আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: গন্দম (পর্ব ২)

তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

৬ ফেব্রুয়ারী সময়: দুপুর ২:২৫-৩:১২ স্থান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দুপুরের দিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রেমিক-প্রেমিকারা ছাড়া আর কেউ থাকে না বললেই চলে। দর্শনার্থীদের ভীড় বাড়তে থাকে বিকাল চারটার পর থেকে। তখন চাকরী থেকে ফিরে বাবু বিবি-বাচ্চাদেরকে নিয়ে ভিক্টোরিয়ার বাগানে ঘুরতে আসেন, দাদুরা আসেন নাতি-নাতনিদেরকে নিয়ে, বিদেশী পর্যটকদেরও আনাগোনা বাড়ে। মেমোরিয়ালে ঢুকেই চমকে যেতে হয় - খাস কোলকাতার বুকে এমন চটকদার মার্বেলে রেঁনেসা আদলে স্থাপত্য কল্পনা করাটা একটু কঠিনই বটে! বাইরের গেট থেকে প্রধান হলের মাঝে ইউরোপিয়ান ধাঁচের উদ্যান, তার বুক চিঁরে গাড়ি রাস্তা চলে গেছে সোজা প্রধান দ্বারে। উদ্যানের দু'পাশে বর্গাকার বিশাল বিশাল দু'টো শান বাঁধানো চৌবাচ্চা - যদিও সেখানে পানি মোটে ৫/৬ আঙ্গুল, সবাই বলে সরোবর।

ঋতু দীপকের জন্য সব সময় ডান দিকের সরোবোরে ধাঁরে অপেক্ষা করে, এটা এক রকম রুটিন হয়ে গেছে, মেমোরিয়াল বললেই দু'জনে বুঝে নেয় ডান দিকের সরোবরের কাছে দেখা হবে। সরোবর দু'টো ১২-১৫ ফিট পরপর ঝুমকো ঝুমকো সব বুড়ো গাছ দিয়ে ঘেরা। দুপুরে আসলে এই গাছ গুলো খালি পাওয়া প্রায় অসম্ভব, সব জোড়ায় জোড়ায় দখল হয়ে যায়। অনেকে আবার ছাতা নিয়ে আসে - গুটিসুটি মেরে ছাতার আড়ালে উদ্দামতায় মাতার আশায়। এ জিনিসটা এক দমই সহ্য করতে পারে না ঋতু।

সবার সামনে স্পর্শ্ব, সে যত নির্দোশই হোক না কেন, গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে ওর। এ একটা কারনেই মেমোরিয়ালে আসতে আপতি ওর। কেবল সিনপ্লেক্সে যাবার কথা থাকলেই ও মেমোরিয়ালে পা ফেলে। দীপক আসে রাফী আহমদ রোড থেকে, ও আসে কলেজ স্ট্রিট - প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে - দু'জনেরই মাঝ পথে মেমোরিয়াল পড়ে যায়। তাই এখান থেকে দু' দফা পানিপুরী খেয়ে ট্যাক্সি নিয়ে একসাথে সোজা সিনেমায়।

ঋতু আজ নিশ্চিত ছিল কোন গাছ খালি পাওয়া যাবে না। আশ্চর্য ভাবেই সেটা ভুল প্রমানিত হয়েছে, ওর প্রিয় গাছটাই খালি পাওয়া গেছে। সরোবরের উল্টো দিকের তিন নম্বর গাছটা কারন ছাড়াই ওর পছন্দের! আস্তে বাঁ হাত উঠিয়ে সময় দেখলো ঋতু, পৌনে তিনটা বাজে। দীপক আজও দেরী করছে! এরকম একটা খোলা জায়গায় সুন্দরী একটা মেয়ের একা অপেক্ষা করাটা যে কতটা বিব্রতকর সেটা ছেলেরা কখনই বুঝবে না! সবাই, এমনকি যারা বান্ধবী নিয়ে এসেছে তারাও, হা করে তাকিয়ে থাকে। অনেকে পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় নোংরা মন্তব্য করে।

যতই বয়স হোক এগুলোতে মেয়েদের কখনই অভ্যস্ত হওয়া হয়ে ওঠে না। দুই হাঁটু এক করে তাতে মাথা রেখে সরোবরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে ঋতু। বেশ হাওয়া দিচ্ছে আজকে, সরোবরের সবুজ পানি ঢেকে গেছে শুকনো পাতায়। মেমোরিয়ালের সব চকমকে হলেও সরোবরের পানিটা কখনই পাল্টানো হয়না! ঋতুর অবশ্য এমনটাই ভালো লাগে। শ্যাওলায় সবুজ পানি বাগানের ঘাশ আর গাছে মিলে একাকার হয়ে থাকে - টলটলে পরিষ্কার পানিতে এই মিশেল আসবে না।

