আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের ‍"‍‌‌‍‍অন্তঃপুরে অনন্তের আলো" ও বাংলা সাহিত্য

সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...

কবিতা বিক্ষুব্ধ মানুষের মনের ও প্রাণের কথা। সংগ্রামী আর বিপ্লবী জীবন ছন্দময়। ছন্দ ছাড়া মুক্তির শ্লোগান হতে পারে না। কবিতা জীবন ও শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার, রাজপথে বিক্ষুভ মিছিল-বিদ্রোহ-অভ্যুত্থান আর বিপ্লবে মানুষের মুক্তির শ্লোগান আর জয়ধ্বনি। কবিতা মানুষের অধিকার আদায়ের ছন্দ।

কবিতা দুবৃত্তায়িত সব অন্ধকার সভ্যতার আবর্জনা শোষক-লুটেরা অপশক্তির বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার। কবিতা পথ দেখায় মানুষের মুক্তি ও অনাগত সুন্দর দিনগুলোর। একজন কবি গণ মানুষের সুখ, দুঃখ, ভালো, মন্দ, প্রেম-বিরহ, সঙ্গতি-অসঙ্গতি, প্রকৃতি-পরিবেশ, রাজনীতি-অর্থনীতি-দর্শন-দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তার চিন্তা চেতনায় শব্দের শৈল্পিক বুননে রচনা করেন কবিতা। আর তাই অজস্র কবিতা হয়ে উঠেছে অসংখ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আসল কথা। কবিতা সাহিত্যের একটি অন্যতম শিল্প।

হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য। সাহিত্য হচ্ছে গণ মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে সংগৃহীত আলোর পৃথিবী। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন অজস্র কবি, লেখক ও গল্পকার। সময় ও নদীর স্রোত যেমন বয়ে যায়, তেমনি সাহিত্যও সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলে। এভাবেই সাহিত্যের বিকাশ।

হাজার বছর আগে বাংলা ভাষাটিও অন্য রকম ছিল, তা পরিবর্তিত হতে হতে আজকের রূপ নিয়েছে। হাজার বছর আগে সাহিত্যও আজকের মতো ছিল না। সময় এগিয়ে গেছে সাহিত্যের জগতে এসেছে নতুন নতুন নিয়ম ও রূপ। বাংলা সাহিত্যের প্রথম বইটির নাম ‘চর্যাপদ’। এটি রচিত হয়েছিল ১০ম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে।

এর কবিতাগুলো ছোটো ছোটো, এতে কবিদের মনের কথা প্রকাশ পেয়েছে। এরপরে যুগেযুগে কবিরা সৃষ্টি করে গেছেন বাংলা কবিতা বা সাহিত্য। সাহিত্যে দুটি ভাগের একটি হলো কবিতা, অন্যটি হলো গদ্য। যে গদ্যে লেখা হয় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটকসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়। বাংলা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ হলো কবিতা, ১৮০০ সালের আগে বাংলা সাহিত্যে কোন গদ্য ছিলো না।

এতোদিন ধরে রচিত হয়েছে কেবল কবিতা, কবিতায় লেখা হয়েছে বড়ো বড়ো কাহিনী, যা আজ হলে অবশ্যই গদ্যে লেখা হতো। মনের কথা থেকে শুরু করে জুতু সেলাইয়ের সকল কথা ছন্দে ছন্দে লেখা হয়েছে। সব সাহিত্যেই প্রথম পর্যায়ের ইতিহাস এমনই ছিল। বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের একটি কথা স্মরণ রাখা উচিত যে, এ সাহিত্য জন্ম থেকেই ভীষণ বিদ্রোহী, এর ভেতরে সারাণ জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। কেনো এই বিদ্রোহের আগুন? বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোকের কাছে সহজে মর্যাদা পায় নি।

