আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৬৬ জালান সেনতোসা ... (পর্বঃ ৩)

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

আমাদের হোস্টেলটার আশেপাশে বাড়িগুলোতে চাইনিজরাই ছিল। মুসলিম মালয় বলতে ওই রোডে মোটে তিনটি বাড়ি ছিল । মেয়েদের হোস্টেল, হোস্টেল সুপারভাইজারের বাড়ি আর ছেলেদের হোস্টেল। আমাদের হোস্টেলের ওই রোডের এক চাইনিজ কয়েকটা কুকুর পালত। ওগুলো ওই রাস্তা পাহারা দিত।

যখনই রাস্তার মাথায় আসতাম কুকুরগুলো দাঁড়িয়ে যেয়ে পেছন পেছন আসত প্রায় হোস্টেল পর্যন্ত । অপরিচিত লোকের সাধ্য ছিলনা কুকুরগুলোকে অতিক্রম করা। একবার এক মালয় ছেলে সন্ধ্যা বেলায় ওই রোডের কোন এক বাড়িতে যাচ্ছিল; অপরিচিত ছিল তাই মোড়ে আসার পর ছেলেটি কিছুতেই সামনে আগাতে পারছিলনা। দুটো কুকুর ওকে ঘিরে ছিল; একপা সামনে নড়লেই ঘেউ ঘেউ। সেই সময় আমরা কয়েকজন মাসজিদ জামেক এলাকার পাসার মালামের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিলাম।

এক মালয় মেয়েকে ছেলেটি ডেকে সাহায্য চাইল; মেয়েটি তখন ওকে নিয়ে কয়েকটা বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসল। আমরা ওই এলাকার তাই কুকুরটি আর কাউকে ঘাটালোনা। লেজ নাড়তে নাড়তে আবার পাহারায় বসে গেল। স্থানীয় রীতিনীতি খানিকটা ধর্মীয় বিধিনিষেধকে প্রভাবিত করে । বাংলাদেশে আমরা মুসলিমরা কুকুর দেখলে ধর্ম চলে যাবে এই ভয়ে সিঁটিয়ে যাইনা ।

ওখানে দেখেছিলাম মেয়েরা কুকুরগুলো পেছন পেছন আসলেই তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করতো। প্রথমে মনে করেছিলাম কুকুরকে ভয় করছে বুঝি; কিন্তু ব্যপারটা তা ছিলনা পুরোপুরি । একদিন আমরা কয়েকজন মিলে বাড়ি ফিরছি। আমার হাতে হালকা কোন খাবার ছিল বোধহয় তা আমি কুকুরগুলোকে দিচ্ছিলাম; ওগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছিল। মেয়েরা প্রায় সাথে সাথে আমাকে সাবধান করল ।

আমি একটু অবাক হওয়াতে ওরা ভাবল হয়ত আমরা একটু অন্যরকমের মাযহাব অনুসরণ করি। আমি ব্যপারটাকে ওই পর্যায়ে নিতে চাচ্ছিলামনা। বললাম, এই প্রাণীটিকে শুধু শুধু এভাবে ঘৃনা করার কারণ নেই; তিকর কিছু তো করেনি ও। কেন জানি বেশ ক্ষোভের তৈরী হয়েছিল সেদিন। পাসার মালাম অনেকটা হলিডে মার্কেট বলতে যা বুঝি তাই।

পাসার বলতে মার্কেট, আর মালাম অর্থ রাত । ছুটির দিনগুলোতে সাধারনত বিভিন্ন জায়গায় এই পসরা বসত। অনেক ভীড় হতো; পর্যটকরা পাসার মালামে আসতে ভুল করেনা। অনেক সস্তায় নানা জিনিস পাওয়া যায়। আর অনেক খাবারের দোকান; এটা-সেটা ভাজা হচ্ছে।

