কালিকাপ্রাসাদে গেলে আমি যা যা দেখতে পাবো
ইমরুল হাসান
স্বত্ব: অরণি হাসান।
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর 2005.
প্রকাশক: জনান্তিক, 50, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
প্রচ্ছদ : নঈম তারিক।
মূল্য: 45 টাকা।
উৎসর্গপত্র: দয়াপ্রাপ্ত তারাই, যারা জানে বস্তুর কারণসমুহ
#
সূচিক্রম
প্রভুর শূন্য রাজ্যে।
। ঋতুচিহ্নগুলি । । প্রতিকল্প। ।
হাঙরের নিরব দাঁতের নিচে। । মনেশ্বর রোডে। । আমার আছে দু'টি বিড়াল।
। কয়েকটি গান । । চিরপিপাসিত জগতের বাসনা। ।
সৃষ্টিতত্ত। । তোমার শহরে । । অন্য যে কোন একটি মেয়ে'র গল্প রাত্রিবেলা ।
। পরী ও চোর। । রোগের বিবরণ । ।
ডাক্তার-বন্ধু। । বোতল-বন্দী । । শোক-উচ্ছ্বাস ।
। মুহূর্তের কবিতা । । জঙ্গলে। ।
মৃতু্য-নদী । । স্তিমিত গানগুলি। । সমাধিস্তম্ভের হাওয়া ।
। সুদূরতম পাইন। । দ্বৈতস্বর। ।
বাতিঘর থেকে। । তিনটি গান। । প্রতিটা দিনের সকাল।
। পুরানো কথা । । কালিকাপ্রাসাদে গেলে আমি যা যা দেখতে পাবো । ।
#
রচনাকাল: 1995 - 2004.
#
প্রভুর শূন্য রাজ্যে
কিছু শর্ত যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে হয়তো তখন দার্শনিকতার জন্ম হয়।
শর্তগুলি আত্মগত কিংবা রূপান্তরের কিংবা বিলোপের রূপক; বিষয়ের অভিলাষ প্রতিমূর্তি ও অনান্য সকল।
সবুজ ঘাসের নিস্তব্ধতা
এতসব আর্তি মূর্ত ও বিমূর্তকে আশ্রয় করে একটি বিশুদ্ধতা;
হাতঘড়ি খুলে রেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা _ দেখা এবং না-শুনতে পাওয়া সময়ের গতি
সব সময় চমকিত করে,
কোন ভ্রমণচিহ্ন, স্মারকলিপি হয়ে ফিরে আসে, হয় অতীতহীন ও ভবিষ্যতপ্রিয়
তাই তারা 'অভ্রান্তি' এই কথা কখনো বলে না।
যা বলা যায় এবং না-বলা, জনপ্রিয় গানের সুর টিভিতে আর পথ চলা মানুষের মুখে
অন্য একটি বাস্তবতায় হানা দিতে উদগ্রীব।
পুরাণগুলি নিঃসঙ্গ, কিন্তু তারা কখনো একা থাকে না, বিস্মৃতি প্রতিবার
তাদের একজন নতুন সঙ্গী উপহার দেয়; তবে আদমের বিবি ছিলেন হাওয়া আর সব
নারী কেবলমাত্র সঙ্গীর অভিপ্রায়।
ইচ্ছা ও সত্যি যেমন অন্তরঙ্গ বন্ধু, অথচ তারা নিজেদের হত্যা করতে উদ্যত থাকে প্রতি মুহূর্তে।
ছায়া আর অস্তিত্ব যেমন একই সাথে দুটোই মূর্ত
বিভাজন কিংবা বিশ্লেষণ তাই অনিবার্য নিয়তি আর সিদ্ধান্তহীনতা এরই অংশরূপ।
ধূসরতা, ধানক্ষেতের ওপর সন্ধ্যা নেমে আসতে থাকলে বর্ণ হয়
ছড়িয়ে পড়ে টিলার ওপর রেলপথ অবধি
সন্ধ্যাট্রেন তার ব্যবচ্ছেদ করে, তারপর অন্য একটি বর্ণ - অন্ধকার; জুড়ে থাকে সব স্বপ্ন;
সমস্বর শাদা হলুদ দালান পালকে নড়ে
ঘন এবং স্বচ্ছ নয় বলে ক্রমশ পতিত, 'আর আমি... ..'
