আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদর্শবাদীতা সাহিত্যে

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

কবিতা অনেক বেশী ব্যক্তিগত আলাপন। কবিতায় কবি যেভাবে প্রকাশিত হয় কিংবা যেভাবে তার নিজস্ব শব্দরূচি সাহিত্যরূচি প্রকাশিত হয় গদ্যে তেমনটা সম্ভব না। কবিতায় অলক্ষ্যে ব্যক্তি অবস্থান করেই, টার জীবনদর্শন, তার নিজস্ব বিবেচনা তার জীবনকে দেখার ভঙ্গি সবটাই প্রকাশিত হয়ে যায় কবিতায়, চেষ্টা করলেও নিজেকে আড়াল করা সম্ভব না। অনুশীলনে হয়তো ব্যক্তিগত আলাপনের আড়ালটাকে রেখে দেওয়া যায়, হয়তো একটা সামষ্টিক সুর তৈরি করা যায়, তবে একেবারে কবি বিচ্ছিন্ন কবিতা নেই, একজনের অধিকাংশ কবিতা পড়লেই তার শব্দ অভিরূচি জানা হয়ে যায়, কিভাবে সে কবিতা সাজায় কিভাবে সে নিজেকে আড়াল করতে চায়, এমন নগ্নতা অন্য কোনো সাহিত্যক্ষেত্রে সম্ভব না। তবে গদ্য বিষয়টা অনুশীলনের।

পরিশীলিত গদ্য রচনা করা সম্ভব। কারো কারো সহজাত প্রবনতা থাকে ,তারা খুব সহজেই ভালো গদ্য লিখতে পারে। এখানেও অনেকেই ভালো গদ্য লিখে, অনায়াস গদ্য লেখার জন্য যেমন তেলাপোকা কিংবা এই আমি মীরার কিংবা অমি রহমান পিয়ালের প্রতি ভক্তি চলে আসে তেমন ভালো গদ্য লিখছে আস্তমেয়ে, তার বিষয়বস্তু আমার পছন্দ না, ওটা আদর্শগত বিভেদ তবে লেখার ভঙ্গির সহজাত সাবলীলতার জন্য অনেকের চেয়ে ভালো গদ্য লেখক হিসেবে ওর নাম চলে আসবে। হাসান মোরশেদ বা আরিফ জেবতিকের লেখা পড়েছি অনেক আগেই, বন্ধুসভা পাঠক ফোরামে এককালে লিখতো তারা, এই বন্ধুসভা কিংবা পাঠক ফোরামের সীমিত কলেবরের জন্যই হয়তো বড় মাপের গদ্য লেখতে ততটা সাবলীল নয় তারা। তাদের লেখার ভেতরে একটা নির্দিষ্ট ধাঁচও আছে।

বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশ জুড়ে সামগ্রিক কোলাজ তৈরীর প্রবনতাটাই হয়তো আধুনিক সাহিত্য কিংবা সাহিত্যের উত্তরাধুনিকতার ধারা। এমন বিদ্যাদিগগজ হয়ে উঠতে পারলাম না। তেমন ভাবে আমার সাহিত্যের বিশ্বায়ন ঘটে নি। বিশ্বসাহিত্য পড়ার মতো ধৈর্য্য বা মানসিক ক্ষমতার অভাবেই নিজের বুঝমতো চলছি। একটা প্রশ্ন সব সময়ই ছিলো, একটা সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম সচেতন ভাবে।

এখন সেই সিদ্ধান্ত আর সচেতনতার প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করা যায়। গদ্য যেহেতু নিরত চর্চার বিষয়, পরিবর্তন আনার সুযোগটা থাকেই, কোন ভাবে লিখিত হবে উপখ্যান এটা নিয়ে লেখকের সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা, তার ভাষা এবং শব্দচয়নের বিষয়টা, তার আঙ্গিক বাছাই এসবের পরেও একটা গল্প কিংবা একটা উপন্যাস বা একটা ছোটো গল্পে এসবের সাথেও একটা জীবনবোধ দেওয়ার প্রবনতা থাকে। আমার প্রশ্নটা আসলে এই জীবনবোধের সাঠে সম্পর্কিত। লেখকের নিজস্ব বিশ্বাস স্থাপনের সুযোগটা থাকলেই কি সেটা গ্রহন করা উচিত লেখকের। এই ঔচিত্য অনৌচিত্য বোধের সংশয়াচ্ছন্ন অবস্থানটা নিয়ে বেশ অনেক দিন বিব্রত থাকার পর মনে হলো আসলে লেখকের ভূমিকাটা শুধুমাত্র ধারাভাষ্যকারের হওয়া উচিত, কোনো সিদ্ধান্ত টানা মানে পাঠকের উপর একটা রূচিবোধ একটা জীবনাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া।

