ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....
ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাবুর ভেতর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। টপ টপ করে জমাট কুয়াশা পড়ে উপর থেকে। মাটির উপর কম্বল বিছিয়ে ঘুমাচ্ছি আমরা। গরম পোশাক যা ছিল সবই গায়ে আছে।
ছোটখাট একটা কম্বলও আছে। হাটু পর্যন্ত কভার করেছে কম্বল দিয়ে। বাকি অংশ খোলা। মাটি থেকেও ঠাণ্ডা উঠে। ঠাণ্ডা থেকে বাচার জন্য জড়াজড়ি করে ঘুমাই আমরা।
পথের কষ্ট এবং অনিশ্চয়তার মাঝে আমাদের দলের দুজন আর এগোতে রাজি নয়। তাই তারা ফিরতি পথে চলে গেল। আমরা বাকি সাত জন এবং অনভিজ্ঞ গাইড সাং লিয়েনকে নিয়ে সকাল সকাল তাবু গুটিয়ে রওনা দিলাম। আমাদের তাবুর ওজন তিন কেজি এবং স্টিকগুলোর ওজন তিন কেজি হওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিদিন রাতে কুয়াশায় ভিজে তাবুর ওজন প্রায় তিন গুন বেড়ে যায়।
আমরা পালা করে 20 মিনিট করে তাবুবহন করি। নিজের ব্যাগ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পাহাড় বেয়ে ওঠা কিংবা নামা খুব একটা কষ্ট হয় না। কিন্তু তাবু বহন করার সময় অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর পর থেমে বিশ্রাম নেই আমরা। ব্যাগের খাবারগুলোর সদ্্ব্যবহার করি।
আমাদের প্রত্যেকের ব্যাগ ভরা ছিল প্রচুর ইনস্ট্যান্ট নুডলস। এগুলো আমরা এখন কাচাই খাই। প্রতিবার বিশ্রাম নেবার সময় 2-1টা করে প্যাকেট খেয়ে ফেলছিলাম আমি। দুপুরের আগেই আমরা গিয়ে পৌছলাম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মানব বসতি দার্জিলিং পাড়ায়।
দার্জিলিং পাড়া থেকে কেওক্রাডং দেখা যায়।
আমার জুতোর তলা খুলে গেছে। এখানকার এক পাহাড়ি তরুণের সহায়তায় তা ঠিক করা হলো।
এবার কেওক্রাডংয়ের পথে চললাম। কোথাও পথের দুধারে ঘন বাশ ঝাড়। মাঝখান দিয়ে পায়ে হাটার উপযোগী পথ।
কোথাও আবার পথের ধারে বিশাল খাদ। এরকম এক জায়গায় অনেক নিচে তাকিয়ে দেখি বাশগাছগুলো গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। সেগুলোর গোড়াগুলো এমনভাবে আছে যে, কেউ নিচে পড়লে আর রক্ষা নাই। নিশ্চিতভাবে কয়েকটা বাশ শরীর এফোড় ওফোড় করে ফেলবে। কোনো প্রাণী মারার ফাদ কিনা বুঝতে পারলাম না।
বুঝতে পারছিলাম আমরা সমুদ্র সমতল থেকে অনেক উপরে উঠে এসেছি।
দুপুরের সূর্য যখন মাথার উপর তখন ঘন বাশঝাড়ের মাঝখান দিয়ে যাবার সময় লক্ষ্য করলাম, পথ তো নিচের দিকে নামছে। গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেওক্রাডংয়ের চুড়াটা কোন দিকে? সে জানালো, আমরা কেওক্রাডংয়ের উপর থেকে নিচের দিকে নামছি। তবে কিছুক্ষণ আগে ফেলে আসা পথটা যেখানে সর্বোচ্চ ছিল তার থেকে বাম দিকে কিছুদূরে গেলে কেওক্রাডংয়ের চূড়া আছে বলে সে শুনেছে। সে আরো জানালো, সেখানে না যাওয়াই ভাল।
কারণ সেখানে পৌছানো কঠিন। আর তাজিংডং হচ্ছে আমাদের টার্গেট, কেওক্রাডং নয়।
কিন্তু তার সঙ্গে আমরা কেউই একমত হলাম না। এতো কাছে এসেও বাংলাদেশের দ্্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কেওক্রাডং-এ চড়ব না তাই কি হয় নাকি! আমাদের গাইড আগে কেওক্রাডংয়ের চুড়াতে যায়নি। কিন্তু মোটামুটি একটা লোকেশন জানতো।
আমরা কিছুক্ষণ পিছনে যেয়ে পথ যেখানে সর্বোচ্চ বলে মনে হলো সেখান থেকে বাম পাশে চলে গেলাম। এলাকাটা ঘন বাশ বনে পূর্ণ। তবু আমরা সবাই মিলে বাশ বনের ভেতরে গিয়ে খোজাখুজি শুরু করলাম, কোথায় সেই ফলক? সবার মনে প্রচণ্ড উত্তেজনা, পাওয়া যাবে কি, কেওক্রাডংয়ের সর্বোচ্চ বিন্দু।
বাম পাশের বনের অনেক ভেতর থেকে হঠাৎ এক বন্ধু চিৎকার করে উঠল, পেয়েছি। আমিও গেলাম সেখানে।
আনন্দে শিহরিত হলাম। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। আর্মির ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর এম মোশাররফ হোসেন 1993 সালের 2 মার্চ মূল ফলকটি বসিয়েছেন। সে সময় কেওক্রাডংকেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ধরা হতো। ফলকে তাই লেখা আছে- কেওক্রাডং, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
(ছবি: কেওক্রাডংয়ের উপর আমরা, পায়ের কাছে সেই ফলক)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।