চিৎকৃতস্বরে স্তম্ভিত হয়, স্বাদুজল ঝর্ণার পাশে রাশি রাশি ফটোগ্রাফ স্থির থাকে পাথরে;
পাথরকে মন্দির বলো, আর হত্যাযজ্ঞ, প্রাণহীন, শুনবে কেউ মর্মন্তুদ আর্তিগুলি,
তাদের নিন্দা করো, সমপ্রদায়ভুক্ত না হলে দূরে ফেলে দিও জঙ্গলে, গভীর পিপাসায়
হয়তো কেউ ক্ষমা করে দেবে, হয়তো পুরানো ঝর্ণার জল আবারও পরিস্রুত হবে।
ঋতুচিহ্নগুলি
#
মুহূর্ত এবং স্মৃতিগুলি
রং খুব সহজে বদলায়। আর ঘন হয় নিরবতা।
আকাশ। মেঘ। ঘুড়ি উড়া। উজানে বাতাস। ঠোঁট।
চোখ। আর আর। দৃষ্টি নয়। কেননা বদলে যায়। ঘর ও বাহির।
একটি জানালা।
তুমি বলছিলে, মেঘগুলি। কখনো আমার নয়। হাসি, হাসিগুলি। এর চেয়ে ভালো ডুবে যাওয়া।
মৎস্য শিকার। কখনো আমার নয়। তুমি বলছিলে, এইসব শব্দ ও কথারা আমাদের সেতু নয়, আমাদের পরিখা খননের নিজস্ব মন্ত্র আর হু হু কাঁদছিল হঠাৎ পোশাকগুলি, না-বোঝা জড়েরা!
বধির একটি মৃতু্য উন্মোচিত হলে চোখ বুঁজে তার ঘ্রাণ নিয়ে সকাল আলোকিত হয়। তুমি জানো, এইসব কতটা নিকট। আর আমি ভাবি; ভাবনা, সে কি অদ্ভুত ট্রান্সপারেন্সি!
এই শেষ আনন্দ
এই শেষ আনন্দ রেখে দিই আগামী সকালের জন্য।
তখন সময় মৃদুমন্দ হাওয়ার সুরে আর ভালো লাগবে শেষ হওয়া।
এই রাত্রি কেবল শুরু, তাই গান মনে করে ঘুমের কাছে প্রকৃত নির্বাসন এই,
মেলে দিই অসংখ্য প্রভাত, কেমন এই শেষ আর আলোময় দিন,
হয়তো প্রতিদিন জেগে ওঠে সময়, তোমার সীমানা ঘিরে, প্রতিটি নতুন চমকিত
হয়ে আছে চোখের গোলকে, জানালায় কত কত শান্তিময় খেলা ফুটে আছে,
তোমার অগোচরে যা পাতারা দেখে, বলে যায় আর তুমি না-শোনা নিজের ভিতর কি এক অদ্ভুত গান শোন
প্রতিদিন এমন জেগে ওঠা তুমি কি কামনা কর, প্রতিদিন এমন সৌরভ, ভাবো না;
ভাবনাহীন ডুবে যেতে যেতে আকাশ দেখো, মেঘগুলিকে বাতাসে নদী; তুমি একবার
এভাবে শুয়ে পড়লে আর ওঠবে না, ভাবো, কী এতো রোমাঞ্চ, সত্য আনাগোনা তোমার ঘরে
বাতি নিভিয়ে চলাফেরা করে, তাদের স্বরে, স্বপ্নে, আমাকে তুমি দেখো, শেষ হওয়া, প্রভাতে।
কথাগুলি
কথাগুলি হলো পাখি, ডানায় আরো কোমল হতে গিয়ে তোমার কাছে তারা
ফিরে এসেছে আবার। বুদ্ধিমতী কথায় কথায় কত গল্প বলে যাবে সারা সময়।
তোমার কাছে যাবো, আকাশে স্বপ্নের মতো।
শব্দহীন বৃষ্টিতে অথবা জোছনায়
যেমন ঝরে কবিতাগুলি, নিভৃতে, জবাফুল দেখে, রাশি রাশি কথার মতো
ফুটেছে আজও তারা, এই দৃষ্টিগোচরে তুমি দেখছো, হাসিতে বিলীন, ডুবে যাওয়া।
হৃদয় আমাকে
হৃদয় আমাকে কাঁদায়, তোমার শহর ছেড়ে যেতে মনে হয় শৈশবকাল, তোমার উড়ন্ত দিনগুলি।
এতো শান্তি বহুদিন পর আজ, মনে এলো হৃদয়ের কথা, তোমাকে সাথী করে মেঘেদের মতো