এর জন্মকালে একে সহ্য করতে হয়েছে উচ্চশ্রেণীর অত্যাচার, উৎপীড়ন। ১০ম শতকে যখন বাংলা সাহিত্য জন্ম নিচ্ছিল তখন সংস্ড়্গৃত ছিলো সমাজের উচ্চশ্রেণীর ভাষা, তারা সংস্ড়্গৃতের চর্চা করতো। ঠিক তখনি সংগোপনে সাধারণ মানুষের মধ্যে জেগে উঠছিলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, সাধারণ জনগণ একে লালন পালন করেছে বহুদিন। সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোকেরা সর্বদাই সুবিধাবাদী, যেখানে সুবিধা সেখানে তারা। তাই জন্মের সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তাদের ভালবাসা পায় নি, পেয়েছে অত্যাচার, তারপরে মুসলমান আমলে এ উচ্চশ্রেণী সংস্ড়্গৃতের বদলে সেবা করেছে ফারসির, ঔপনিবেশিক ইংরেজ রাজত্বে তারা আঁকড়ে ধরেছে ইংরেজিকে।

অথচ এরা ছিল এদেশেরই লোক। তবে বাংলা ভাষা প্রচন্ড বিদ্রোহী, সে অত্যাচারকে পরোয়া করেনি; বাংলা ভাষা সাধারণ মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। সাধারণ মানুষের বুকের মধ্যে বাংলা ভাষা অগ্নিশিখার মতো জ্বলেছে। সাধারণ মানুষ একে নিজের রক্তের চেয়েও প্রিয় করে নিয়েছে, এবং একে ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রতিষ্ঠার অভিযানে। এর ফলে ভীত হয়েছে উচ্চশ্রেণী, এবং সকল কিছুকে পরাজিত করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।

সাম্প্রতিককালে মূল্যবোধের অবয়ের পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা ও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক নেতিবাচক উত্তেজনায় অনেকেই মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করে স্রেফ ভোগবাদী কলুষতার দিকে ক্রমশঃ ধাবমান। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সামগ্রিক পারিপার্শ্বিক এ অনুসঙ্গটি মানবসমাজ ও সভ্যতার বিকাশে ইতিবাচক মূল্যবোধভিত্তিক গুণগত কর্মকান্ড থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরিয়ে রাখছে অধিকাংশ মানুষকে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের পশ্চিমা দর্শন, আকাশ সংস্ড়্গৃতির ভোগবাদী ব্যক্তিকেন্দ্রীক মিথষ্ত্রিßয়া ঐতিহ্যসম্পন্ন মানবিকবোধের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারা শক্তিশালী হয়েছে। এর বিপরিত স্রোতে দাঁড়িয়ে কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন জীবনের জন্য কবিতা। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন-অবহেলার শিকার জীবনের চালচিত্র গভীর পর্যবেণ ও অনুভবে তিনি ব্যক্ত করেছেন প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পঙতিতে।

গভীর মানবিকবোধসম্পন্ন সংবেদনশীল কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচায। শিকতার পাশাপাশি তিনি হাতের কাছে কাগজ-কলম পেলেই লেখাজোঁকা শুরু করেন। শব্দের পর শব্দের গাঁথুনি, অতঃপর অন্তমিলের চেষ্টা। কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য কবিতা লিখে চলেছেন অবিরত। তাঁর অন্তর্গত দায়বোধ থেকে তিনি লিখে চলেছেন।

মানুষ ও মানবতা, প্রকৃতি ও প্রেমের চিরায়ত ঘটনাবলী যখন তাঁর ভেতরকার জগতকে আন্দোলিত ও প্রতিবাদী করে তখন তিনি নিরবে নিভৃতে লিখেন। তিনি নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, বলা যায় এক প্রকার প্রচারবিমূখ প্রবীণ কবি। তারপর দীর্ঘ সময় নিরবে চলে যায় তাঁর সৃষ্টির আনন্দ স্রোতে। এখন তিনি প্রকাশ্যেই সৃষ্টি ও সুন্দরের পূজারী। নিজের সৃষ্টিময় ব্যঞ্জনা পৌছে দিতে চান সবার মাঝে, সবার প্রাণে।

