পৃথিবীটা খুবই অদ্ভুত ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম আবারও বাড়ানো হলে বিরোধী ১৮ দলীয় জোট ৬ জানুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। জ্বালানি তেলে লিটারপ্রতি ১৮ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছিল দাবি করে সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা আগেভাগেই জ্বালানির দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিলেন। এবারের মূল্যবৃদ্ধির পরও ভর্তুকি পুরোপুরি বাদ দেওয়া যাবে না। কিন্তু ওপরের যুক্তিগুলো অকাট্য নয়। কারণ:
১. সরকার ‘ডাবল ভর্তুকির’ ফাঁদে পড়েছে নিজের হিসাবের ভুলে।
রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা স্বল্প মেয়াদে বেড়েছে বটে। কিন্তু ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল-নির্ভর এসব কেন্দ্র পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে চাইলে জ্বালানি তেল আমদানি কত গুণ বাড়াতে হবে, সে হিসাবে বড় ভুল হয়ে গেছে। আর ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দামে প্রদত্ত ভর্তুকি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও দিতে হচ্ছে, তাই ভর্তুকির পরিমাণ গত অর্থবছরের বাজেটকে প্রচণ্ড টানাপোড়েনে ফেলে দিয়েছিল। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে আরও একবার। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ছে ইউনিটপ্রতি ১৪ থেকে ১৬ টাকা।
আর বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে গড়ে দাম পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ছয় টাকা ৫০ পয়সা। এহেন ‘ডাবল ভর্তুকি’র ফলে এখন দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেলেও পিক আওয়ারে উৎপাদন সীমিত রাখতে হচ্ছে ছয় হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের নিচে। পিক আওয়ারে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই বন্ধ রাখতে হচ্ছে জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় ও ভর্তুকি কমানোর চেষ্টায়। এভাবে প্রায় দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে।
রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেওয়া থেকে শুরু করে অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে অস্বচ্ছভাবে।
দুর্নীতির আশঙ্কা আছে বলেই আগে থেকেই ‘ইনডেমনিটি’ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বিদ্যুৎ কেনার শর্তগুলোও ন্যায্য নয়। যেমন, বিদ্যুৎ না কিনলেও ওসব প্রতিষ্ঠানের লোকসানের সুযোগ রাখা হয়নি।
২. গত অর্থবছরে ৫৫ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ সরকার শুল্ক ও বিভিন্ন কর রাজস্ব সংগ্রহ করেছে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি। অন্যদিকে, জ্বালানির দামে ভর্তুকি দিচ্ছে।
রাজস্ব আয় ও ভর্তুকি ব্যয়ের যোগ-বিয়োগে প্রকৃতপক্ষে সরকারের ওপর ব্যয়ের বোঝা কত বর্তাচ্ছে, তা সরকার জনসাধারণকে জানাচ্ছে না। প্রকৃত হিসাবে জ্বালানি খাতে ‘নিট সরকারি ব্যয়’ তিন হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। অর্থাৎ বারবার মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে মূল্যস্ফীতির আগুনে সরকার যেভাবে ঘৃতাহুতি দিয়ে চলেছে, তার অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা খুবই নড়বড়ে। লিটারে সাত টাকা মূল্য বৃদ্ধি করা হলো ডিজেল ও কেরোসিনের মতো স্পর্শকাতর আইটেমে। এতে সরকারের যা ভর্তুকি ব্যয় কমবে, তার কয়েক গুণ বেশি নেতিবাচক আর্থিক অভিঘাত সৃষ্টি হবে।
৩. এটা ঠিক যে বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ভারত বা মিয়ানমারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকলে চোরাচালান বাড়ে। এটা সারের বেলায়ও সত্য। কিন্তু, বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে ধান ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের দাম বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে কমে গেছে। ভারতের সেচব্যবস্থা প্রধানত বিদ্যুৎ-নির্ভর। বিদ্যুতের দাম ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে কম।
বোরো মৌসুমের শুরুতে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে কৃষককে বোরো ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না তো? নিম্নমূল্য ধানের ক্ষেত্রে আর মূল্যবৃদ্ধি উপকরণের ক্ষেত্রে—কৃষকের স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করা হলো?