দেখেছি ভেসে যেতে যেতে একটি গান তার পথ রুদ্ধ করে আরেকটি গানের, কী কী ভেবে
কণ্ঠে বাষ্প আসে, তোমাকে বলিনি, হৃদয় আমার, তোমার নতমুখ, নিশ্চল ঐ আকাশে, উড়ে গেছে।
তোমাকে বলবো ভেবে
তোমাকে বলবো ভেবে, কত কথা স্মৃতির মতো এই রাতে আকাশে ফুটে আছে।
এই যে এখন তোমাকে মনে পড়ে, না-দেখার মতো বিচ্ছেদগুলি, ম্লান মুখের মতো তোমার
আমি দেখছি; কোন বৃক্ষ নেই এই বেদনায়, রাশি রাশি মেঘের মতো, তোমার বিকেলে আমি
চোখগুলির মতো শান্ত হয়ে আছি; ভাবনায়, তোমাকে এতো কাছে পেয়েছি যেন, বলবার মতো।
মনে হয় বহুদিন পর
মনে হয় বহুদিন পর, জেগে ওঠতে চেয়েছি আজ, চারপাশ বৃত্তের মতো ঘূর্ণায়মান ভেবে
ভয় হয়, ক্লান্তির কতো কি, ঘুমের মতো তবু ভয় হয়, মৃতু্যর মতো আনন্দ হয় অথবা
না-জানা কেবলই ইচ্ছে হয় চুপচাপ বসে থাকবার; বহুদিন পর তোমাকে কেমন দেখায়
দেখবার মতো করে এতসব সময় এসেছে আর যাচ্ছে চলে, কোনদিন হয়তো তা-ই রয়ে যাবে
ফুল আর চাঁদ, বৃক্ষের স্বাভাবিক ফল, ঋতুনির্ভর সবকিছুতে, হয়তো পরিবর্তন এসে যাবে।
উৎসব
সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধতায়। একা ঘুড়ির ক্লান্ত পথে চক্রাকার। ভেসে ভেসে প্রাসাদ এলো তার, দীর্ঘ চূড়া। বিকেলে সবার একই গান হয়।
ডুবে যাওয়া সূর্যে হয়তো সমান স্তব্ধতা, যেমন এই চূড়া আর হঠাৎ-ই কাকের মতো দেখা দূরে নব-দম্পতি। এই কথা আর বলবো না। পাখি, তোমার ডানা মুড়ে মেঘ দেখ আজ; নিচে, মাটিতে মানুষগুলি। গলিতে অনেকগুলি ভেড়া, তাদের পর্যটন অবশেষে এই মৃত বন্দরে। আকাশে বিমান, অনেকক্ষণ, দৃষ্টিসীমায়।
দৃশ্য।
সম্ভাবনা পথ খুলে হেঁটে গেছে। দু'পাশে দীর্ঘ গাছ। আশপাশ ভরে আছে চেনা ও অচেনা। নরোম ঢেউয়ে বাতাস যে নদী তার পাল তোলা বাণিজ্যের নৌকা কত কী নিয়ে চলে যায়, আসে।
চলাচলও হতে পারে গভীর মৌনতা। কিছুই ভাঙছে না। শুশুকের মতো ভেসে ওঠা মাঝিদের নিস্পৃহতায় যাচ্ছে এড়িয়ে ক্রমশ। দিগন্ত ক্রমেই ঝাপসা। এখন আর বাতি-জ্বলা ত্রস্ততায় কেঁপে কেঁপে ওঠবে না তুমি।
ঘরগুলি বিন্দুর মতো ফুটে কখনও। রাত-বিরাতে আকাশে তারাগুলি; মাঠের ওপর, রেলপথ জুড়ে অন্ধকার, গাছ, হিবিজিবি...আজকেই মনে আর কোনদিন না। অথবা কে জানে হয়তো এমন বাদুড়ের পাখা ঝাপটানি, পেঁচার স্পষ্ট চোখে জমে আছে অনেক নিদ্রা। আর এই ভেবে ভেবে সবকিছু যাবে, যাচ্ছে; হারিয়ে।
'একদিন আমিও মরে যাবো' _ এই সত্যে তবু আমারও বিশ্বাস নেই।
তোমার জানালায় উঁকি দিয়ে পাতাগুলি তোমাকে দেখছে। তুমি আজ ভীষণ হাসছো; হাসতে হাসতে একেবারে চাঁদের মতো, লুকাতেই পারছো না। এই আনন্দ, কতদিন পর!