তিনি বেঁচে থাকতে চান তাঁর রচিত কবিতায়। আর তারই ফসল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ ‘অন্তôঃপুরে অনন্তেôর আলো’। কবিতা ঃ জানালা খুলে দাও, প্রথম দেখা, সময়ের দেয়াল, দুটি চোখ, মিলনের উৎস সন্ধানে, মাঙ্গলিকতার তর্পণ, স্তôব, মধ্যরাতের সিম্ফনি, পোড়োবাড়ি, মুখোমুখি, কালান্তôর, ছবি, প্রেম, প্রত্যাশা, সময়ের বিষদাঁত, অলিগলি ১, শ্রীমঙ্গল, জীবন সংহিতা ১, জীবন সংহিতা ২, জীবন সংহিতা ৩, জীবন সংহিতা ৪, জীবন সংহিতা ৫, জীবন সংহিতা ৬, একসূত্রে, চাবুক, সোনালি সৈকতে, সময়ের সংলাপ, বিষাদের নোনাজলে কুশল জিজ্ঞাসা, এই জনপদে, সংগ্রামী অমর সত্তাকে, সময়ের বিলাপ ১, সময়ের বিলাপ ২, একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, এই গৃহ, বৃত্তাবদ্ধ, অন্তôঃপুরে অনন্তেôর আলো, যৌতুক, ঋণশোধ, একচিলতে আলো, পরিচয়, তাকে ডেকে দাও, প্রতি তিরোধানে, দুর্গম পথে, প্রতীক, একখন্ড মানচিত্র, স্বাধীনতা, শ্রীমঙ্গলের সকাল, প্রস্থান, প্রতীা, অমৃতের সন্ধানে, শোভাযাত্রা। কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য এ যাবৎ অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। মানুষের যাপিত জীবন, দৃঢ় প্রত্যয়ে বিwেভহীন মুক্তি, খন্ড খন্ড সুখ-দুঃখের অনুভূতি, চেপে রাখা অসহনীয় কষ্টের প্রহর, অকল্যাণের রক্তধারা, মুক্ত পাখির গান, য়ে যাওয়া শৃঙ্খলিত জীবন, গাঢ় প্রত্যয়, অনন্তô আকাশ, দূরন্তô আহবান, বিস্তৃত বাঙময় স্মৃতি, সত্তার মুক্তি, রক্তের হোলি খেলা, নত্রের পতন, বিড়ম্বিত জীবন, ক্রোধ-আক্রোশে মন্থর জীবন, নিঃশেষে হা-হুতাশ, আর্তনাদ, করুণ বিলাপ, রাহুমুক্ত জীবনের জন্য মিছিল, জীবনের গান গেয়ে ছবি আঁকা, জীবন সংগ্রাম, অতৃপ্ত জীবন, নিস্ফল প্রত্যাশা, দুমড়ানো হßদয় মুখরিত স্মৃতির দুর্নিবার আকর্ষণ, মোহগ্রস্তô জীবনের রঙিন প্রহর, চাপা বিস্ময়, জর্জরিত অনুরাগ বিষন্নতা, উদ্বেলিত স্বপ্নের প্লাবন, তিক্ত লোনাপানিতে ভেসে চলা সিক্ত স্বপ্ন জগত, অনন্তô বাণী, বিশীর্ণ বৃ, পুষ্টিহীন চোখ, বেদনার নীল দংশন, অবিনাশী উত্তাপ, আলোহীন সংসার, দুঃসহ করমর্দন, পৈশাচিক উল্লাস, বিপরীত স্রোত, কুটিল নিষ্ঠুরতা, নির্বাসনে মাঙ্গলিকতার সব শুদ্ধ উচ্চারণরণ, শ্রেয়শীল চৈতন্য, দৈত্যের ছোবল, যুগান্তôরের সাধনা, অজস্র প্রাণপাত, মানবিক বন্দনা, অজ্ঞানতার কাঁচঘর, অঙ্গীকার, ন্যায়নিষ্ঠ চিন্তôার নিপুণতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিভাষণ, ছন্দময় জীবনের কুশলতা, অন্ধকারে পথচলা নির্ভীক, ঘনীভূত সংকট, জীর্ণ প্রহর, করুণ আর্তনাদ, জীবনের তিক্ততা, বিশীর্ণ অভিশাপ, জীবনের দীপ্ত প্রহর, সুপ্ত জাগরণ, দীপ্র হßদয়, বিষন্ন জীবন, ছক বাধা ধূসর জীবন, নির্মম পৌঢ়ত্ব, আশা নিরাশাসহ সামগ্রিক জীবনবোধেরই নানা সঙ্গতি-অসঙ্গতি প্রকাশ পেয়েছে কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখায়।

