সম্ভবত উত্তেজিত হয়ে উঠে।
গেট বন্ধ না করেই সে দৌড়ে উপরে চলে যায়। আমি সন্তর্পনে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ি। কুকুরটি আমাকে অনুসরণ করতে থাকে। কয়েক মিটার। তারপরই তার গলায় বাঁধা লম্বা চেইনে টান পড়ে।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
উপরের দিকে উঠতে গেলেই কারো স্বর ভেসে আসে। স্বরটি কোন এক নারীর উপস্থিতি জানান দেয়। আমি স্বরটি লক্ষ্য করে এগোতে থাকি। কয়েকটি ঘর পার হয়ে যখন স্বর-উৎস-কেন্দ্রের কক্ষে এসে ঢুকি, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দাড়োয়ানটিকে দেখতে পাই।
তারপর দেখতে পাই এক নারীকে। নারীটি দাড়োয়ানকে কিছু বলছে।
আমাকে দেখা মাত্রই নারীটি উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং প্রায় চিৎকার করে উঠে, কে আপনি?
দাড়োয়ান উত্তর দেয়, উনি মানুষ।
আমি একটু হাসার চেষ্টা করি এবং নারীটিকে জানাই যে দাড়োয়ানের কথাটি সত্য। নারীটি এবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকায় এবং জিজ্ঞাসা করে, এক রাতের জন্য আপনি ঘর ভাড়া নিতে চান কেন?
-আমার বিশ্রামের দরকার।
-হোটেলে যান। এ শহরে তো হোটেলের অভাব নেই।
আমি তাকে বলি যে, আমার একটা বাড়ি দরকার। হোটেল নয়। কেননা, হোটলের ঘুমগুলো কৃত্রিম।
আমার একটা সত্যিকারের ঘুম দরকার।
নারীটি সম্ভবত কিছু বুঝতে পারে না। সে আমাকে বলে, আপনি নাকি বলেছিলেন আজ যার আসার কথা ছিল সে আসবে না। তাই আপনাকে পাঠিয়েছে।
-হ্যাঁ।
-আপনি জানেন আজ কার আসার কথা ছিলো?
-না
-বিদেশ থেকে আমার বাবার আসার কথা ছিলো।
-ও।
-তো এবার আপনি যান প্লিজ।
-কিন্তু আমি তো আপনাকে ডিস্টার্ব করতে আসি নি। টাকার বিনিময়ে একটা কক্ষ ভাড়া নিতে এসেছি।
নারীটি এবার ক্রোধোন্মত্ত হয়। সে বলে, আশেপাশে আরো বাড়ি আছে। তাদের কাছে যান। আমি ভাড়া দেবো না।
এবার আমাকে একটি সহজ অজুহাতের আশ্রয় নিতে হয়।
তাকে বলি, তাহলে আমাকে আজকের রাতের জন্য আশ্রয় দিন। বাইরে প্রচন্ড ঝড় উঠেছে।
নারীটি দাড়োয়ানকে ইংগিত দিলে দারোয়ানটি কী করে যেন বুঝতে পারে। সে আমাকে নিচতলায় তার কামরায় নিয়ে যায়। দাড়োয়ানের কক্ষটি বেশ পরিপাটি।
তবে, বিছানার চাদর আর মাথার বালিশ দারূণ নোংরা। আমি দাড়োয়ানকে বলি, আপনি কি মাথায় তেল মাখেন?দাড়োয়ানটির টাক উপর-নিচ হয়। সে কর্কশ কন্ঠে বলে,এইখানে ঘুমান। সকাল হইলে কোনদিকে না তাকায়া সোজা বাইর হইয়া যাইবেন।
আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুমিয়ে পড়ি বলে স্বপ্ন দেখতে থাকি। স্বপ্নে একটি সফেদ নদী দেখতে পাই, নদীর পাড়ে চিকচিকে বালি দেখতে পাই;একদল ছেলে যারা কিনা অবিরাম ছুটছে তাদের মাঝে আমি আমার শৈশবকে দেখতে পাই। তারপর একে একে আমার বন্ধুদের অস্পষ্ট মুখগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে। রমজানের গোল আলু টাইপ চেহারা, বকের মতো সাদা হাসিবের শ্বেত রোগী চেহারা,কাসেমের উন্নাসিক ভাবে দাঁড়ানোর ভঙ্গি,সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। স্পষ্ট ও অস্পষ্ট, ছায়া ও মূর্ত।
এবং স্বপ্নে আমি আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি- আমি আমার নাম ভুলে গেছি। কী নাম আমার?আবুল, রহিম, করিম নাকি অন্য কিছু?আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।
কাসেমকে বলি,কাসেম আমার নাম ধরে ডাক তো।
-কেন?