ঘুম
ঘুম মানে ক্লান্তিঘর। সেখানে আমরা আসবাব সাজাই এসো।
ঘুম আজ ক্লান্তির ঘর, মনোরম পথের ওপর, দীর্ঘ বৃক্ষের ছায়া, কাছে টানে আর হাসে, বলে
'এইসব কবিতা আর কোনদিন লিখবে না, ক্লান্ত;' শুয়ে শুয়ে আলোকের খেলা দেখি
ভালো লাগে নরোম শান্তির দিন; অপারগতা, ফিরে পাবার মতো বারবার হাসি-মৃতু্য;
তোমার কাহিনীগুলি যদি হতো এর ব্যতিক্রম, তোমাকে নিয়ে ঘুম যেতো প্রতিদিন;
ঘুমের দেশের বৃক্ষেরা বলেছে , আমাকে কথা, তোমার নাম নিয়ে তারাও ভেসে গেছে,
বারবার এইসব প্রতিধ্বনি আমি বলতে চেয়েছি তোমাকে, তোমার শহর ঘিরেই ঘুমের প্রতিপত্তি
তুমি শুনে গেছো, অথবা না-শোনেই আমাকে দেখেছো, দণ্ডায়মান বৃক্ষটির মতো।
ফিরে এসো
ফিরে এসো রাজহাঁস, সমাপ্তি-দিন
ঝুল-বৃক্ষ, ধূলি-মাঠ, রৌদ্র
জানালায় বসন্ত-আলো
গ্লানিময় চোখ, ফিরে এসো
সমস্ত সকাল যেন শান্ত
ধীর বরফের মতো নদীটি
তার এক তীর
বিভ্রম, কালো মেঘ, ফিরে এসো
সবুজ-গন্ধ, করুণ প্রত্যালীঢ়
#
প্রতিকল্প
কেমন প্রতিকল্প তুমি, আকাশেও আছো
বাতাসে বাঙ্টি ভাসে
দূরে, দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, তরুণী মেয়েটি চলে যায়।
লাল আলোটির গান আরও ঘনিষ্ঠ; পোশাকের ছায়া;
আরও আছে বিভিন্ন বাতি, নগর-আইল্যান্ড।
দেখো, মেয়েটির ঘরেও একটি বাতি,
নিভে গেলো,
ঘুম,
বাতাসে গড়িয়ে গড়িয়ে অনেক নিচুতে...
সুদূরের ব্যালকনি, বৃষ্টিতে বিলীন
ধূসর, একটি অন্ধকারে
আকাশে কেমন প্রতিকল্প তোমার।
#
হাঙরের নিরব দাঁতের নিচে
স্থিরতা, গতিময় সকালের ভীড়ে
স্থিরতা, গতিময় সকালের ভীড়ে বিগত রাত্রির মেঘেরা উধাও
প্রকৃতির বর্ণনা আরো মুহ্যমান করে, তাও হয়তো হারিয়ে যাবে
শূন্য রাস্তার দুপুর, অবসন্ন রিকশা, টুং টাং, এসব কিছুই আর দেখবো না;
মুহূর্তের কাছে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে বলবো 'এই যে ফাঁপা যুবক, তার অনিত্যই রইলো
অগাধ ভবিষ্যত দিনে, হাওয়া দেবে স্বস্তি, যারা সৃষ্টি ও সহায়
ধীরে ধীরে নিজেদের হারিয়ে ভেসে যাবে দূরলোকে;
দিগ্বিদিক ছুটে ছুটে একদিন উধাও, একদিনই এতসব কিছু শেষ হয়ে যাবে'
ছাই রংয়ের আকাশ, মসজিদের পাশ ঘেঁেষ রাস্তা, আমি ভেবেছিলাম
দিন, যেন তারা আবারও শুরু হয়, একটা চলে যাওয়া দিন, শীত ঋতুর,
শহরে ছুটির দিনে, ব্যস্ততাহীন পথ, দু'টি কিশোরী মেয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে
ফিরে যাচ্ছে আলোগুলি সন্ধ্যার ভিতর, অতিকায় ক্লান্ত দিন ... ...
অন্ধকার একটি ঘরে
অন্ধকার একটি ঘরে, বেড়ালের ছোপ ছোপ আলো;
জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা _ মলিন চাঁদ নদীর ওপর
তার বিকিরণ সরে সরে যাচ্ছে
মুহূর্তগুলি একা, একে অপরের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে
নির্মাণ করলো আমাকে _ ক্ষীণ, হতাশ্বাস, দুর্যোগময়;
অন্ধকার ঘরেই আবার ঘুমিয়ে যাবো, তবু এই যে তারা _ অপরিবর্তিত
চাঁদ ও আলো, গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাওয়া মুহূর্তগুলো
তারাও নিঃস্ব, চলে যেতে গিয়ে
উদ্বেল হয়েছে, হঠাৎ-ই মাঝরাতে, ক্রুর জীবনের দীক্ষায়
প্রদীপ্ত হয়ে, আবারও বললো, 'যুদ্ধহীনকে কেন দাও পরাজয়?'
তাদের বয়ে চলা মনোরম; ভেসে ভেসে
অক্ষম ও অপরিবর্তিত, বন্ধন-প্রিয়, মূঢ়
দিব্যোন্মাদ হাওয়া
দিব্যোন্মাদ হাওয়া, কেন আজ ভাসিয়ে নিলো না আমাকেও;
তার অতল চোখের দৃষ্টির ভিতর লুকানো ছিলো না যখন এই বিকেল
কেবলই বৃষ্টিপাত, অবিশ্রান্ত ঝড়ের ভিতর কম্পন; নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্লিষ্ট পড়ে থাকা
উদ্যানের পাতাগুলি, ভেজা মাটির কাছে শুয়ে পড়ে, নিভে গেছে;
সন্ধ্যার বাতিগুলি জ্বললো শহরে, কেবল অনালোকিত গাছের ছায়ায়
নিজেকেও কুড়িয়ে পেলাম না; অন্ধকার, ডুবে যাওয়া আলোর উদ্যানে
হাসছে কত মানুষ; রাস্তায়, ফুটপাতে, একে অন্যের সাথে কথা বলে
পরস্পর বিস্মিত হয়ে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, আলোর বিকিরণে তারা, মাছের শরীর
পেলব ও গন্ধবহুল, নিজেদের ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে ... ...
