তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
২ মার্চ, ২০০৬
সময়: রাত ৮:২০-১২:৫৫
কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব
পার্টি রুমে ঢুকেই রাজীবের মনে হলো একটা ভুল হয়ে গেছে, আসার পথে বাসা থেকে একটা ব্লেজার তুলে নেয়া উচিত ছিল। পার্টিতে সবাই বেশ ফর্মাল - পুরুষরা পুরোদমে স্যুটেড-ব্যুটেড, মহিলারা সবাই পাল্লা দিয়ে জমকালো শাড়ি। একটু কম বয়সী মেয়েরা অবশ্য স্কার্ট-টপ দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে। সে তুলনায় ডকারস্ ট্রাউজার আর পোলো সার্টে রাজীবকে বেশ ম্রিয়মানই বলা যায়।
পোষাকের চিন্তা বাদ দিয়ে পার্টিতে ঢুকে গেল ও।
যা হবার হয়েছে, এখন সবার আগে ভুঁইয়া সাহেবের সাথে আগে দেখা করে জানান দিতে হবে যে সে পার্টিতে এসেছে। ঢুকতেই সাদা-কালো ঊর্দি পরা বেয়ারা পাশে এসে দাঁড়ালো ওর,
"স্যার, শ্যাম্পেন?"
একটা গ্লাস তুলে নিয়ে চারপাশে তাকালো রাজীব, পানীয়ের ব্যবস্থা থাকবে সেটা নিমন্ত্রণপত্র দেখেই বোঝা গেছে, সঙ্গত কারনেই পার্টিতে অপরিনত কাউকে দেখা যাচ্ছে না... লোকজনও তেমন বেশী নয়, সব মিলিয়ে প্রায় দু'-আড়াইশো। ভুঁইয়া সাহেব সম্ভবত খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে নিমন্ত্রণ করেননি।
একটু পরেই ভুল ভাঙলো রাজীবের, কাছের মানুষ নয় তিনি নিমন্ত্রণ করেছেন সব গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতেই দুই মন্ত্রী, এক উপমন্ত্রীকে দেখে ফেলল ও।
বাকি সবাই স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। রাজীবের প্রায় সবার সাথেই কম বেশী পরিচয় আছে। তাঁরা এখনও রাজীবকে রহমান সাহেবের ছোট ছেলে হিসেবেই দেখেন, তিস্তা গ্রুপের এক্সিকিউটিভ হিসেবে নয়। এরকম পার্টিতে যা হয়, সবাই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। এমন একটা গ্রুপে ঢুকতেই ভুঁইয়া সাহেবের দেখা পেল ও।
রাজীবকে দূর থেকে দেখেই চিনে ফেললেন তিনি, হেসে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন,
"তৃতীয় রহমান, ঠিক তো?"
"জ্বী, স্লামালেকুম" হেসে হাত বাড়ালো রাজীবও, "আমার নাম রাজীব। " বয়স প্রায় সাতান্ন হলে কি হবে ভদ্রলোকের পাঞ্জার জোর আছে। চেহারা দেখে অবশ্য পঞ্চাশের উপরে বলার যো নেই। শ্যাম বর্ণ, টানটান ছয় ফিট লম্বা, টেইলর্ড ছাইবর্ণ স্যুটে চমৎকার মানিয়ে গেছেন।
"চমৎকার, তাও তো কোন এক রহমানের দেখা মিলল আমার পার্টিতে।
তা হাজী সাহেব আছেন কেমন?"
ভাইয়া ব্যবসায় বসার পর থেকে অবসরের সুযোগে প্রায় নিয়মিতই হজ্জ্বে যাচ্ছেন বাবা-মা। তাই মজা করে অনেকেই হাজী সাহেব ডাকা শুরু করেছেন বাবাকে।
"জ্বী ভাল। আপনাকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাবা-মা আর ভাইয়া। "
"আর বিবাহবার্ষিকী! এসব পার্টি আমার কাছে একদমই ছেলেমানুষী লাগে, কেবল তৃণার চাপাচাপিতে পার্টিটা দিতে হলো।
"
হাসলো রাজীব। এসব টুকটাক পারিবারিক আলাপে তেমন স্বাচ্ছন্দবোধ করে না ও তাই সরাসরি কাজের কথায় চলে গেল, "আঙ্কেল, মার্সেল কি এসেছে!"
"আসেনি মানে! ডিনার সার্ভ করার আগেই সে অর্ধ-মাতাল হয়ে বসে আছে। তবে জার্মান তো, জাতে মাতাল হলেও ওরা তালে একদম ঠিক। দেখবে মিটিংয়ে একটা আঙ্গুল পর্যন্ত কাঁপবে না। "
"মিটিংটা হবে কখন?"