-এমনি।
-এমনি এমনি তরে ডাকতে পারূম না।
-একবার ডাক।
বন্ধুদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। হাসি যেকোন রোগের থেকে বেশি ছোঁয়াচে, বেশি সংক্রামক। সবাই হাসতে থাকলে আমি ওদের ছেড়ে দূরে চলে যাই। বাড়িতে এসে মাকে বলি, মা আমার নাম ধরে ডাক তো।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মা প্রশ্ন করেন, কেন রে?
-আমি আমার নাম ভুলে গেছি।
উত্তর শুনে মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। আমার মাঝে অশুভ কিছুর আছর দেখতে পায়। তারপর অনেকদিন আমার উপর চেপে থাকে জ্বিনকে তাড়িয়ে বেড়ায় কবিরাজরা। আমার নাম যেন আমি শুনতে না পাই সেজন্য আমার নাম ধরে কেউ ডাকতো না।
জ্বিন চলে গেলে আমি নিজেই আমার নাম বলতে পারবো। স্কুলে ভর্তি হলে আমি কোন এক শিক্ষকের মুখে আমার নামটি শুনতে পাই, কেননা ওই শিক্ষক আমার উপর চেপে বসা জ্বিনটি সমন্ধে জানতেন না। আমি নামটি মুখস্থ করে রাখি। কিন্তু বাড়ি ফেরা মাত্রই নামটি ভুলে যাই।
দুই)
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে নারীটিকে দেখতে পাই।
বাড়ির সামনের বাগানে ফুলের গাছগুলোতে সে পানি দিচ্ছে। আমি উঠে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বলি যে, যাওয়ার আগে তার বাবার সাথে আমার দেখা করা উচিৎ।
নারীটি আমাকে জানায় যে গত রাতে কারো আসার কথা ছিলো না। সে মিথ্যে বলেছে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, কেন মিথ্যে বলেছেন?
নারীটি আচমকা আমার দিকে ঘুরে তাকায়। তারপর বলে, আমাকে তুমি সত্যিই চিনতে পা্রো নি?
-না।
ভালো করে তাকিয়ে দেখো তো।
আমি এবার নারীটির দিকে তাকাই। নারীটিকে আমি চিনি না।
কোথাও দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। তবে, এ বাড়িটি আমি চিনি। কেননা, প্রতিদিনই আমাকে এ সড়ক ধরে চলতে হয়। বাড়িটি সম্বন্ধে কখনো কোন কৌতূহল ছিলো না আমার। এর বাসিন্দাদের সম্বন্ধে তো নয়ই।
আমি নারীটিকে জানাই, তাকে আমি চিনি না।
নারীটি এবার তার শাড়ির আঁচল খুলতে থাকে। পরিস্থিতিটা বিব্রতকর। শেষ অন্তর্বাস খোলা হলে তার উন্মুক্ত সফেদ স্তনে আমি একটি কালো তিল দেখতে পাই এবং সেই সাথে আমার মনে পড়ে যায় এ স্তন আমার খুব পরিচিত,এর অধিকারিণীটিও আমার পরিচিত। আমি আবার নারীটির দিকে তাকাই এবং তার নামটি হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায়।
নারীটি আবারো পূর্ণ বসনা হওয়ার উদ্যোগ নেয়। আমি তীব্রভাবে বলে উঠি, তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি।
প্রতিধ্বনিটি সম্ভবত অনেক দূরে গিয়ে বাজে। তারপর,ধীরে ধীরে,শহরের প্রতিটি দালান কোঠায় কম্পন ধরিয়ে ছুটে আসতে থাকে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।