৪. বাংলাদেশের একমাত্র অয়েল রিফাইনারির উৎপাদনক্ষমতার মারাত্মক সীমাবদ্ধতার কারণে ডিজেল ও কেরোসিনের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে হচ্ছে সরাসরি ‘রিফাইন্ড ডিজেল ও কেরোসিন’ আমদানির মাধ্যমে, যেগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চেয়ে অনেক বেশি পড়ছে। মহাজোট সরকারের চার বছরেও দেশের রিফাইনারির ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ইস্যুটি অগ্রাধিকার পেল না! ফলে একদিকে প্রতিবছর বিপুল আর্থিক গচ্চা দিতে হচ্ছে দেশকে, অন্যদিকে সরকারি ভর্তুকির অজুহাতে বারবার দাম বাড়াতে হচ্ছে ডিজেল ও কেরোসিনের। সিদ্ধান্তহীনতার দায়ভার জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা কি সমীচীন হচ্ছে?
৫. জ্বালানি তেলের এবারকার মূল্যবৃদ্ধির পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির যে অজুহাত দেওয়া হয়েছে, সেটা সত্যের অপলাপ। মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন তো এ ব্যাপারে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ও জ্বালানি উপদেষ্টাকে। মাসাধিক কাল ধরে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দাম বেশ খানিকটা কমার প্রবণতাই বেশি লক্ষণীয় ছিল।
অতএব, আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিটি ধোপে টিকবে না।
বেশির ভাগ সমালোচকই এবারের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রকৃত কারণ হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন গত ২০১১-১২ অর্থবছরে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশের গৃহীত ৯৮৭ মিলিয়ন ডলার ঋণের সাত কিস্তির দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করানোর জন্য আইএমএফ আরোপিত শর্তাবলি পূরণের জন্য সরকারের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগের বিষয়টি। দ্বিতীয় কিস্তির ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ছাড় করার সময়সীমা বহু আগেই পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আইএমএফের বিশেষজ্ঞ দলের সফরের সময় ঋণচুক্তির শর্তাবলি পূরণের অগ্রগতি তাদের কাছে সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় তারা ‘গ্রিন সিগন্যাল’ না দেওয়ায় দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করা হয়নি। বরং, ইতিমধ্যে তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করার সময়ও পেরিয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী যেহেতু বর্তমান অর্থবছরের এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বাস্তবায়নে আইএমএফের এই ঋণের তিন-চার কিস্তির অর্থ ব্যবহার করতে চাইছেন, তাই শর্তপূরণের তাগিদটা তাঁর কাছে প্রবল হয়ে উঠেছে।
অর্থমন্ত্রীকে তাই প্রশ্ন করতে চাই, আইএমএফের এবারের ঋণটা কি না নিলে ভালো হতো না? ইতিমধ্যেই বৈদেশিক ঋণ/অনুদান গ্রহণের যুক্তি হিসেবে প্রদত্ত ‘টু-গ্যাপ থিওরি’ উন্নয়ন চিন্তায় গ্রহণযোগ্যতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের ‘আমদানি-রপ্তানি গ্যাপ’ এখন আমরা প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অর্থায়নে পূরণ করে প্রতিবছর লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করে চলেছি, যার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুদিন আগে ১৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সাধারণত আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ‘লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবের’ চরম ঘাটতি অবস্থা মোকাবিলার জন্য। কিন্তু এবারের ঋণটা কাজে লাগানো হচ্ছে ‘টু-গ্যাপের’ অন্যতম বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে আইএমএফের ঋণের অর্থ বরাদ্দ ও ব্যবহার করাটা কি ঠিক হচ্ছে? আইএমএফের ঋণের সুদের হার কম পড়বে, অভ্যন্তরীণ অর্থবাজার থেকে ঋণ নিতে গেলে যে সুদ দিতে হবে তার চেয়ে—অর্থমন্ত্রী হয়তো এটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