এই বোধগুলো যদি কারও প্রাণে গভীরভাবে রেখাপাত করে যা তাঁর লেখা কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে, তাহলেই তাঁর শ্রম সার্থক হবে বলে মনে করছি। নানান বিষয়ে কবিতা লিখেছেন তিনি। মানুষের মনোভূবনে জেগে উঠা সূক্ষ্ম তরঙ্গসমূহ স্থূল বাস্তবের পাথরে আছড়ে পড়ে তখন নানান রঙ আর রেখার যে ব্যাখ্যা ও বর্ণনাতীত দৃশ্যপুঞ্জের ণভঙ্গুর অস্তিত্ব দেখা দিতে না দিতেই মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে যেতে থাকে সেই দৃশ্য ঘটনার ওপরে নির্ভর করেই কবিতা রচিত হয়। ব্যথা ও বেদনা যেখানে স্বাভাবিক সেখানে তার প্রকাশও তো সরল অনাড়ম্বর হওয়াই বাঞ্চনীয়। কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচায এক্ষেত্রে বাঞ্চনীয় নৈপুন্যই দেখিয়েছেন।

‘প্রকাশ হচ্ছে বিকাশের সাধারণ নিয়ম। প্রকাশের সেই কর্মই পালন করে সৃষ্টিশীল মানুষেরা। আমরাও চাই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে আলোকিত করতে। তাঁর লেখা নান্দনিক দাবি মেটাচ্ছে কিনা- সেটা বড় কথা নয়- তিনি যে সাধারণের সংগ্রাম, বুদ্ধির মুক্তি ও হßদয় পথের যাত্রী, সেখানেই তাঁর গৌরব। কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যকে অভিনন্দন।

কবির আত্মচেতনা যখন প্রতিবাদ-সংগ্রাম-শ্লোগান ও অন্তর্লীন মননের ভাবরসে নিমগ্ন, তখন কবিতা প্রজাপতি হয় আপন মাধুর্যে। একান্ত ব্যক্তিক জীবনানুভুতি যখন জীবন-সংগ্রাম, বিস্ময় ও সৌন্দর্যের সুতীব্র রেখায় অঙ্কিত, তখন জন্ম কবিতার। জগৎ ও জীবনের অসামান্য সান্নিধ্যলব্ধ কবির অভিজ্ঞতায় মূর্ত করে তোলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চিরায়ত মুক্তি। অন্তরঙ্গ নিগূঢ় কাব্যময়তা কবিকে দান করে ব্যঞ্জনার অনুসঙ্গ। কবিসত্তার স্বভাবসিদ্ধ সৌরভ শব্দের পর শব্দের গাথুনির মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে একেকটি অন্তর্চেতনার প্রতিচ্ছবি।

প্রতিবাদী সৌন্দর্যের আলোকিত হাওয়ায় উড্ডীন হয়ে তা যেন একটি বস্তুগত রূপ পায়। কাল পরিক্রমায় একটু একটু করে দাসত্ব থেকে যদিও মুক্তি পেল মানুষ কিন্তু তাতে রয়ে গেল ধর্ম। হয়তো এজন্যই তা বুঝি, কবির ভাবনা থেকে ব্যক্তি ভাবনায় নিয়ত স্পর্শ ফেলা একঝাঁক শব্দ গাথুনি। কবিতায় ছন্দ, সঙ্কেত ও প্রতীকের যে লীলা তা কখনোই দুর্বিশ্লেষ্য নয়। এইসব আপাতঃ জটিলতার নেপথ্যে শব্দের মর্মে কাজ করে সমাজ, দেশ, কাল।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র বড়ই বিড়ম্বনাময়-অসঙ্গতিপূর্ণ ও দ্বান্দ্বিক। কথাটা মনের গভীর থেকে উচ্চারিত কয়েকটি শব্দমালা মাত্র নয়। আমাদের সমাজব্যবস্থার একটি পুরাতন কথা। কালে কালে সমাজ গুণগতভাবে পরিবর্তিত হয়েছে বটে কিন্তু জীবন-যাপনের মানসিকতায় অনেকটা সামন্তôীয়ই রয়ে গেছে। আমাদের মধ্যে অনেকেরই মানসিকতা এখনো মফস্বলকেন্দ্রীক আড়ষ্ট ও জরাজীর্ণ।

