'এসো সম্মিলনের জন্য'- এই শব্দ ঝঙ্কারের তানে
আহা, দ্যাখো! ভিখারীর এই মসজিদ কী মনোহর ভূষণে!
------------------------------মারহামাত-এর কন্যা বখত।
মারহামাত-এর কন্যা বখত কিংবা বখত বিনত মারহামাত, যা-ই বলুন না কেন, বখত বিবির সম্বন্ধে যতো মুখরোচক গল্পই থাকুক না কেন বাজারে- সর্বজনস্বীকৃত তারিখ অনুযায়ী ঢাকার সর্বপ্রাচীন প্রার্থনাঘরটি কিন্তু ভেঙ্গে গেছে। কিংবা অন্যভাবে বলা যায় ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। কখন? ২০০৬ সালে। যখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ঢাকার ৪০০ বছর উদযাপনের।
ইতোমধ্যে ঢাকার চারশত বছর উদযাপনের জন্য বেসরকারিভাবে একটি জাতীয় কমিটিও গঠিত হয়েছে। নগর যদিও বাংলাদেশে কোনো নতুন অভিজ্ঞান নয়, কিন্তু ইয়োরোপীয় বাত্তি জ্বলার (এনলাইটমেন্ট) পর দেশে দেশে যে নগর-পত্তন শুরু হয়, সে ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সুবেদার ইসলাম খাঁ কর্তৃক বুড়িগঙ্গার তীরে যে প্রাদেশিক (সুবা) রাজধানী স্থাপন, তার মধ্য দিয়ে নগর হিসেবে ঢাকার পুনর্জন্ম লাভের চারশ’ বছর উদযাপনের জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ তখন, তখন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বখত নির্মিত ঢাকার মুসলমানদের প্রথম প্রার্থনাঘরটি।
ঠিক ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে শব্দটা এখানে পুরোপুরি প্রযোজ্য হবে না। কারণ এটা চাঙমা রাজার বাড়িও না কিংবা রমনার কালী মন্দিরও না। এটা একটা মসজিদ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে মসজিদ ভেঙে ফেলা হবে, এমন দুঃসাহস কারো হবার কথা নয়। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতেই হচ্ছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে বখত বিনত মারহামাতের মসজিদ। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, অনেক আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। সত্যি, বখত বিনত মারহামাত-এর নির্মিত সাড়ে চারশো বছরের পুরনো মসজিদটি এর আগে কয়েকবার সংস্কারের জন্য ভাঙচুর করা হয়েছে। বর্তমান মসজিদটি ঠিক বখত বিনত মারহামাত-এর নির্মিত মসজিদ নয়, কিংবা এটা প্রাক-মুঘল যুগের স্থাপত্য-শৈলীও পুরোপুরি ধারণ করে না।
বিশেষ করে, পণ্য অর্থনীতির ব্যাপক প্রসারের কারণে অকস্মাৎ ঐতিহ্য-বোধ জেগে ওঠার যে প্রবণতা; ঢাকার চারশো বছর উদযাপনের প্রাক্কালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ও অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষণের দাবি তাই বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী শাখারিবাজার সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী আরমানিটোলা সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী লালকুঠি সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী ফরাশগঞ্জ সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী গুলিস্থান সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী রমনা পার্ক সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী ইত্যাদি ইত্যাদি বহু কিছু সংরক্ষণের কথাবার্তা গত কয়েক বছরে বেশ শুনছি আমরা। এবং এও শুনছি, এসব সংরক্ষণের জন্য অ্যাডভোকেসি, পিপল অ্যাওয়ারনেস ইত্যাদি প্রোগ্রামে নাকি বহু ডলার-পাউন্ডও আসছে।
ভেঙে কী ফেলা হয়নি অথবা ভেঙে কি যায়নি প্রাচীন সব স্থাপত্য নিদর্শনগুলো? আমাদের কি ধারণা? আমরা যে লালবাগ কেল্লা, ষাটগম্বুজ মসজিদ কিংবা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার কিংবা ময়নামতির আনন্দবিহারের সামনে দাঁড়াই তা কি ৭ম, ৮ম কিংবা ১৬শ শতকে নির্মিত? মোটেই নয়! এই স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কালের বিবর্তনে যাওয়ারই কথা। কিন্তু নিয়ম হলো, যখন নতুন করে নির্মাণ করা হবে, তা অবশ্যই পুরনো স্থাপনা-শৈলী এবং নির্মাণ উপকরণ দিয়ে করতে হবে।
বলা বাহুল্য, এই নিয়ম প্রযোজ্য কেবল যৌথ সম্পদের ক্ষেত্রেই। আপনার দাদার তৈরি করা বাড়ি ভেঙে আপনি যেভাবে খুশি নতুন করে বানাতে পারেন, কিন্তু বখত বিনত মারহামাত-এর ওয়াক্ফ করা স্থাপনা আপনি খেয়াল-খুশি মতো ভাঙচুর করতে পারেন না। সাংস্কৃতিক এবং প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সনদের তা স্পষ্ট লঙ্ঘন। বলা দরকার, বাংলাদেশ ঐ সনদগুলো স্বাক্ষর করেছে। এবং গরীব দেশ বলে বাংলাদেশের পক্ষে এই সনদ মেনে চলা যেন কষ্টকর না হয়, এজন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়, যার বেশির ভাগ অংশটাই চিরস্থায়ী দান।
বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের একটা তালিকা আছে, তাতে চারশো’রও বেশি ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত। এই তালিকাভুক্ত কোনো স্থাপনায় যদি আপনি কখনো বেড়াতে যান, দেখতে পাবেন অথবা বলা যায় খুঁজলে দেখতে পাবেন, একটা নীল সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, এই স্থাপনাটি প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের ১৮৫৪ সালের (১৯৬৯ সালে সংশোধিত) আইন অনুসারে সংরক্ষিত, এর কোনোরূপ ক্ষতি সাধন, আঁচড় কাটা, লেখা ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এই আদেশ অমান্যকারীকে এতো টাকা জরিমানা কিংবা এতো বছরের কারাদন্ড কিংবা উভয় শাস্তি বিধান করা যাইতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ নীল সাইনবোর্ডটি ২৫ বা তার চেয়ে বেশি সময়ের পুরনো। বাংলাদেশে যেদিন সাইনবোর্ড সংরক্ষণের আইন হবে, সেদিন ঐ সাইনবোর্ডগুলোর সামনে লাগানো থাকবে আরেকটি সাইনবোর্ড, 'এই সাইনবোর্ডগুলো অমুক সালের সাইনবোর্ড সংরক্ষণের আইন কর্তৃক সংরক্ষিত... ...'।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কমবেশি চারশো স্থাপনার অধিকাংশই নাজুক অবস্থায় আছে। যেগুলো সংস্কার করা হয়েছে, সেসব সংস্কার কমিটিতে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞ কাউকে রাখা হয়নি। বলতে গেলে, সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করা হয়নি, এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।