দিব্যোন্মাদ হাওয়া, তারা নিলো না আমাকে
দূরবর্তী আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ
দূরবর্তী আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে পড়ে রইলাম আমরা দুইজন
নিঃসহায়, জেগে থেকে থেকে জলের ভিতর, ক্লান্ত, কেবলই জেগে থাকা
লতা-গুল্মের আভাস, বালির তপ্ত মসৃণতায়, আরো দূরবর্তী হয়ে রইলাম
অস্তিত্ব, সে তো সময়েরই এতো ভয়ংকর বিচ্ছুরণ, মুহূর্তে পাল্টায় আর দূরে যেতে যেতে
ঝুলে থাকলো, পড়ে রইলো জলের ওপর, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, আমরা দুইজন
জানালার আড়ালে
জানালার আড়ালে বসে দেখা যায় না স্মৃতি, কলকল হাসছে
রোদ-কণা উজ্জ্বল হতে হতে জাগিয়ে রাখলো বিকেল
কেউ আর পদধ্বনি ব্যতীত ঘরে ঢুকবে না; পড়ে রইলো স্থির পাতা
প্রতিমূর্তি, ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাওয়া গুঞ্জন, দূরত্বের
মেলা থেকে ফিরে এসে ডুগডুগি বাজিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট ছেলে
আড়ালে বসে থেকে তাকেও দেখবো না; সব উচ্ছ্বাস নিয়ে
পরিণতি মেনে বসে রইলাম; আরেকটা ছোট্ট ছেলে এলো
টেনিস বল হাতে তার খেলা, বয়ে যাওয়া ম্লান আলোর ভিতর
আড়ালের সসি্নগ্ধ চিঠি _ মুহ্যমান প্রার্থনার ধ্বনি কেবল
ডুবতে ডুবতে অতলে ক্রমশ জলের ওপর বুদ্বুদ ভাসিয়ে দেয়া
#
মনেশ্বর রোডে
মনেশ্বর রোডে একদিন পলিটিকস হয়েছিল খুব, সকাল দশটায়; আমরা ক'জন
পড়িমড়ি করে ঘুম থেকে ওঠেই, হাত-মুখ ধোয়া, গোসল-নাশতা; তারপর রিকশা নিয়ে ছুটছি
ভাবতে-না-চাওয়ার নৈরাশ্য থেকে এই ভ্রমণ, ট্যানারির পাশ দিয়ে ময়লা ড্রেন আর দুর্গন্ধের সকালবেলায় উপলদ্ধি আসতে থাকলো ক্রমশ, মোজাইক করা মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা সোফাতে গাদাগাদি, কিছুক্ষণ পর টিভিতে পাক-ভারত ম্যাচ দেখলো আমি হারিয়ে যাচ্ছি বক্তব্য, কর্মসূচী ও উত্তরণের ভিতর, মিড উইকেট দিয়ে চার হয়ে গেলো, তারপর উঠে দাঁড়ানো, হ্যান্ডশেক আরো কি কি ভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম আমি ক্ষণকালের প্রতারণার মুহূর্তগুলিতে
যেখানে দর্শক বা সর্মথক কিছুই আমি ছিলাম না তবু অস্পষ্ট ও ঘন বিন্দুগুলির মধ্যে দীর্ঘায়িত
আমারই ছায়া; নিশপিশ করতে করতে একসময় বেরিয়ে আসতে থাকলাম সকালবেলা পেরিয়ে পলিটিক্স কাতরতায় মশগুল বন্ধুদের সাথে, মনেশ্বর রোড থেকে
#
আমার আছে দু'টি বিড়াল
আমার আছে দু'টি বিড়াল
তাদের গান আর নাচ
কত যে মোহনীয়; আলোর ভিতর
অদ্ভুত সব স্বর।
তারা বলে, এইখানে
আমিও জ্যান্ত আছি
আর সুরের খেয়ালে
তারাও যেন মানুষ, কেবল দেখতে চায়
চোখ তাদের আমাকে দেখায়।
#
কয়েকটি গান
বাতাসের মতো এই গান
দিগন্ত ছুঁয়ে উড়ে আসে
তোমার ডানার কাছে নিদ্রা পাবো বলে
কেমন অভিলাষী মেঘ
ভেসে যাচ্ছে আজ
যদি দেখতে পেতে!