আরেকবার ঘড়ি দেখলো ও, চারটা পঞ্চাশ! এখনও খবর নেই! অথচ গতকাল পইপই করে বলা হয়েছে দেরি যেন না হয়। পাশ দিয়ে একটা জোড়া বাঁকা চোখে তাকিয়ে যায়। ওদের দৃষ্টির সামনে বিব্রত ঋতুর গলাটা শুকিয়ে আসে। ওদের কি দোষ! ইট-শুরকীর কোলকাতায় প্রেমের জায়গার বড্ড অভাব, সেখানে ও একা একটা জায়গা বহুক্ষণ হলো দখল করে আছে। ওদের জায়গায় ঋতু হলেও বিরক্ত বোধ করতো।

প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ দীপক তাড়াতাড়ি এস! ওড়নাটা আরেকটু জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় ঋতু। আকাশে সাদা-কালো মেঘের ঘনঘটা, বাতাসটাও ভারী - বৃষ্টি হবে নাকি! আঙ্গুল গুনে বাংলা মাসের হিসাব করলো ও - মাঘ মাস! মাঘ মাসে বৃষ্টি কেন কোলকাতায়! আপন মনেই হেসে ফেললো ঋতু, বাবার নামকরন স্বার্থক বোঝা যাচ্ছে, প্রেমিকের অপেক্ষায় ঋতুর চিন্তা হচ্ছে ঋতু নিয়ে! ৩টা। এবারতো দীপকের উপর রাগ হওয়া উচিত, বর্বরের মত আধাটা ঘন্টা অপেক্ষায় রেখেছে! আজ তৃণমূলের অবরোধ, তাতেই কি রাস্তায় আটকা পড়লো? এখন উল্টে নিজের উপরেই রাগ উঠলো ওর। খেয়াল করে দেখেছে দীপকের উপর কখনও রাগ টিকে না ওর। মন নিজের অজান্তেই দীপকের পখে যুক্তি দাঁড়া করিয়ে ফেলে।

কেন এমন হবে। ও তো অবরোধের কথ চিন্তা করে আজ আগে আগেই বেরিয়ে পড়েছে! "এই যে দিদি, একা নাকি?" চমকে বাঁয়ে তাকালো ঋতু, ১৮/১৯ বছরের বাচ্চা একটা ছেলে দাঁড়ানো। পরনে কটকটে গোলাপী হাফ হাতা শার্ট, পায়ের সাথে লেপ্টে থাকা সস্তা জিনস্‌। পেছনে একই রকম আরও তিন জন, সবার হাতেই জ্বলন্ত চারমিনার। ওদের দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল ঋতু, অসহায় ভাবে তাকালো চারপাশে।

সবাই যে যার গাছতলা থেকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। "কত? কিমত কত?" জীহ্‌বা বের করে শুকনো ঠোঁট ভেজায় ছেলেটা। "কিমতের কথা কি বলজেন গুরু, এমন মজাক দোব মাগী আরও করজোরে প্রসাদ চাইবে!" পেছন থেকে কৌতুক নিয়ে বলল কেউ। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো ঋতু, দলটাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সাবলিল ভাবে ঋতুর বুকটা ছুঁয়ে দিল ছেলেটা। মাথা নিচু করে পেছনের খিকখিক হাসি ফেলে অন্ধের মত ছুটলো ও।

গলার কান্না আটকে রেখেছে অনেক কষ্টে। হে ভগবান কৃপা হও, দীপককে পাঠিয়ে দাও এক্ষুনি - এক্ষুনি! পথরোধ করে দাঁড়ায় লম্বা, পাতলা, ফর্সা এক যুবক... বিনয় নিয়ে বলল, "কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জা..." এত দিনের নারী জীবনে কোন গলায় কি আছে সেটা অন্তত্য বুঝতে কষ্ট হয়না ঋতুর, বুঝে গেল যেই হোকনা কেন ওর কাছে ভয় নেই। ছেলেটার কথা শেষ হবার আগেই খপ করে ওর হাত ধরে হিঁচড়ে সাথে নিয়ে চলল ঋতু, কেন ও নিজেই জানে না। হয়তো ওর পেলব নারী মনের কাঠিন্যের বাসনা যা পারার কথা দীপকের কাছ থেকে তার খোঁজ অবচেতন মন খুঁজে নিয়েছে অচেনা যুবকের কন্ঠ থেকে। তবে সেটা গল্পের বিবেচ্য নয়, কারন আমরা জানি মাঝে মাঝে যুক্তি-হিসাবকে ফেলে মনের মালিকানা নিয়ে নেয় নিপাট প্রবৃতি! © অমিত আহমেদ (চলবে) গন্দম - পর্ব ১


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.