timursblog@yahoo.com
পর্দা টানা ঘরটা আরামদায়কভাবে উষ্ণ, দুটো টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, একটা মহিলার দিকে, অন্যটা বিপরীত দিকের চেয়ারের পাশে । পাশের সাইডবোর্ডে দুটো লম্বা গ্লাস, সোডা ওয়াটার, হুইস্কি রাখা আর থার্মোস বাকেটে তাজা বরফের টুকরো রাখা ।
মেরি ম্যালোনি তার স্বামী প্যাট্রিকের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে ।
বার বার মেরি ঘড়ির দিকে চাইছে, তবে দুশ্চিন্তায় পড়ে নয় । যত মিনিট যাচ্ছে ততই ওর আসার সময় হচ্ছে ।
একটা মৃদু হাসির উদ্ভাস মেরিকে জড়িয়ে রেখেছে । মাথাটা যেভাবে কাঁথা সেলাইয়ের উপর ঝুঁকে আছে সেটাও আশ্চর্য প্রশান্তির । মেরির ত্বক-এখন সে ছয়মাসের অন্তস্বত্বা, আশ্চর্য উজ্বল এক আভা বিকিরণ করছে । মুখ তার কোমল, শান্ত চোখজোড়া যেন আগের থেকে বড় আর গাঢ় রং নিয়েছে । ঘড়িতে যখন পাচ্টা বাজতে দশ মিনিট বাকি, তখন ঠিক নিয়মমাফিক ড্রাইভওয়েতে গাড়ির টায়ারের শব্দ পেল মেরি ।
দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ হলো, পায়ের আওয়াজ এগিয়ে জানালার পাশ দিয়ে, দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ হল, আর মেরিও রোজকার মত সেলাই ফেলে উঠল, চুমু দিয়ে অভ্যর্থনা করবার জন্য ।
'হ্যালো, ডার্লিং,' মেরি বলল ।
'হ্যালো ডার্লিং,' জবাব দিল প্যাট্রিক ।
ওর কোটটা নিয়ে আলমারিতে ঝুলিয়ে রাখল মেরি তারপর ড্রিংক বানাতে শুরু করলো । ওর জন্য বেশ জোরদার মিক্স, নিজের জন্য অপেক্ষাকৃত হালকা ।
আবার সেলাই নিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল মেরি, ওর স্বামী ওপাশের চেয়ারে বসে লম্বাটে গ্লাসটা নাড়াচ্ছে এমন করে যে গ্লাসের পাশে বরফের কিউব বাড়ি লেগে টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে ।
মেরির জন্য দিনের এই সময়টা সবচেয়ে চমৎকার । সে জানে তার স্বামী প্রথম ড্রিংকটা শেষ না হওয়ার আগে মুখ খোলে না সচরাচর । এতক্ষন বাড়িতে একা থাকার পর চুপচাপ বসে সে স্বামী সঙ্গ উপভোগ করে । অনেকটা সুর্যস্নানের মতন অনুভুতি, যে উত্তাপের ছোঁয়া সে এই পুরুষের মধ্যে থেকে পায় ।
যেভাবে ঢিলেঢালা ভাবে প্যাট্রিক চেয়ারে বসে, যেভাবে দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে, যেভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের মধ্যে চলাফেরা করে সবই তার মুগ্ধতার বিষয় । মেরির দিকে তাকালে তার চোখে যেরকম দূরাগত দৃষ্টি দেখা দেয়, মুখটা ওর যেরকম আজব কিসিমের, যেভাবে প্যাট্রিক হুইস্কি হাতে ক্লান্তি কিছুটা না কাটা পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকে
'টায়ার্ড ডার্লিং?'
