তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
১৩ জুলাই, ২০০৬
সময়: সন্ধ্যা ৬:০০-৬:৩০
এন.এস.ইউ. ক্যাম্পাস, বনানী
"মহসিন, একটা বেনসন দে!" চায়ের কাপ সামলাতে সামলাতে চিৎকার করে রাজীব। নর্থ সাউথ ক্যাম্পাসের সিগারেট ব্যবসার মনোপলি কায়েম করে রেখেছে মহসিন। ভার্সিটির এমন একটা ধুমপায়ী পাওয়া যাবে না যে মহসীনের খদ্দের নয়। সাতাশ/আঠাশ বছরের ছেলেটার অসাধারন স্মৃতিশক্তি। ওর খদ্দেররা নিয়মিত হলেও সিগারেটের দাম পরিশোধে কেউই নিয়মিত নয়, সব জমা হতে থাকে।
কোন এক সময় মহসিন এসে আস্তে করে জানায়, "এই কয়দিনে দুইশো চাইর টাকা জমা পড়ছে কিন্তুক। টাকা দেন। " এই টাকার হিসাব পুরোটাই থাকে তার মাথায়, সে হিসাবে কখনও একটাকা গড়মিল হয় না।
রাজীব বসে আছে নর্থ সাউথের সামনে শান বাঁধানো পাটাতনে। মহসিন একটু দূরেই দাঁড়িয়ে এক মেয়েকে সিগারেট বিক্রি করছে, রাজীবের দিকে ফিরে তাকাবারো প্রয়োজনও বোধ করলো না।
মেয়েটা মনে হয় নর্থ সাউথে নতুন, আগে কখনও দেখেনি রাজীব। সিগারেটও মনে হয় নতুন ধরেছে, ধোঁয়া মুখের মধ্যে নিয়েই ছেড়ে দিচ্ছে, এক বিন্দুও ভেতরে ঢুকছে না। মহসিন সিগারেট দিয়েও দাঁড়িয়ে আছে... লুইচ্চা একটা,
"ওই মহসিন, কি কানে কথা যায়না না? বিড়ি চাইলাম না?"
মহসিন নিতান্তই অনিচ্ছা নিয়ে কাছে আসে,
"বেনসন না পলমল?"
"ওই ব্যাটা, পলমল খাই আমি? বেনসন দে!"
নতুন ব্র্যান্ড বলে মহসিনের সবাইকে পলমল গছিয়ে দেবার খুব চেষ্টা, লাভটাও মনে হয় পলমলে একটু বেশিই থাকে।
"মহসিন, মেয়েটা কে রে?"
"নতুন আইছে। ক্যান আপনি চিনেন না? ফয়সাল ভাই চিনে তো!"
"নাম কি?"
"ভাবি কই?"
"বেশি সেয়ানা হইছস না? কি জিগাইলাম আর কি উত্তর দিলি? ভাবি কই মানে? কোন ভাবি?"
"তৃণা ভাবি।
ওই যে, ওই দিন নিয়া আইলেন না এইহানে?" দাঁত বের করে হাসে মহসিন।
উত্ড়রে খেঁকিয়ে ওঠে রাজীব, "ওই ব্যাটা, তৃণা ভাবী হইলো ক্যামনে শুনি? আমার সাথে মেয়ে দেখস নাই আগে?"
হাসি মোটেই মলিন হয় না মহসিনের, বলে,
"আরে বস্ কম দেখছি নাকি? কিন্তুক এইটা কইলাম অন্যরকম, আমি বুইঝা ফালাইছি!"