ওর পিঠে গুরুজনের মত হাত রাখলেন ভুঁইয়া সাহেব, "আরে হবে হবে... এত তাড়াহুড়ার কি আছে! রাত তো সবে সাড়ে আটটা।
ডিনার সার্ভ করা হোক, ভীড়টা একটু হালকা হোক, এরপরে। তুমি পার্টি এনজয় করো, মিটিং এর সময় হলে তোমার কাছে ঠিকই খবর চলে যাবে। "
"জ্বী, আঙ্কেল!"
"তোমার জন্য একটু সমস্যাই হয়ে গেছে তাই না? সব বুড়ো ব্যবসায়ীদের ভীড়ে?" হেসে বললেন ভুঁইয়া সাহেব, "কি করবে বল, ব্যবসায় ঢুকে পড়েছ, এখন এগুলো তো সহ্য করতেই হবে!"
"জ্বী, আঙ্কেল!"
"তবে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি অন্য রহমানদের চেয়ে একটু আলাদা তাই না?" রাজীবের বাম হাতে ধরা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন ভুঁইয়া সাহেব। ইঙ্গিতটা বুঝে মুচকি হাসলো রাজীব।
"তোমার আন্টির সাথে পরিচয় হয়েছে?"
"জ্বী না"
"বল কি! যার সাথে আমার হাজতবাসের রজতজয়ন্তী তার সাথেই পরিচয় হয়নি? এ তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ! চল চল আগে পরিচয় পর্বটা সারা যাক। " রাজীবের বাহু ধরে অন্য একটা গ্রুপের দিকে নিয়ে চললেন ভুঁইয়া সাহেব।
***
পার্টি থেকে কোন মতে পালিয়ে প্যাটিওতে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো রাজীব। ভেতরে ওকে নিয়ে "ওমা", "এ তো বাচ্চা" এসব বলে আদিখ্যেতার একশেষ হয়েছে, বিশেষ করে মহিলা মহলে। মাত্র পঁচিশ বছরের একটা ছেলে মিটিং করতে এসেছে এটা নিয়েই সবাই আপ্লুত।
এদিকে মিসেস ভুঁইয়ার আফসোস কেন তাঁদের কোন ছেলে নেই। থাকলে এত বড় ব্যাবসা ভুঁইয়া সাহেবকে একা টেনে নিয়ে যেতে হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর। এছাড়া এ ধরনের পার্টি গুলোতে ও ঠিক স্বাচ্ছন্দ বোধ করেনা। বাবা-মার সামনে ছেলে-মেয়ে ড্রিংক করছে এটা ওর পারিবারিক সংস্কারের সাথে ঠিক খাপ খায় না।
বাবা-মা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ভাইয়া নিয়মিত না হলেও চেষ্টা করেন ঠিকই। রহমান পরিবারে মদ-সিগারেটের মত বদঅভ্যাস গুলো ঢুকেছে ওর মাধ্যমেই। ভুঁইয়া সাহেব তখন সে ইঙ্গিতই করছিলেন। বাব-মার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই ওর বদ অভ্যাস গুলো নিয়ে, জানলে বাসায় ঠাঁই হবে না ওর।
পার্টি এখন বেশ জমে গেছে। এক দিকে হাউজি খেলা চলছে, অন্য দিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে চলছে জে.এম.বি. আর শায়খ রহমানের গ্রেফতার নিয়ে চরম আড্ডা। জাদুকর জুয়েল আইচ সাহেবও আজকে আমন্ত্রিত, উনি এক পাশে মহিলাদেরকে হাতসাফাইয়ের খেলা দেখাচ্ছেন। একটু কম বয়সীরা সবাই মাঠে এসে বসেছে, গীটার বাজিয়ে গান হচ্ছে সেখানে।
মার্সেলের সাথে একটু আগেই দেখা হয়েছে ওর।
ভুঁইয়া সাহেব ঠিকই বলেছিলেন, ওয়েল ট্যাঙ্কারের মত লোকটা লিকার গিলেই চলেছে। ঘড়ি দেখলো রাজীব, সাড়ে দশটা বেজে গেছে। মিটিংটা হবে কখন কে জানে। একটা সিগারেট ধরাতেই গলা ভেজাবার তাগিদ বোধ হলো রাজীবের... বেরুবার সময় কিছু একটা নিয়ে বেরুনো দরকার ছিল।
প্যাটিও থেকে ছেলেমেয়েদের গিটারের সাথে নাচ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
পার্টিটা অন্য কারও হলে রাজীবও ওখানেই থাকত। ওর মেয়েঘেঁষা দূর্নামটা এমনি এমনি ছড়ায়নি। ওর চেষ্টাই থাকে খুঁতহীণ চেহারাটা (মাঝে মাঝে ক্রেডিটকার্ড) ব্যবহার করে মোবাইলে মেয়েদের নাম্বারের সংখ্যা বাড়নো। তবে একটা নীতি ও সব সময় মেনে চলে সেটা হলো কারও সাথে কখন কমিটমেন্ট যাওয়া নয়, কেউ চাইলেও সে আস্তে করে সরে পড়ে।
"বিয়ার?"