'হ্যাঁ,' বলল ও । 'আমি খুব টায়ার্ড,' বলেই একটা অবাক করা কাজ করল প্যাট্রিক। এক চুমুকে গ্লাসের বাকি অর্ধেক হুইস্কি ও শেষ করে ফেলল । মেরি ঠিক তাকিয়ে ছিল না ওর দিকে, কিন্তু গ্লাসের তলে আইসকিউব ঠোক্কর খাওয়ার খটখট শব্দ শুনে বুঝল ও ।
চেয়ার থেকে উঠল লোকটা আরেকটা ড্রিংক বানানোর জন্য ।
'আমি বানিয়ে দিচ্ছি!' এক লাফে উঠল মেরি ।
'বসো,' বলল প্যাট্রিক ।
যখন ও ফিরে এল । ড্রিংকের গাঢ় রং দেখেই মেরি বুঝলো যথেষ্ট হুইস্কি পড়েছে ওতে ।
'ডার্লিং, তোমার স্লিপার জোড়া এনে দেই ?'
'না । '
গাঢ় হলদেটে ড্রিংকে চুমুক দিতে দেখল মেরি ওকে । এত কড়া ওটা যে তেলালো ফেনা ভাসছে গ্লাসে ।
'আমি মনে করি এটা ভীষণ অন্যায় যে তোমার মতন সিনিয়র ডিটেকটিভকে সারাদিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । '
কোন উত্তর দিল না লোকটা ।
আবার সেলাইয়ে মন দিল মেরি । কিন্তু গ্লাসের কাঁচে বরফের টুংটাং ও শুনতে পাচ্ছে পরিস্কার ।
'ডার্লিং, কিছু পনির এনে দেবো ? আজ বিষ্যুদবার বলে আমি সাপার বানাইনি । '
'না,' আবার বলল সে ।
'যদি তুমি এত টায়ার্ড থাকো যে বাইরে গিয়ে খেতে পারবে না,' বলে চলল মেরি ।
'ফ্রিজারে মাংস আর যা যা দরকার সব আছে । এক পা না নড়ে, চেয়ারে বসেই খেতে পারো তুমি । '
মেরির চোখজোড়া উত্তরের অপেক্ষায় রইল । কিন্তু নট নড়নচড়ন হয়ে চুপ করে বসে রইল মেরির স্বামী ।
'সে যাই হোক,' বলল মেরি ।
'আমি কিছু পনির আর ক্র্যাকার আনি । '
'আমার খাবার ইচ্ছা নেই । '
অস্বস্তির সাথে চেয়ারে নড়ে চড়ে বসল মেরি । বড় বড় চোখে এখনো সে দেখছে ওকে । 'কিন্তু তোমার খাওয়া দরকার! আমি বানাচ্ছি, খাওয়া না খাওয়া তোমার ব্যাপার ।
'
উঠে দাড়িয়ে সেলাইটা ল্যাম্পের ধারে রাখল ও ।
'বসো,' বলল প্যাট্রিক। 'এক মিনিটের জন্য চেয়ারে বসো । '
এই প্রথম ভয় পেতে শুরু করল মেরি ।
'বসো,' বলল প্যাট্রিক ।
'চেয়ারে বসো । '
ধীরে ধীরে আবার চেয়ারে পিঠ ঠেকাল মেরি । বড়বড় বিভ্রান্ত চোখে ও দেখছে, দ্বিতীয় ড্রিংকটা শেষ করে, শুন্য গ্লাসটার দিকে ভুঁরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্যাট্রিক।
'শোন,' বলল প্যাট্রিক । 'আমার কিছু কথা বলার আছে ।
'
'কী ব্যাপার ডার্লিং? কী হয়েছে ?'