সমাজে প্রতিবাদী, শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন সংগ্রামী ও সৃষ্টিশীল নির্মল কাজের, ভাল কাজের মূল্যায়ন কম। খুবই কম। ভাল কাজের মর্যাদা কেউ কাউকে দিতে চায় না। ভেতরে ভেতরে অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়। হিংসায় নিজেকে দগ্ধতার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

গঠনমূলক সমালোচনা করলে অনেকেই তীব্র ছিদ্রান্বেষণের নগ্ন সমালোচনায় নিজেকে আরো তথাকথিত করে। মফস্বলকেন্দ্রীক হীনতা, পরশ্রীকাতরতা আর তীব্র ছিদ্রান্বেষণের অভ্যন্তর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা একজন সৃষ্টিশীল প্রবীণ ব্যক্তিত্বের নাম কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য। কবি প্রফেসর নৃপেন্দ্রলাল দাশ বহু আগেই তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটিতে লিখেছেন, ‘কবিতা আমাকে ত্রোধিকারী সম্রাট করে দিয়েছে। দিয়েছে একাকীত্বের নায়কত্ব। সেই একাকীত্ব মানুষকে, সমাজকে অস্বীকার করে নয় বরং সবাইকে স্বীকার করেই তার যাত্রা।

’ কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থও কি এ কথাই বলছে? চারপাশের মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়েই তাঁর কাজ। তাঁর কবিতায় কাব্যরস বা ছন্দ যুক্ত হয়েছে বলে তাঁকে কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কবির কী ভিন্নতা বলে কিছু থাকে? সহজ, সরল আর নির্মল ভাষায় সাহিত্য রচনা করে চলেছেন তিনি। মননের শাব্দিক কলতান দিয়ে লিখছেন নিজের সবকথা। সমাজের সবকথা।

তিনি নিজেকে সমর্পণ করতে চান সৃষ্টিশীলতার কাছে। তিনি একান্তভাবে ভালোবাসেন স্বদেশ, জনগণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও স্বকালকে। কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য একদিন খুঁজে পাবেন তাঁর মননে যিনি বাঁশি বাজান তাঁকে। তিনি মানুষের জন্যে যে সংগ্রাম আর আবেগের চাষ করে চলেছেন- সেখানে তাঁর কবিতা সাহিত্যমূল্য লাভ করবে। তিনি আপন মনে পাখির মতো এক মানুষ রতনের জন্যে ছন্দে ছন্দে রচনা করে যাবেন।

তাহলেই সার্থক হবে তাঁর কাব্যসাধনা। কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য ব্যতিক্রমিক এক প্রবীণ শিক। তিনি অগ্রসর। তাঁর চিন্তা অগ্রগামী। তিনি আধুনিকতার সঙ্গে সংগ্রাম আর ঐতিহ্যকে যুক্ত করে চলতে ভালবাসেন।

এই সমন্বয় তাঁর কাব্যËেত্রও সোচ্চার। রুচিসম্মত সাহিত্যিক রসবোধ সম্পন্ন একটি বই সমাজের অসংগতি, কুসংস্ড়্গার ও মূল্যবোধের অবয়ের বিরুদ্ধে নিরব বিপ্লবের ভূমিকা পালন করে। সমাজের কুসংস্ড়্গারের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে অবিরত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আপাতঃ দুর্বোধ্যতার নেপথ্যে ভাবপ্রধান ও রসঘন শব্দের মর্মে কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য প্রধানত একজন শিক ও লেখক। কবি দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের কলমে বারবার বাংলাদেশের মানুষ, মাটি ও সাংস্ড়্গৃতির কথা উঠে আসে।

মুক্তিযুদ্ধ তাঁর লেখার একটি বড় উপাদান। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রবন্ধ, প্রতিবেদন, ফিচার বিদগ্ধ মহলের দৃষ্টি কেড়েছে। ‘অন্তôঃপুরে অনন্তেôর আলো’(২০০৭) তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি তাঁর বাবা-মাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। "অন্তপুরে অনন্তের আলো" কাব্যগ্রন্থটি আমাদের সাহিত্যজগতে একটি সম্ভাবনাময় সংযোজন বলে প্রতিয়মান।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।