কিন্তু ‘অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের সার্বভৌমত্ব’ যদি তাঁর কাছে মূল্যবান বিবেচিত হতো, তাহলে ঋণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ৩১টি শর্তের জালটিকে অপমানজনক মনে হতো।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের এহেন তথাকথিত ‘সফট লোনের’ লোভটা উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের ক্ষমতাসীন মহল সামলাতে পারছে না আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া ‘নিম্ন সুদের’ আকর্ষণে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী যখন এরশাদ সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন, ১৯৮৩ সালের ওই পর্যায়ে বাংলাদেশের জিডিপির ১০-১২ শতাংশই ছিল বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ/অনুদান-নির্ভরতা জিডিপির ১ শতাংশের কাছাকাছি পর্যায়ে নেমে গেছে। তাই, এ দেশের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান সক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো ‘বিশ্বপুঁজিবাদের বর্ষাফলক’ প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে তথাকথিত ‘সফট লোন’ প্রয়োজন না থাকলেও গ্রহণের যে প্রবণতা পরিত্যাগ করার সময় এসেছে। ঋণ নেওয়া এ মুহূর্তেই বন্ধ করতে বলছি না আমি। যথার্থ প্রয়োজনে যাচাই-বাছাই করে ঋণ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ঋণ গ্রহণের বদখাসলত ছিল। ২০০২-০৩ অর্থবছরে তাঁর গৃহীত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ১০২ কোটি ডলারের ঋণ কী কী কাজে ব্যবহূত হয়েছে, একটু ভালোভাবে খোঁজখবর নিলে বোঝা যাবে, এ দেশের অর্থনীতির জন্য কতখানি অপচয়মূলক কর্মকাণ্ডে ওই অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল।
ওই ঋণ প্রদানের খবর যেদিন দেশে পৌঁছেছিল, সেদিন টিভি ক্যামেরার সামনে তাঁর আকর্ণ-বিস্তৃত হাসিমাখা মুখনিঃসৃত নিচে বর্ণিত বক্তব্যটা আমার মনে গেঁথে গেছে: ‘আমার নেতা জিয়াউর রহমান বলতেন, “মানি ইজ নো প্রবলেম”। আমিও বলি, যদ্দিন সাইফুর রহমান আছে, এ দেশের টাকার অভাব হবে না। ’
ওই দুটো ঋণের শর্তাবলি মানতে গিয়েই সাইফুর রহমান কৃষি খাতে ভর্তুকি দিতে বরাবরই অনীহ ছিলেন। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করতে গিয়েই তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে শরিক হয়ে এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যকে পর্বতপ্রমাণ করে তুলেছেন।
অর্থমন্ত্রী, ডিজেল ও কেরোসিনে প্রদত্ত ভর্তুকি সাধারণ জনগণের উৎপাদনশীলতাকে উৎসাহিত করার জন্যই দরকার।
ভারত ও মিয়ানমারে চোরাচালান হওয়ার যুক্তিতে এ দুটো প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সমর্থন করা যায় না। মূল্যস্ফীতিকে কিছুদিন পর পর চাগিয়ে দেবে এহেন সিদ্ধান্ত। বিশেষত, আইএমএফ থেকে অপ্রয়োজনে ঋণ গ্রহণের বদখাসলতটা পরিত্যাগ করুন। আমাদের নিকট-প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড যেদিন আইএমএফের ঋণের শেষ অর্থটুকু শোধ করে দিয়েছিল, সেদিন থাইল্যান্ডে ‘শোকরানা দিবস’ পালন করা হয়েছিল। কারণ, ওই আইএমএফ ডিকটেশন মানতে গিয়েই থাইল্যান্ডের অর্থনীতি মেল্ট ডাউনের শিকার হয়েছিল, ওরা তা ভোলেনি।
আমরাও ইনশা আল্লাহ অদূর ভবিষ্যতে এ রকম একটা ‘শোকরানা দিবস’ করতে চাই আমাদের জীবদ্দশাতেই।
ড. মইনুল ইসলাম:
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিত
উৎস
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।