সন্ধ্যার মতো চোখগুলি তোমার
আকাশ দেখছে
ঐ টিলা দূরে
তোমার সামনে আবছা আলো
কেবলি বিস্ময়
রাত ও দিন
এই কাহিনী
উৎসবের মতো জগতময়
*
কবিতা লেখা যায় মাঝে মাঝে, অনিচ্ছায়
তোমাকে বলে রেখেছি যে হৃদয়
তাও ভেসে যায়
ভাসমান আমার থেকে এই চিৎকার
শ্রবণসীমা অবধি
ছড়িয়েছে ঝড়
আর হেঁটে যাওয়া বিন্দুনির্ভর
কী মসৃণ!
*
তোমার নিঃস্ব দিনে
শেষ হয় পৃথিবীর গান
আর যে অনিন্দ্যসুন্দর
বাঁ হাতে লিখে যাচ্ছে তার
ভবিষ্যত দিনলিপি
তুমি জিজ্ঞেস করবে না তাদের মতো
এসবের কি মানে
আমি দেখবো তোমার নিদ্রা যায়
কোনপথে, হারিয়ে
*
তোমাকে দেখতে পাওয়া পথে
বহুদূর পরিচিতের মতো
হাসি হাসি ছড়িয়েছে মেঘ
ক্লান্ত শ্বাসের খেলা এই হৃদয়
কত আনন্দের নির্জন বার্তা
জেনেছিলে,
আজ দগ্ধ, চিনতে-না-পারা
*
যুদ্ধের পর
বধির হলে মানুষ
এই সংগীত হবে
এখন মেঘেদের স্বপ্নে আকাশ দেখ
নীল বুটিদার
চাঁদ নেই পথে
বিশাল শূন্যতায়
এই গান শুনেছিলে
জন্ম কি আজ পুনর্বার হবে?
#
চিরপিপাসিত জগতের বাসনা
বৃষ্টির পর চাঁদ, রাতের গানে ওঠেছে জেগে;
ভেজা পাতাগুলি তার আলোয় ঝিকিমিকি নদী;
স্থিরতা কন্ঠস্বর, মৃতু্য-পাগল; পুরাতন আর পরিবর্তন
আবহাওয়ায় ভেসে চলেছে
উজ্জ্বল রাত, আকাশে উড়ন্ত মেঘ, স্থিরচিত্র বধিরের
আরো আলোকিত জোছনায়, প্রান্তরের হাওয়া
এই মধ্যরাতে বলছে, আজ সে অনেক দূরে;
তার অবয়ব মেঘেরা কসরত করে আর ব্যর্থতায় কেঁদে কেঁদে ওঠে
গাছগুলি দেখছে, তার স্বপ্ন স্থির তারকার নিকট, অনিদ্র
ফুলেরা জাগছে এখন, মেঘেরা জাগছে এখন, তার ভালবাসা নিশ্চুপ স্বপ্নের ভিতর।
#
সৃষ্টিতত্ত্ব
অন্ধকার ডুবে গেছে
আলোর জলের নিচে গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার
কোন সে সুদূর দেশের রাণী পৃথিবীতে এসে তার পথ হারিয়ে
বলেছিলো 'এদেশ কি আমার?'
পৃথিবী _ বিবাগী দেশের মতোন।
#
তোমার শহরে
তোমার শহরে পাতাগুলি আকাশের প্রতি, আর আমি ভাবি, পাতাদের মতো, যেন আকাশ তোমার শহর।
মেঘগুলি উড়ে এলো অতিথির মতো, বৃক্ষগুলি তাদের কাছাকাছি, পরস্পর কথা বলে, কথাগুলি পাখিদের মতো,
উড়ে উড়ে বাতাসকে শোনায়, গান হয়ে ফুলেদের মতো বসে, চঞ্চল ডানাগুলি, অস্থিরতায়, দুলে দুলে
অবশেষে আমাকেই বলে, তোমার কাহিনীগুলি, রূপকথার মতো মুগ্ধতায়; যেন তুমি স্থির আছো, প্রেম হয়ে, প্রকৃতি হয়ে, আমার দৃষ্টিসীমায়।
*
বিস্মরণের ঘুম পেলো আমাকে আজ, তোমাকে হারাই ফিরে পাবার মতো, কত কামনায়
ভেসে গেলো দিন, আগুনের উৎসমুখে কুজ্ঝটিকায়, শীতকালের মতো ঘ্রাণ পাই সরে যাবার
আমাকে কথা তবু বলে পাতা আর বাতাস, তাদের কাঁপনগুলি শিরশির সারাক্ষণ
মুগ্ধতায় কবে কী গান গেয়েছি মনে পড়ে, আত্ম-সমর্পণ, তোমারই ছায়া, ছায়াময় বিকেল আর সন্ধ্যা।
*
তোমকে ভুলে গেলে, আর কি আনন্দ আমার থাকে, সময়বিন্দুতে দাঁড়িয়ে
তোমাকে বলতে চেয়েছি, হাসিমুখ, এমন অনেক কিছু; যারা থাকে তোমার
ভাবনার গভীরে আর হয়তো কখনো বলে আমাকে, তুমি শোন নির্মল,
এইসব কান্না আজ, চেয়ে দেখো বিস্ময়, আমি ভাসমান তোমার অতীতে
*
তোমার দোলনক্ষমতা আজও তো নিয়ে গেছে; আমাকে করুণার মতো স্রোতে ভাসিয়ে
দেবতারা মেঘ আর আমি তার ডানা, সারা শহর জুড়ে, সিঁড়িপথের ক্রমান্বয়
আমাকে উহ্য রেখে ভবিষ্যতের কাছে, হাওয়ারা ভেসে যায়; দূরান্তের শিশু!