এতে পাঠকের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। শুধু মাত্র ঘটনা বর্ণনা করেই কারো ভালোত্ব বা মন্দত্ব এসব যাচাই না করেই সমাপ্তি টানা উচিত। তাহলে পাঠক নিজের বিবেচনা দিয়ে একটা ঘটনার পরিসমাপ্তি টানবে। পাঠককে যদি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন জাতীয় শিক্ষা অগোচরে দিয়েই দেওয়া হয় তাহলে জীবনের বর্ণালীর ভেতরের রংগুলো সে চিনতে পারবে না। কত কত বিচিত্র সংক্ষিপ্ত কারনে মানুষের জীবনটা আমূল বদলে যায়, কতটা নৃশংসটার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিদিন, এসবের একটা পাশ আমরা প্রতিদিন দেখি কিন্তু অন্য পাশটা দেখানোর দায়িত্ব লেখকের, তারা মুদ্্রার এপিঠ ও পিঠ দেখিয়ে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিবেন দৃশ্য পট থেকে, পাঠক অবশেষে সিদ্ধান্ত নিবে কোন ভঙ্গিতে দেখলে কাকে কিভাবে বিচার করা উচিত।

লেখকের গল্প বাছাই কিংবা চরিত্র বাছাইয়ের ভেতরে যে টুকু আদর্শবাদ থাকে এটুকু আমি আসলে হিসাবের আওতায় আনতে চাই না। কেনো একজন লেখক কোনো একটা বিষয়বস্তুকে সামনে আনতে চাইছেন, কিংবা তার মতে সেই ঘটনার চিত্রায়ন বা বর্ণনা ক্যামোন হওয়া উচিত এটা আবার লেখকের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ। লেখকের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে, কেউ লেখককে এসে বলে দিবে না এটা লেখা উচিত কিংবা এটা লেখা অনুচিত। তাহলে সৃজনশীলতা থাকবে না, ফটোকপি করে লেখার কোনো মানে হয় না। অনেকগুলো একই ধাঁচের একই বিষয়বস্তুর লেখা দেখে পাঠক ক্লান্ত হবে না।

অর্থনৈতিক একটা কারনও আছে, পাঠক বই না কিনলে পকাশক ছাপবে না আর পাঠক প্রতিদিন নতুন বোতলে পুরোনো মদ কিনে দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তির কবলে পড়তে চাইবেন না। আসলে প্রথাগত ধারনাটাকে মেনে নিয়ে সাহিত্য রচনার বিষয়টা পছন্দনীয় নয় বলেই এমন একটা ধারনা নির্মানের চেষ্টা। কিংবা যদি লেখকের আদর্শবাদ প্রকাশের সুযোগ থাকে তাহলে লেখকের জীবনবোধটা প্রচার এবং প্রসার করার চেষ্টা কতটা সততার পরিচায়ক এই বিষয়ক অনিশ্চয়তা রয়েই যায়। লেখক তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রথাগত ধারনাকে বিনির্মানের একটা সুযোগ পেলেই সেটা গ্রহন করবেন এমনটা হওয়া ঠিক হবে কি না এটাও বিবেচনার বিষয়। এইসব ভেবে নিয়ে আসলে আমার পুর্বসিদ্ধান্ত ছিলো কোনো রকম আদর্শবাদ প্রচারের সুযোগ সচেতনভাবে নেওয়া সঠিক না।