হোস্টেলের মেয়েরা ছুটির দিনের একঘেয়েমি কাটাতে এবং সস্তায় মুখরোচক রাতের খাবার কেনার জন্যই মূলত পাসার মালাম যেতে মুখিয়ে থাকত। আমি দুবার হোস্টেলের মেয়েদের সাথে গিয়েছিলাম মাসজিদ জামেক এলাকার পাসার মালামে। মাসজিদ জামেক এলাকায় কুয়ালালামপুর হাইকোর্ট অবস্থিত। হাইকোর্টের সামনে একাংশ পিচ ঢালা এবং একাংশ ইট বিছানো রাস্তাটা আমার খুব পছন্দের ছিল। কুয়ালালামপুর হাইকোর্ট দেখতে একটু মসজিদ ধরনের ছিল; তাই প্রথমদিন দেখে ওটা যে হাইকোর্ট সেটা আমার মনে হয়নি।

প্রথমবার যেবার পাসার মালাম গেলাম সেদিন সন্ধ্যায় খুবই একঘেয়ে লাগছিল। কারণ ছাড়াই মন খারাপ – এরকম একটা ব্যাপার আরকি । মেয়েরা দেখলাম তৈরী হচ্ছিল; একজন এসে আমাকে বলল ওদের সাথে যেতে চাইকিনা; লাফিয়েই উঠলাম প্রায়। সবারই মনে হচ্ছিল বৃষ্টি নামবে কিন্তু কেউ ছাতা নিতে চাচ্ছিলনা। ফেরার পথে সত্যি সত্যিই বৃষ্টি নামল, কিনতু কে কেয়ার করে ! জিম ক্যারির মুখের হাস্যকর ভঙ্গি দেখতে আমার খুবই ভাল লাগে ।

জিম ক্যারির ফান উইথ ডিক এন্ড জেন যখন SURIA KLCC -র মুভি থিয়েটারে আসল তখন আর লোভ সামলানো গেলনা। অনেকেরই তখন পরীক্ষা চলছিল। অ্যাশ নামে একটা মেয়ে ছিল। ও অনেকটা টমবয় টাইপ ছিল; আমার ওর সাথে কথা বলতে মজাই লাগত। অ্যাশ একবার ভ্র“র নীচে ফুটো করে রিং পরেছিল।

আমি বারবার জিগেস করতাম ওর অসুবিধা লাগে কিনা। ও হাসতো আর একটু টেনে বলত, No...ooo lah। অ্যাশকে রাজি করানো ব্যাপার না জানতাম; বলতেই ও মুভি দেখার জন্য রাজি হয়ে গেল। আমি জানলাম বুধবারে টিকেটের দাম কম রাখা হয়; ৭ রিংগিত । অন্যান্যদিন সেটা ১০ রিংগিত কিনবা বেশী।

তাই আমরা বুধবারই যাব ঠিক করলাম। অ্যাশ কাস ফাঁকি দিয়ে এসেছিল সেদিন। SURIA KLCC -র মুভি থিয়েটারে প্রথম দেখা মুভি ছিল সেটা। মুভি থিয়েটারে বসে বসুন্ধরার সিটির সিনেপ্লেক্স এর কথা মনে হচ্ছিল বারবার। আমার বাকি পাঁচ রুমমেটের একজনের নাম ছিল সিতি।

ও প্রায়ই নানা ইংলিশ মুভির ডিভিডি নিয়ে আসত। নারনিয়া, ফিয়ারলেস (জেট লি -র), পিংক প্যানথার ইত্যাদি মুভিগুলো ওর কারনে দেখা হয়ে যেত। ঘরের সব আলো নিভিয়ে, অনেকটা মুভি থিয়েটারের পরিবেশ তৈরী করে, ছড়িয়েছিটিয়ে যে যার মত আমরা কম্পিউটারে মুভি দেখতে বসে যেতাম। হিন্দী মুভির ফানা -র ট্রেইলার শো টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখে মেয়েদের তো মাথা খারাপ ! একদিন দেখি ওরা কয়েকজন মুভি দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করছে। ফানা দেখার কথা শুনে তো আমি আনন্দে ষোলখানা ! সেটাও বুধবার ছিল।