কথা বলে আকাশ আর দালান; কে জানে তাদের সংলাপ এতো বৃক্ষের কাছেও
অচেনা মানুষের মতো; আমি তো তবু স্থির, আকাশের কাছে, দালান আর বৃক্ষের কাছে।
*
সময় তো স্থির; আমি দেখি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ঘুরে এই কথা-ই বলো
তোমার মায়া আজ আমারও অসাধ্য, বারবার ঝুঁকে পড়ে বলতে গিয়ে স্থির হয়ে গেছি
সময়ের মতো আরও কত কী রয়েছে তোমার, সেই গোপন কথা বলেছো আজ;
তোমার গুপ্তধন, রাশি রাশি গোলাপ, ফিরে পেয়েছি আবার, প্রত্যাবর্তন এইসব কত যে ভালো!
*
তোমার কাহিনীগুলি দু্যতিময় গোলাপ, আমাকে শীতের ঘণ্টাগুলির মতো দাঁড় করিয়ে রেখেছে
তোমার হাতের কাছে প্রতিদিন আমি প্রত্যাশাগুলি দেখে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি
তোমার কাছে আমার সমর্পণের ভঙ্গিমা, ঘরকে আলোকিত করে নিঃসঙ্গতায়, ঝাপসা করে তোলে
তাকে বলি আরো মৌন হতে, তোমার কথাগুলি শোনার জন্যে নিজেকে উদগ্রীব করি
পৃথিবী বেঁচে আছে তোমার রেখা আর চিত্রে ভরপুর পৃষ্ঠাগুলিতে, যেন তার
এই অভিনব ক্ষমতা আজ জানতে পেলে, আর লুকিয়ে লুকিয়ে এই সৌকর্য
তুমি ফোটাতে সক্ষম, বসে আছো, পৃথিবীর একটা ছোট্ট টিলায়, আমাকে দেখছো
কোনদিন-না-দেখা আনন্দে, ভালোবাসায়, বলেছো কথাগুলি, অনুনয়ের মতো করে
*
আহা প্রশান্ত
এলে না তো কাছে
পাহাড়ে পাহাড়ে নিরব চলাচলের মতো
স্মৃতিকথা ছুটি হয়ে ফিরে আসে
না-বলায়, ত্রস্ততায়, মৌন ফুল
হাসে সেই অভিজ্ঞতা-নির্ভর
আজ যাইনি কাছে
আজ দেশান্তরিত জন্তুর মুখে রূপকথা শুনে শুনে সময় হারিয়েছি।
*
দৈবের চিঠি পেয়েছি আজ।
অংকে, সমাধানযোগ্য অভিশাপে তাই মগ্ন।
কথার বিপণিকেন্দ্রগুলি ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ শহরে, মফস্বলে, তারবার্তায়... ... ...
*
বিদায়!
কেবল একটা কথাকে তোমার করে দিতে গিয়ে
দেখি, তাও নেই, কতোটা নিঃসঙ্গ আমি
তুমিও ভাবতে পারো; নম্র, জড়সড়
আহা, তোমার ভাবনারা!
*
আজ দেখেছি ছবি আর গান, নিমেষের মতো
একদিন তোমায় নিয়ে যাবো আমার স্বপ্নের কাছে
প্রতিদিন রং দেবো, হাসির মতো, মৃতু্যর মতো, হৃদয়হরণ
পুুস্পপাহাড়ে তোমার ফুল এনে দেবো, এমন অথচ
কোনদিন আমাকে তোমার ভাবনায় ভাসতে দেবে না, রাতের চাঁদের মতো
মেঘের শহরব্যাপী, বাণিজ্যে, বন্দরে, হাসি-মৃতু্য দেবে, তোমাকে দেবে না!