"অন্যরকম মানে?" সিরিয়াস হয়ে যায় রাজীব। ওর মনে এখন সন্দেহ দানা বাঁধছে, ব্যাপারটা কি এতটাই দৃশ্যমান যে দেখলেই বোঝা যায়! ওর সিরিয়াস গলা শুনে উল্টো বুঝলো মহসিন, ভাবলো রাজীবের বুঝি মেজাজ গরম হয়েছে,
"মস্করা করতাছিলাম বস্!" সুড়ুৎ করে কেটে পড়ে ও।
তৃণাকে কখনও নর্থ সাউথে আনতে চায় না রাজীব। অনেক কারন আছে।
এক হলো, রাজীবের সাথে কোন মেয়ে দেখলেই এখন মুখে মুখে নানান গল্প ছড়িয়ে যায়। বন্ধুরা এসে উল্টো-পাল্টো মন্তব্য করে। অন্য মেয়ে হলে এগুলো গায়ে লাগে না ওর, কিন্তু তৃণাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে মাথায় রক্ত উঠে যায়। তার উপর তৃণার রেপুটেশনও তেমন কিছু ভাল নয়। ইন্টারনেট কানেশন আছে কিন্তু ওর ছবি গুলো দেখেনি এমন কাউকে মনে হয়না এই ঢাকায় খুঁজে পাওয়া যাবে।
ছবি গুলো রাজীবও দেখেছে। এমন ছবি হয়তো বিদেশে পারিবারিক অ্যালবামেও রাখা যায়, কিন্তু আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে খুবই, খুবই দৃষ্টিকটু। এমন ছবি তোলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য রাজীবের তৃণার উপর একটা চাপা রাগ আছে। কিন্তু সে রাগটা সে কখনই প্রকাশ করেনি। কোন একদিন কথায় কথায় ছবিগুলোর প্রসঙ্গ চলে আসায় তৃণা জানাতে চেয়েছিল কেন ওই শোতে ও সবার সামনে ওর লং স্কার্টটা ছিঁড়ে মিনি বানিয়ে ফেলেছিল, রাজীব শুনতে চায়নি।
এতদিন পরেও রাজীব নিশ্চত হতে পারে না তৃণার সাথে ওর সম্পর্কটা আসলে কি রকম। শুরু হয়েছিল একরকম ওর অনিচ্ছাতেই, তৃণার জেদের কাছে হার মেনে। সে সময়টাতে পাগলের মত ওকে ফোন করেছে তৃণা, নাম্বার দেখেই সেই ফোন কেটে দিয়েছে রাজীব। কখনও বিরক্ত হয়ে ধরলেই বাচ্চা মেয়ের মত অভিযোগ করেছে তৃণা, দেখা করতে চেয়েছে। সে সব অভিযোগ-অনুরোধও রাজীব এড়িয়ে গেছে কাজের অজুহাতে।
এমন সময় একদিন হঠাৎ তৃণা ওর অফিসে এসে হাজির। নিজের রুমে তৃণাকে দেখে বরফ হয়ে গিয়েছিল ও, অফিসের সবাই দেখলো ভুঁইয়া সাহেবের মেয়ে স্যারের ছোট ছেলের রুমে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ঢুকে পড়েছে। ভাইয়ার হাতে ধরা পড়ে যাবার ভয়েই রাজীব তৃণাকে দেখে এক মূহুর্ত আর সময় নষ্ট করে না, নিজেই ড্রাইভ করে "মুভ অ্যান্ড পিক"এ নিয়ে আসে। আইসক্রিম খেতে খেতে সরাসরি জিজ্ঞাস করে রাজীব,
"কি চাও তুমি আমার কাছে তৃণা?"
মিটিমিটি হাসে মেয়েটা। বলে, "তা তো জানি না! কিন্তু তোমাকে ভাল লাগে আমার।
"
"কেন ভাল লাগে?"
"জানি না। "
কোন ঝুঁকি নিতে চায় না রাজীব, বলে,
"তোমাকে আগেই জানিয়ে দেই তৃণা, বন্ধুত্ব ছাড়া আমার কাছে আর কিছু পাবার আশা থাকলে সেটা এখনই বাদ দিয়ে দাও। আমি কোন ঝানেলায় জড়াতে চাই না। "
খিল খিল করে হেসে উঠে তৃণা,
"আমি জানতাম তুমি ঠিক এ কথাটাই বলবে, রাজীব রহমান! তোমার কাছে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু চাইও না আমি। "
কিন্তু এর পরেও সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যেতে থাকে।
সম্পর্ক নিয়ে ওর মতবাদটা ছিল পরিপাটি, "বিয়ের আগে যা ইচ্ছা নিজের পছন্দে, আর বিয়ের সময় বিয়ে বাবা-মার পছন্দে"। সে মতবাদ ভেঙে চুরমার করেছে তৃণা। যতই দিল গেছে দু'জনের বদ্ধুত্ব গাড় হয়েছে। তৃণার মেয়েটার সাথে অনেক কিছুতেই অনেক মিল রাজীবের, আবার অনেক কিছুতেই অনেক অমিল। সব মিলিয়ে দু'জন দু'জনের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে ওঠে যে ব্যাপারটা দুই পরিবারেও জানাজানি হয়ে যায়।
এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায় যে দু'জনকেই দু'জনের পরিবারকে নিশ্চিত করতে হয় যে ওদের সম্পর্কটা নিপাট বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু নয়।
চিন্তার তাল কেটে যায় জুনিয়র কিছু ছেলের উৎপাতে,
"রাজীব ভাই, চলেন এক দান হয়ে যাক। "
"নাহ্ এখন ইচ্ছা করতেছে না। "
"আরে চলেন না। ডাবলস্ হবে... চ্যালেঞ্জ করলাম যান।
"
চট করে ঘড়ি দেখে নেয় রাজীব, সময় আছে। চায়ের কাপ রেখে টেবিল টেনিস খেলতে বেসমেন্টের দিকে রওনা দেয় ও।
***
১৩ জুলাই, ২০০৬
সময়: বিকাল ৫:০০-৫:৩০
সিমেন্স সেন্টার, গুলশান
"বস্, নওরীন কি করেছে শুনেছেন?"