হঠাৎ প্রশ্নে চমকে গেল রাজীব।
জিনস্-টপ পরা হ্যাংলা-পাতলা একটা মেয়ে হাতে দু'টো বিয়ারের ক্যান ধরে আছে। মেয়েটার চেহারাটা খুব পরিচিত মনে হলো ওর কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে করতে পারলো না ও।
"অবশ্যই!" ক্যানটা নিতে নিতে বলল রাজীব, "সত্যি কথা বলতে কি, এখন একটা বিয়ারের অভাবই অনুভব করছিলাম। "
খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটা, "তুমি তো খুব মজার বাংলা বল, 'অনুভব করছিলাম'... হোয়াট ড্যাজ দ্যট ইভেন মিন?"
উত্তর না দিয়ে হাসলো রাজীব।
"শোন, আমার নাম তৃণা।
তোমার নাম কি?" প্রশ্নটা আসলো ইংরেজীতে। এই একটা নতুন ফ্যাশন হয়েছে, বাবা-মা ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবেন আর ছেলে-মেয়েরা দিব্যি বাংলা ভুলে ইংরেজীর আরাধণা শুরু করবে। বাবা-মার কাছে অনেক ঋণী রাজীব যে এই গড্ডালিকা স্রোতে তাঁরা গা ভাসাননি। রাজীব নিঃশ্চিত যে বাংলা ভাল না জানলে কি হবে, হিন্দি গানের কথা লাইন ধরে ঠিকই মুখস্ত এই মেয়ের।
"আমার নাম রাজীব।
তুমি তো ভুঁইয়া সাহেবের মেয়ে, তাই না?" মেয়েটার চেহারা এত পরিচিত লাগছিল কেন সেটা এখন ধরতে পেরেছে ও। তৃণার চেহারা একদম ওর মা, মিসেস ভুঁইয়ার মত! মিসেস ভুঁইয়াকে কম-বেশী ওর মার মতই লেগেছে রাজীবের, ঘরমুখী। স্বামী-সন্তানের গতিশীলতার সাথে তাল মেলাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে ক্লান্ত।
"ইয়াপ, আমার বাবা। তুমি ব্যস্ত? আমাদের সাথে বসবে ওখানে?" হাত তুলে প্যাটিওর পেছনের দিকটা দেখাল তৃণা।
সেখানে আরও দু'টো মেয়ে আর একটা ছেলে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। হাসল রাজীব, ঘটনা এখন পরিষ্কার হলো। তৃণা এখন ওকে ওর বন্ধুদের কাছে নিয়ে যাবে। বন্ধুরা ওকে ওই সব প্রশ্ন জিজ্ঞাস করবে যেগুলো তৃণার জিজ্ঞাস করতে বাধবে। এর পর যা হবার আপনা আপনি হবে, শেষমেষ চিরন্তন ফোন নাম্বার বিনিময়।
কিন্তু এখন রাজীবের মোটেই ইচ্ছে নেই ভুঁইয়া সাহেবের মেয়ের সাথে কিছু করার - ঝামেলা হয়ে যাবে। কিভাবে সুন্দর করে "না" বলা যায় ভাবছে রাজীব, সে সময় চিন্তা থেকে মুক্তি দিল উর্দি পরা পরিচিত বেয়ারা, এগিয়ে এসে মুখ কানের কাছে এনে বলল,
"স্যার, ভুঁইয়া সাহেব মিটিংয়ে বসেছেন। "
"আচ্ছা, তুমি একটু আমার ড্রাইভারকে বলো আমার ব্রীফকেসটা নিয়ে আসতে, ঠিক আছে?"
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে সরে গেল বেয়ারা। তৃণার দিকে ফিরে বলল রাজীব,
"পরিচিত হয়ে খুব ভাল লাগলো তৃণা, বাট নাউ আই রিয়েলি হ্যাভ টু গো!"
© অমিত আহমেদ
(চলবে)
গন্দম - পর্ব ১ | গন্দম - পর্ব ২ | গন্দম - পর্ব ৩ | গন্দম - পর্ব ৪ | গন্দম - পর্ব ৫ | গন্দম - পর্ব ৬
বি.দ্র.
(১) ৭ম পর্ব বেশী বড় হয়ে যাওয়ায় দুই ভাগে ভাগ করা হলো।
(২) যেহেতু এখন গল্প বাংলাদেশের পটভুমিকায় আমার একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে দেয়া উচিৎ, "এ গল্পের প্রত্যেকটা চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত বা মৃত কারও সাথে কোন সাদৃশ্য পাওয়া গেলে তা নেহায়তই কাকতালীয় হিসেবে গন্য হবে।
"
ধন্যবাদ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।