সবার ক্লাসের কারনে সন্ধ্যার পরের শো (৮:০০ টার শো) দেখার কথা ঠিক হলো। আমি একটু আগেই পৌছে গিয়েছিলাম । আমার কিছক্ষন পরেই একজন তরুনও আসলো; ও আমাকে না চিনলেও আমি ঠিক চিনে ছিলাম যে ও আমার হোস্টেলের কিছু মেয়েদের ক্লাস টিচার। ইনডিয়ান, তবে স্থানীয় নয়। ঠিক আগের রাতেই আমাকে তার ছবি দেখিয়েছিল মেয়েরা।

এই ক্লাসটিচারটি ওদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। এক মেয়েতো প্রায় লাল হয়েই যাচ্ছিল ওর কথা বলার সময়। এই ব্যাপারটা আমার কাছে মজা লেগেছিল কারণ বাংলাদেশে আমরাও এরকম মজা করতাম কোন হ্যান্ডসাম টিচার ক্লাস নিলে। যাইহোক , আমি বেশ বুজলাম ও আমাদের সাথেই মুভি দেখবে। শেষ পর্যন্ত মেয়েরা আসল।

ওদের টিচারের সাথে পরিচয় পর্ব হলো। আমি একটু হিন্দী ওদের চেয়ে ভাল বুঝতাম বলে ওরা ভাবত আমাদের ভাষা বোধহয় এটা। মেয়েরা পরে আমাকে জিগেস করছিল আমরা দুজন হিন্দীতে কথা বলেছিলাম কিনা ! আমরা সাতজন মেয়ে আর সেই টিচার - মোট আটজন দল বেঁধে তাড়াহুড়ো করে থিয়েটারে প্রবেশ করলাম; ফানা শুরূ হলো। মুভিটা একটু বেশীই ইমোশোনাল ছিল। আমরা সাতজন মেয়ে পুরোটা সময় কেঁদেই গেলাম।

মুভি শেষ হলে যখন আলো জ্বলে উঠল একজন আরেকজনের ফোলা ফোলা চোখ দেখে হেসেই কুটোপাটি। টিচার সহ চারজনের তাড়া ছিল; ওরা চলে গেল। আমরা চারজন রইলাম; প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। এক মেয়ের সাথে গাড়ি ছিল, নিজেই চালাত। আমরা চললাম কামপুং বারু -তে ।

একটা রেস্তোরা খুঁজে বসলাম চারজনে। আমার টমইয়াম খেতে ইচ্ছে করছিল। সি-ফুড, সুপের মত, সুগন্ধটা দারুন চনমনে। সাথে নিলাম একগাদা বরফ দেয়া মগ ভর্তি কফি। সবাই খুব মজা পাচ্ছিলাম।

আর কি খাওয়া যেতে পারে লিস্ট চেক করা হলো। টেলুর বাঙকুস (এরকমই নাম ছিল বোধহয়, টেলুর অর্থ ডিম, বাঙকুস অর্থ মোড়ানো) নামে একটা খাবারের কথা বলল সাথের মেয়েরা। এটা আসলে ভেতরে মাংসের পুর দিয়ে মোড়ানো ডিম ভাজি; উপরে টমেটো সস দেয়া। প্রায় রাত ১২:০০ টা পার করে ফেলেছি তখন আমরা ! পেটপুঁজো শেষ হলে এবার রওনা হলাম হোস্টেলের দিকে। মধ্যরাতের পর, কুয়ালালামপুরের ফাঁকা রাস্তা, ছলমলে আলো - অসাধারন ! হোস্টেল ফিরে এসে কান্ত-শ্রান্ত আমি যখন ঘুমাতে গেলাম তখন ১:০০ টা।

এসি থিয়েটারের কারণে কিনবা রাত-দুপুরে ঠান্ডা কফির কারনেই হয়ত সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি প্রচন্ড জ্বর । অবশ্য এক দিনপরেই ভাল হয়ে গেলাম। জিম ক্যারীর মুভি আর ফানা দেখার কথা জানালাম আম্মাকে ফোনে। শুধু মধ্যরাতের ভ্রমন আর সকালবেলার জ্বরের কথাটা চেপে গেলাম বেমালুম...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।