আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ইরানবেলা (কয়েন সংগ্রহের নেশা 1)

আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে

যে সময়টার কথা বলছি তখন অনেক সুবোধ ছিলাম , নিয়ম মেনে প্রতিদিন চার ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম ,একটা মিথ্যা বলার আগে পাচ বার ভাবতাম, শেষমেষ হয়তো আর বলাই হতো না । বয়েসটাও কম ছিল , সাত পার হয়নি । মাঝেমাঝেই নতুন নতুন শখ জেকে বসতো, সেসবের পেছনে আমার সবকিছু উজাড় করে দিতে কার্পণ্য ছিল না , বাবার ভয়ে বেশির ভাগ স্বপ্নডানা মেলতো না । থাকতাম পাহাড় ঘেরা Hospital এর Quarter এ , ইরাক ঘেষে থাকা ইরানের Kermanshah province এ এর মাঝে হঠাৎ একদিন দেশ থেকে ছোটো চাচার চিঠি , চিঠির নিচে staple করা দোয়েল পাখির ছবি সহ একটা দুই টাকার নোট । ইরানি নোটগুলোতে রঙের দেখা পাওয়া যেত কম, কমলা গোলাপী মেশানো নোট টা হাতে নিয়ে খুশির অন্ত ছিল না , যত্ন করে নোট টা রেখে দিতাম ।

নতুন নেশাটা ভালভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে আমাকে বেধে ফেলেছে । পুজি বলতে দুই টাকার একটা নোট , আর আমার চোখে সব কটা দেশের নোট , কয়েন জমানোর স্বপ্ন। বনধুদের অনেকেই তখন আমার কাছ থেকে নোটটা নেবার চেষ্টা করছে। আমাদের একটা চাবির রিং ছিল । শক্ত plastic এর কয়েকটা কুয়েতী নোট এর replica ।

একদিন সবার অগোচরে সব গুলো নোট রিং থেকে খুলে নিলাম । আমার চেয়ে বয়েসে বড় কয়েকটা ছেলেকে দেখানোর পর বুঝলাম নোট গুলো ভাল বিকোবে । হঠাৎ করে যুধেধর ডামাডোল বেজে উঠলো , উপসাগরীয় যুধধ । ইরানীরা বলতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ । একদিকে ইরাক , অন্যদিকে 34 দেশের alliance ।

সীমান্ত পাড় হয়ে ইরাকী কুর্দী শরণার্থী রা আসতে শুরু করলো । এর মাঝে একদিন আমার ছোট ভাইয়ের খেলার সাথীর কাছে একটা ইরাকী কয়েন দেখলাম । ছেলেটি আমার চাইতেও 1 বছর ছোট । সারা বিকেল ছেলেটাকে পটানোর পর কয়েনটা আমার হাতে আসল , বিনিময়ে দিলাম তিতাফ( সুস্বাদু এক ধরণের কেক ) কেনার জন্য আমার জমানো 5 তুমান । আমাদের district টা বিদেশীদের দিয়ে ভরে গেছে ......একদিকে ইরাকীরা তো আছেই , অন্যদিকে স্পেন , জার্মানী, ফ্রান্স , ডেনমার্ক , হাংগেরীয় , বেলজীয় , ডাচ আর নরওয়েজীয় ত্রাণ নিয়ে ডাক্তার , নার্স,volunteer রা ( আমাদের দেশের বিপর্যয়ে এত মহাযগঞ কখনও কি আমরা দেখেছি ?? )।

হসপিটালে প্রতিদিন ইউরোপীয়দের ভীড় লেগেই থাকত । কথা বলব , বলব করেও সাহস পাচ্ছিলাম না । একদিন সাহস করে কথা বললাম , বুঝলাম লোকটা english জানে না , ইশারা ইংগিতে জানলাম ইটালী থেকে এসেছে । তখন নিজেকে অনেক বড় মনে হত , কিন্তু এখন ভাবি 7 বছরের এক বিদেশী পুচকের সাথে লোকটা ইশারা ইংগিতে এতক্ষণ সময় কি ভেবে যে দিয়েছিল ? আমার plan ছিল একটা কয়েন চাইবো , কিন্তু লোকটা ভাষা বুঝেনা , শখের কথাটাও বুঝানো যাবে না , হয়ত ভেবে বসবে ভিক্ষা চাইছি , হসপিটালের ডাক্তারের ছেলে হয়ে এমনটা করলে আব্বুর মাথা কাটা যাবে । এরপর অনেকদিন আর কারো সাথে কথা বলতে সাহসে কুলোয়নি ।

এক বিকেলে খেলতে গিয়ে দেখি আব্বুর সাথে এক বিদেশী ইংরেজীতে কথা বলছে , আব্বু চলে আসার পর গিয়ে বললাম "আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন ?" ......... ফ্রান্স , ডাক্তারের ছেলে পরিচয় পেয়ে চকলেট দিতে যাচ্ছিল , সুযোগ পেয়ে সাহস করে একটা কয়েন চাইলাম ........ মানিব্যাগ থেকে একটা এমিরেটসের 1 দিরহাম বের করে দিল , ফ্রাংকের বদলে দিরহাম পেয়ে একটু কম খুশি হলাম , তারপরও সেই রাতটা কয়েন দেখতে দেখতেই কেটে গেল ...... আম্মু একদিন ব্যাগ খুলে দেখল ........ চাবির রিং থেকে কুয়েতী দিনারের রেপ্ললিকা গুলো খুলে নিয়েছে কেউ , আমার কাছে জানতে চাইতেই স্বীকার করে নিলাম , কিন্তু এর মাঝেই এক ছেলে ইসরায়েলী টাকা দেবে বলে , আমার কাছ থেকে নোটগুলো নিয়ে ঘুরাচ্ছে । কত বিকেলের খেলা মিস করে ইসরায়েলী টাকার সন্ধানে গিয়েছি , সেদিন বিকেলে গিয়ে বললাম ,......লাগবে না টাকা , আমার নোট ফেরত দাও । লোভ দেখাল পরের দিনই হাতে পেয়ে যাব , কিন্তু বাসার কথা ভেবে ফেরত নিয়ে আসতে চাইলাম । আমার স্মৃতি রাখতে চায় ............এমন কিছু আবেগময় কথা বলে একটা নোট রেখে দিল । মাঝে মাঝে মনে হয় কি বোকা ছিলাম , ইরানে বসে ইসরায়েলী টাকা সংগ্রহ করা তো অসম্ভব , আমার চাইতে 2/3 বছরের বড় হয়ে কি ধোকাই না দিয়েছিল ........ আবার রাগ হয় ..........কতগুলো মূল্যবান বিকেল খেলা ছেড়ে , এ কাজে নষ্ট করেছি .............. আবার ভাবি ........ তবুও ভাল , আরেকবার যদি দিন গুলো ফিরে পেতাম ..............


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।