একদম নিশ্চল হয়ে বসে আছে প্যাট্রিক, মাথাটা এমনভাবে নামিয়ে রেখেছে যে ল্যাম্প থেকে পড়া আলো মুখের উপরের অংশে পড়ে, মুখ আর চিবুক ছায়ার মধ্যে । মেরি খেয়াল করলো প্যাট্রিকের চোখের পাশের একটা পেশী লাফাচ্ছে ।
'আমি দুঃখিত কথাটা শুনলে তুমি আঘাত পাবে,' বলে চলল ও । 'কিন্তু অনেক চিন্তা করে দেখলাম সবকথা তোমাকে বলে ফেলাই ভাল । আশা করি আমাকে খুব দুষবে না তুমি ।
'
এবং মেরিকে সব খুলে বলল ও । খুব বেশী সময় লাগল না, খুব বেশি হলে চার কী পাঁচ মিনিট । প্রতিটা শব্দে জেগে ওঠা নতুন আতংক নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মেরি ।
'তো এই হচ্ছে ব্যাপার,' বলে শেষ করল ও । 'আমি জানি এ কথা বলার জন্য এসময়টা খুবই খারাপ ।
কিন্তু আর কোন উপায় ছিল না । অবশ্যই ভরনপোষনের টাকাপয়সা পাবে । আশা করি এটা নিয়ে বড় হুজ্জোত পাকাবে না তুমি । আমার ক্যারিয়ারের জন্য সেটা খুবই খারাপ হবে । '
মেরির প্রথম চিন্তা ছিল গোটা ব্যাপারটা অবিশ্বাস করার ।
হতে পারে ও মুখই খোলেনি ! গোটা কথপোকথনটাই মেরির কল্পনা ? সে যদি নিজের কাজ করে যায়, তবে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতই বুঝবে আসলে কিছুই ঘটেনি ।
'আমি সাপার বানাবো,' ফিসফিস করে বলল মেরি । এবার আর ওকে বাধা দিল না লোকটা ।
পায়ের নীচে মেঝের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে না মেরি । সামান্য অসুস্থতা আর বমি করার ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুই টের পাচ্ছে না ও ।
সবকিছুই স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলছে । যন্ত্রচালিতের মত সেলারে নেমে, আলোর সুইচ জ্বালিয়ে, ডিপফ্রিজের ডালা খুলে প্রথম যে জিনিসটা হাতে ঠেকল সেটাই টেনে বের করল ও । কাগজে জড়ানো ওটা তাই মোড়ক খুলে জিনিসটা আবার দেখল ও ।
একটা বরফজমা ভেড়ার রান ।
ঠিক আছে ।
এটা দিয়েই রাতের খাবার বানানো যাবে । হাড়ের দিকটা দুহাতে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এল ও । ভেড়ার রানটা দুহাতে ধরে লিভিংরুমে ঢুকল মেরি । ঘরের দিকে পিঠ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে প্যাট্রিক।
'ফর গডস সেক,' ওর পায়ের আওয়াজ না ঘুরেই বলল প্যাট্রিক ।
'আমার জন্য সাপার বানিও না, আমি বাইরে যাচ্ছি । '
সোজা হেঁটে ওর পিছনে চলে এল মেরি । তারপর জমাটবাঁধা ভেড়ার রানটা শুন্যে তুলে প্যাট্রিকের মাথার পিছনে আঘাত হানল মেরি ।
একটা স্টিলের ডান্ডা দিয়ে বাড়ি মারলেও ফলাফল একই হত ।
এক পা পিছনে হটলো মেরি ।
আজব ব্যাপার হচ্ছে, বাড়ি খাবার পরেও চার-পাঁচ সেকেন্ড নিশ্চল অবস্থায় থেকে ধীরে ধীরে দুলতে দুলতে কার্পেটের উপর আছড়ে পড়ল প্যাট্রিক।
ওর মাটিতে পড়ার আর ছোট টেবিলটা উল্টে পড়ার শব্দে শক থেকে বেরিয়ে এল মেরি । ধীরে ধীরে চেতন জগতে প্রবেশ করল ও । শীত লাগছে আর এখনো মাংসের টুকরোটা দুহাতে শক্ত করে ধরে আছে ও ।
(ক্রমশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।