আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
ছোটবেলার ঈদের দিনগুলোকে মনে হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ মূহুর্ত। পেছনে ফেলা আসা সেই দিনগুলো বেশ কয়েকটি কাটিয়েছি ইরানে । ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক শিয়া হওয়া সত্তেও আমাদের অঞ্চলটি ছিল সুন্নি প্রধান । বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ হানাফী মাজ হাব অনুসারী সুন্নি আর ইরানের সুন্নিরা শাফেয়ী মাজহাব অনুসারী , তাই আচার অনুষ্ঠানে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষণীয় । আব্বুর ডাক্তারী পেশার কারণে , সেই সাথে সুন্নি হওয়ার কারণে ইরানীদের যে ভালবাসা আমরা পেয়েছিলাম , সেটা ছিল অতুলনীয় ।
ঈদের সকালটা দেখেই বুঝে যেতাম অন্যদিন গুলোর চাইতে এ দিনটি আলাদা । আকাশটা খুব বেশি ঝলমলে লাগতো , রোদটা মনে হত অনেক বেশি মিষ্টি। এতদিন পরে এসে কারণটা বুঝতে পারি , বছরের অন্যদিন গুলির চেয়ে আম্মুর ডাকে ঈদের সকালটা অনেক আগে শুরু হত , সে কারণেই হয়ত সকালের পরিবেশটা এত অপরিচিত লাগত । আমার ছোট একটা ধবধবে পান্জাবী ছিল , গোছল শেষে পান্জাবী পড়ে আতর লাগিয়ে আব্বুর সাথে ঈদের নামাজ পড়তে রওনা হতাম । ইরানে কোথাও ঈদগাহে নামাজ হতো না , মসজিদেই ঈদের নামাজের আয়োজন হত ।
ঈদের সকালে ইরানীরা নতুন জামা কাপড় পড়ে নামাজে আসত, কিন্তু টুপির কোন ব্যবহার নেই ,শ্বেত শুভ্র পোষাক আর টুপিতে আমরা সবার কাছে ছিলাম রীতিমত বিস্ময় । এ পোষাক নিয়ে ইরানী খেলার সাথীদের সাথে আমার গর্বের অন্ত ছিল না । নামাজ শেষে কোলাকুলি করবার কোন প্রচলনও ওদের মধ্যে নেই । কিন্তু আব্বুর কল্যানে আমাদের ট্রেডিশন টা ওদের জানা ছিল । আমাদের সাথে তাই ওরা এক ধরনের অদ্ভূত কোলাকুলি (কোলাকুলি্ + কপালে চুমো) করত।
অদ্ভূত কোলাকুলিটা আমার মোটেও পছন্দ ছিল না , কপালে চুমো দিতে যেয়ে সবাই আমাকে কোলে তুলে নিত । খুব তাড়াতাড়ি বড় হতে চাইতাম আমি , তাই পিচ্চিদের মত কোলে উঠাকে মনে হত বড় হওয়ার পথে একটা মস্ত বাধা .................।
ঈদের নামাজের পর দল ধরে গন্যমান্য ব্যক্তিরা সবার বাড়ি বাড়ি যায়। আব্বুকে সবাই ডাকত "আক্বায়ে দকতোর"(ডাক্তার সাহেব)। আব্বু কোন বাসায় যাবে সেটা নিয়ে টানা হেচড়া শুরু হয়ে যেত ।
ইরানীদের মিষ্টি খাওয়ার ট্রেডিশনটা আমাদের চেয়ে একদম ভিন্ন । রসযুক্ত মিষ্টির সাথে ওদের পরিচয় নেই । ঈদের দিন সকালে মেহমানদের পরিবেশন করা হয় ট্রে ভর্তি চকোলেট , অন্য একটি ট্রে ভরে আনা হয় পেশতা , কিসমিস , গেরদু(আখরোট বাদাম), শুকনো ছোলা , কান্দ(চিনি জমিয়ে তৈরি করা) এর মিশ্রন । দুপুরের দিকে আব্বুর হাসপাতালের
কর্মকর্তা , নার্সরা আমাদের বাসায় আসতেন আম্মুর তৈরী বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ নিতে। ঈদকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশ থেকে কিছু সেমাই নিয়ে যাওয়া হত ।
সেমাই এত চিকন কি করে হয় এ নিয়ে ইরানী আংকেল দের চিন্তার অন্ত ছিল না । ঈদের অনেক আগে থেকেই ইরানী আংকেলরা আব্বুকে নরম মিষ্টি(পুডিং), চিকন মিষ্টি(সেমাই), আঠাল মিষ্টি (ছানার জিলাপি) , আগুন (ঝাল কোন আইটেম)কথা বারবার স্মরন করিয়ে দিত । ঝাল খাবারের সাথে ইরানীদের পরিচয় নেই , সামান্য ঝালেই অস্থির আচরণ ছিল দেখবার মত , তারপরও খুব আগ্রহ নিয়ে আগুন( ) মুখে দিত।
ঈদের দিনে ইরানীরা ভাত রান্না করে , সাথে থাকে কয়েক রকমের খোরেশত(স্পেশাল ইরানী তরকারি)। ইরানে ভাত বলতে কেবল সুগন্ধি চাল আর ঘি দিয়ে রান্না ভাতকেই বুঝায় ।
খোরেশতের মধ্যে থাকে চিলো খোরেশত(টমেটোর ঝোলের মাঝে চিকেন কাবাব), সাবজি খোরেশত(সবজি-গরু সহযোহে অতুলনীয় একটি আইটেম), খোরেশত-এ-সিব-জামিনি(ফ্রেঞ্চ ফ্রাই , টমেটোর ঝোল , আর চিকেন), খোরেশত-এ-বাদাম জান। এছাড়া ইরানীদের প্রধান খাবার রুটির সাথে থাকে কয়েক রকম শিক কাবাব(প্রতি বাড়িতে আলাদাভাবে কাবাব বানানোর ব্যবস্থা থাকে)। রং চা , পনির , বাটার আর রুটি দিয়ে আরেকটি খাবার খাওয়া চলে একটানা । ঈদের দিনে আমার খেলার সাথিদের বাসায় গিয়ে এসব খেতে প্রচন্ড উপভোগ করতাম ।
দিন শেষে সন্ধাটা নামতো খুব তাড়াতাড়ি ।
ঈদের দিনটাকে মনে হত খুব বেশি নিষ্ঠুর , ভাবতাম ঈদটা এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় কেন ? প্রতি ঈদেই সন্ধ্যাবেলায় আকাশের লালিমার দিকে চেয়ে থাকতাম , য্তবার ঝলমলে সকালের কথা মনে হত , ভীষন কান্না পেত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।