এসএসসি পরীক্ষার পর আমার স্কুলের বন্ধুরা কেউ টোফেল, জিম্যাট, কেউ বা শর্টহ্যান্ড-টাইপরাইটিং কি কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলো। তখন আমেরিকা যাোয়ার খুব ক্রেজ। আর মাইকেল জ্যাকসন। ...
আমি এ সব কিছুর কোনোটাই করিনি। একেবারে সিরিয়াস পরীক্ষার্থীর মতো সকাল বেলাতেই খাতাকলম গুছিয়ে চলে যাই পাবলিক লাইব্রেরিতে।
তারপর একেবারে টানা চলতে থাকে গভীর অধ্যায়ন।
সেই সময় আমি খুঁজে পাই আরেক সিরিয়াস পাঠককে। নাম জাহিদ হাসান পাপ্পু। বয়সে আমার চেয়ে বছর চারেক বড়। আশ্চর্য সুন্দর ঝাঁ চকচকে তরুন।
আয়নার মতো জ্বলজ্বলে চোখ। তার মেধার গভীরতা আর ক্ষুরধার যুক্তি আমাকে টানে। খুব দ্রুত আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আমি মোহিত হই। ...
দুনিয়ার নানান বিষয়ে আমাদের কথা হয়।
বই পড়ি, আর তর্কে মাতি। তুমুল চেঁচামেচি করে একেকটি বিষয়ে একেবারে হাতাহাতি করার উপক্রম।
পাবলিক লাইব্রেরির পর আমরা আরো বইয়ের সন্ধানে হানা দেই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই গোগ্রাসে গিলতে থাকি বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরত, মানিক, জীবনানন্দ, বোদলেয়ার, চেখভ, তলস্তয়, দস্তভিস্ক, গোর্কি, কামু, কাফকা, সক্রেটিস, প্লেটো, রুশো, ভলতেয়ার, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাোসেতুং, দেরিদা, বেকন, জ্যাক লন্ডন, মম, মার্ক টুয়েন...এবং আরো অনেক...
আমার বাবা বলতেন, মানুষের জীবন খুব ছোটো। এই জন্য বই পড়তে হবে বাছাই করে, ভেবেচিন্তে।
আর জাহিদ ভাই বলেন, যা পড়তে ভাল লাগে, তার সবই পড়ে ফেলতে--একেবারে মার্কস থেকে শুরু করে মাসুদ রানা পর্যন্ত।
আমি জাহিদ ভাইয়ের কথাটাই গ্রহণ করি। বাবার পরেই জাহিদ ভাই হলেন আমার দ্বিতীয় ঈশ্বর। আমি তার সাথে উড়াল দেই। ...
সেই সময় দেখতাম জাহিদ ভাই খুব সুন্দর কবিতা লিখতেন।
পিজি হাসপাতাল ঘিরে জমে োঠা লিটল ম্যাগের নানা গ্রুপ তার কাছ থেকে দু/ একটা কবিতা চেয়ে নিতো। আর কি যে সুন্দর তার হাতের লেখ্! মনে হয়, একেকটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি।
অনেক কবিতাকেই উনি আবার নিজেই সুর দিয়ে গান বাঁধেন। সবই বাউল ঘরনার গান। আর গান কম্পোজ হতো সন্ধ্যায়, চারুকলার শুকনো পুকুড় পাড়ে--পেশাদার ঢুলির ঢোলের বোলে।
(কিছুদিন আগে বাংলা ব্যান্ডের অনুশের জাহিদ ভাইয়ের একটা গান গেয়ে খুব জনপ্রিয় করেছেন...তোমার ঘরে বাস করে কারা, তুমি জান না, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা?...)
তখন বিখ্যাত সব বাউলদের সঙ্গে দেখি তার অদ্ভুদ সখ্যতা। বাউল গানের সন্ধানে আমরা কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ায় লালন সাঁইয়ের মাজারে, ঘোড়াশালে লেঙটা পীরের োরশে, মাতাল রাজ্জাকের আসরে, চট্টগ্রামে মাইজভান্ডারী শরীফে, এমনকি হাইকোর্টের মাজারেো ঘুরে বেড়াতে শুরু করি আমরা। মাঝে মাঝে সিগারেটের ভেতরে কি কল্কে দিয়ে গাঁজা টানাো চলতো। আশ্চর্য সোনালী সুন্দর সেই সব দিন। ...
তো কলেজে উঠে আমি পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ি এরশাদ সরকার বিরোধী ছাত্র রাজনীতিতে।
জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমতে থাকে। কলেজ শেষ করে আমি পেশাদার সাংবাদিকতায় ব্যস্ত হই। দিনের পর দিন জাহিদ ভাইয়ের সেঙ্গ আমার দেখা হয় না।
বহুবছর পর একদিন গভীর বেদনায় আমি আবিস্কার করি, পাবলিক লাইব্রেরির বারান্দায় আমার কবিতার মাস্টার জাহিদ ভাইকে! উনি এখন বদ্ধ উন্মাদ, পুরোপুরি হেরোইন আসক্ত। মাথায় জটা চুল, পরনে শতছিন্ন নোঙরা পোষাক।
দেখলে থুতু দিতে ইচ্ছে করে। ...বেঁচে আছেন মানুষের দয়াদক্ষিণায়।
কতোজনে তাকে ফেরাতে চেষ্টা করেছে। শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাকে কয়েকবার রিহ্যাবে দিয়েছিলো। কিন্তু কোনোটাতেই কাজ হয়নি।
আর আমি তো সামান্য অক্ষরজীবী মাত্র; আমি আর কোন ছাড়!
এখনো মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হয়। কখনো আমাকে চিনতে পারেন, কখনো পারেন না। তো চেনাচেনির এক পর্বে তাকে বলি আমার হিংসার কথা। বলি, আপনিই আসলে সফল। কি চমৎকার সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে বসে আছেন।
...জগতে যা কিছু আছে কিছু নেই তার অনুসঙ্গে। ...আর আমরা? দিনরাত শুধু ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত...অথবা যেনো তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠে যাোয়ার আস্ফালনে মত্ত। ...
শুনে জাহিদ ভাই হাসেন। ভাঙা গলায় ধরেন আমাদের সোনালী দিনে লেখা তার নিজের গান--
আমি যারে ভালবাসি, তারে আবার বাসি না,
তারে ভাল লাগে না, লাগে না, গো...
আমি যারে ভালবাসি গো...
যে মোরগের আজান শুইনা
রোজ সকালে ঘুম ভাঙিলা,
তারে আবার না খাইলে
তোমার মগজ বাড়ে না...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।