কোনো রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবনতামুক্ত লেখা সহজসাধ্য বিষয় না, মানুষের যৌক্তিকতাবোধ তাকে সার্বক্ষনিক পীড়িত করে। যেকোনো বিষয়ে একটা সমাধানে পৌঁছাতে তাগাদা দেয়। তাই যখন সাহিত্যের চরিত্র প্রাণ পায় তখন তার জীবনবোধের সাথে সাংঘর্ষিক যেকোনো ভাবনাকেই আদর্শবাদের প্রলেপে লেপে দেওয়ার একটা বাসনাও ক্রিয়া করে। এটা লেখকের জটিলতা। লেখক অনায়াসেই এই দ্্বিধা থেকে মুক্ত হয়ে ভালো মন্দ 2টা প্রতিপক্ষ তৈরি করে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পারেন।

অবশেষে কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতার বলে মন্দকে নির্মূল করে দিতে পারেন। লেখক একটা বিকল্প ভালোত্বের সুযোগ দিতে পারে। যে খারাপ তাকে সেই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করে দিতে পারেন, তাহলেও অবশেষে একটা প্রথার জন্ম হয়। যৌনতাবিষয়ক একটা বিকল্প ধারনাও দিতে পারেন, আসলে এত কিছু সম্ভব শুধু যদি একবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আদর্শবাদ প্রচারিত হবে সাহিত্যে তাহলেই। এমনটা করতে অনিচ্ছুক ছিলাম বলেই আসলে কোনো ভাবেই কোনো চরিত্রকে কোনো রকম স্থির আদর্শে স্থিতু করতে পারছিলাম না।

লেখাও হচ্ছিলো না। যেভাবেই লিখতে যাই একটা অলিখিত নীতিমালা ঝুলতে থাকে চোখের সামনে- সেখানে গোলক ধাঁধাঁর ভেতরে পথনির্দেশ করা আছে পরিস্কার করেই। এই পথে যাও। তবে অনেক দিন পর পিয়াল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে মনে হলো আমাদের সাহিত্যরচনায় একটা আদর্শবোধ প্রচারের সুযোগ নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিপর্যয় কিংবা অধঃপতনের পর মনে হলো এই যে বাঙালী সংস্কৃতি এটাকে তেমন ভাবে প্রচারের ব্যাবস্থা নেওয়া হয় নি বলেই সেই অগোচরে আমাদের পাশের দেশের নিম্ম মানের সংস্কৃতি ঢুকে যাচ্ছে আমাদের অন্দর মহলে।

আমাদের ভেতরে বকচ্ছপ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, যাদের নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই। আমার ছোটো ভাই হিন্দি অনুকরন করে কথা বলে এমন পরিবেশ দেখে আমার জঘন্য লাগে। অবশ্য তার সাহিত্যরূচি তৈরিতে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা হয় নি, তাকে তেমন ভাবে শিশুতোষ সাহিত্যও কিনে দেওয়া হয় নি আমার। বাসায় ছিলো, ইচ্ছা করলেই পড়তে পারতো, কিন্তু তাকে কোনো ভাবেই চাপ দেওয়া হয় নি সংস্কৃতি চর্চায়। এই জন্যই হয়তো তার কোনো রকম ভাবনা নেই বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সামাজিকতা বিষয়ে।

বাসার এই উদাহরনের সাথে আরও কিছু প্রতিবেশীর উদাহরনও সামনে আসলো। একটা 5 বছরের মেয়ে যখন বিয়ে বিষয়ক চিন্তাভাবনা শুরু করে যখন সেখানে বর্ণবাদের সামান্য নজীর থাকে তখন চিন্তিত হতে হয়। আমরা সামগ্রিক ভাবে কোন দিকে পতিত হচ্ছি। যাদে যা ভাববার কথা না তারা কেনো সেসব ভাবনা ভাববে? এখন আমার মনে হয় ভালোত্ব মন্দত্বের একটা স্বকীয় সংজগা তৈরি করে সেই মোতাবেক লেখা শুরু করতে হবে, এবন সই সংজ্ঞা বিচারে যারা মন্দ তাদের ৈশ্বরিক বিধানের মতোই নির্মূল করে ফেলতে হবে। অন্তত সরব না হলে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান না নিলে বাংলাদেশের চেতনায় ত্রিভূজিয় আগ্রাসন থামবে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.