নওরীনের কথা শুনেই রাগে পিত্তি জ্বলে গেল রানার। নওরীনকে একদমই সহ্য হয় না ওর। মোটা সোটা আই.বি.এ. থেকে পাশ করা মেয়েটা কাজ না জানলে কি হবে, গুটি চালতে এক নাম্বার।
সব সময় এর কথা ওর কাছে লাগাবে, সিনিয়র ভাইয়াদের কাছে কলিগদের নামে নালিশ জানাবে।
এই গত সপ্তাহেই মেয়েটা রানার রুমে এসে আদিখ্যেতার একশেষ করেছে। রানার কাছে বসে নানান অজুহাতে এখানে ওখানে ছুয়ে দেয়, আবার বলতে বলতে হঠাৎই গলা নামিয়ে চোখ বুঁজে মুখ কাছে নিয়ে আসে। পরে জানা যায় প্রজেক্ট ফাইল করতে নাকি রানার সাহায্য লাগবে। এমন অবস্থায় আগে আর পড়েনি রানা, ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে কাজটা করে দিয়েছে।
পরে শুনে সে নাকি সেকশন ম্যানেজার ভাইয়াকে বলেছে রানা ওকে একটুও কোঅপারেট করেনি।
"কি করেছে?"
"গতকাল সুমন ভাইয়াকে বলেছে আমরা নাকি কাজে ফাঁকি দিয়ে সিগারেট খেতে যাই। "
"সিরিয়াস? তাই বলেছে?"
"জ্বী ভাইয়া!"
"সে যে সারাটা সময় ফোনে হা-হা হি-হি করে সেটা কিছু না?"
"বলেন তো দেখি বস্, কেমন লাগে? আপনার কাজ না থাকলে চলেন এইটা নিয়ে আলোচনা আছে। বাকি সবাই ওয়েট করছে বাইরে। "
মনে মনে মেয়েটাকে নিজের জানা সবচেয়ে খারাপ গালিটা দিল রানা, মেয়ে না হলে তোরে বাটি চালান দিতাম মাগী।
ঘড়ি দেখল রানা, আজ এর চেয়ে জরুরী কাজ আছে,
"আজ না। কাল বসি সবাই নাকি? আজ জরুরী কাজ আছে একটা। "
"ওকে বস্! কিন্তু ওকে টাইট দিতে হবে কিন্তু! ছাড়া যাবে না। "
কমপিউটারটা বন্ধ করে রুম থেকে বের হয়ে গেল রানা। সাড়ে পাঁচটায় নিপুন, তমাল আর ফয়সালের সাথে হাসানের দোকানে জরুরী আলাপ আছে।
© অমিত আহমেদ
(চলবে)
গন্দম - পর্ব ১ | গন্দম - পর্ব ২ | গন্দম - পর্ব ৩ | গন্দম - পর্ব ৪ | গন্দম - পর্ব ৫ | গন্দম - পর্ব ৬ | গন্দম - পর্ব ৭.১ | গন্দম - পর্ব ৭.২
বি.দ্র.: "এ গল্পের প্রত্যেকটা চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত বা মৃত কারও সাথে কোন সাদৃশ্য পাওয়া গেলে তা নেহায়তই কাকতালীয় হিসেবে গন্য হবে। "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।