*
এইসব প্রতিবাদের কথাও তোমাকে লিখে পাঠাবো একদিন;
এতসব ভার, কারো সঞ্চয়ের মতো দাঁড়িয়েছে আমার মুখোমুখি
তোমাকে বলবো, কাছে এসো, জন্মলাভের মতো প্রতিদিন;
তোমার কাছে এতো আত্মাহুতি, অন্ধকার দেখে আর হাসে
*
আমাকে যারা প্রশ্ন করে, তাদের আমি কি বলবো, সি্নগ্ধ হাসি,
তোমার মৌনতাগুলি পাথরের আর আলোগুলিতে ঝিলমিল, মনে হয় অক্ষয়, চলে যাবে না
যদি কেবল আমি উড়ে যেতে পারি, দুলে ওঠবে আর মৌনতা আকাশের মতো,
তোমাকে দেখতে পাওয়া সূর্যমুখী আলোগুলিতে, এখনো ভীত, এখনো অসহায় বসে,
যেন আমি তোমাকে দেখতে পেয়েছি; সি্নগ্ধ হাসি, ভুলেই তো যাবে
*
স্নিগ্ধ হাসি, চলে গেছ, প্রত্যাবর্তনের কোন চিহ্ন না রেখে
হয়তো আবার দেখা হবে, হয়তো আবার দেখা হবে না
গাছের পাতা থেকে রোদ ঝরে, জবাফুলটি আরো নুয়ে পড়ে
শেষ সম্ভাবনাটুকুও শেষ হয়ে যাবে একদিন।
*
পরিত্রাণ পেয়েছি; আহা, এই পাপবোধের কাছে কত কী যে ছিল আমার!
পরিত্রাণ পেয়েছি, ঈশ্বর; শান্তমুখ নরকে যাইনি, পবিত্রতায়
নিজেকে খেয়েছি; বিশাল আকাশের মতো পরিপূর্ণ হয়ে
আমাকে দেখেছো, লুকিয়ে থাকার এই কৌশল আর হেসেছো
হাস্যকর আমার এই অভিপ্রায়; মুছে গেছে, দৃশ্য প্রতিদিন
ফিরে আসে আর চলে যায়, আর তার সাথে এই খেলাও
#
অন্য যে কোন একটি মেয়ের গল্প
তখন গৌড়ের জমিদার ছিলেন চন্দ্রবাবু। সেই মোলায়েম লোকটি, তরুণ বয়সেই মাঝে মাঝে পান-সুপারি খেতেন। তবে কিনা এখন লোক কাহিনীর দিনগুলি তো আর নেই, পত্রলেখার সময়টা পর্যন্ত যাই-যাই করছে। তাই এসব রেখে কাদামাটি দিয়ে পুতুল বানাবার চেষ্টা করাও ভাল। তাছাড়া তুমি তো আর বিজ্ঞানের ছাত্রী নও যে, এপ্রন পড়ে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবে, বাঈজীর নাচ দেখাবে চন্দ্রবাবুর সামনে; বরং ঘরে বসে একটু সাজগোজ করো, চাইলে নায়েব বাবু টাউন ঘুরিয়ে নিয়ে আসবেন না হয় একদিন।
বলি কি, গোমড়া মুখে এভাবে বসে থেকে রক্তাক্ত হয়ো না, রবীন্দ্রনাথের গানের শান্তি টেরর ছড়ায় তুমি বলতে চাইতে; আর কেটে যাচ্ছে গ্রন্থিগুলি, ফুটপাত গড়িয়ে ড্রেনে নেমে যেতো, শীতের পোশাকে অবয়বগুলি পাল্টাতে পাল্টাতে একদম ফ্যাকাশে। বানর নাচছে সকালে, চিঠি আসে কারো কারো, সেই সাথে করুণ মুর্গি শহরে এলো, তো গেলো কসাইখানাতেই, লাইফ ইজ সাচ্ এ হার্ড থিন্ক.. ...
গিনিপিগ যেন পেয়ে গেছো, হা হা করা শীতের বাতাস পাঁজর ঝুঁকিয়ে দিলে দেখেছো ব্যক্তিগত। কি এমন আর ন্যাওটা, তবু সাহস ছিলো ছোকরাটার, বুড়ো কনস্টেবল, জেলে চালান দেবার সময় যিনি ছিলেন, বলতেন।
আর ইদানিং সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, চন্দ্রবাবু থেকে শুরু করে গোমস্তা পর্যন্ত। নতুন রাজার পত্তনি হয়েছে, সবাই চলেছে তাকে সেলামি দিতে; হায় হায় এই অসুস্থ শরীর নিয়ে মেয়েটাও সারিতে, চরিত্রের সবাই! তবে বাবা এসব না দেখার ভান করেই বেঁচে থাকতে হবে।
পুরোটা লা ডলসি ভিটা দেখলে তারপর শুরু করে দিতেন, ওহ্ হেভেন! থাম, থাম, দেখছি রীতিমতো উপন্যাস ফেঁদে বসেছো, মিনিমাম একটা কাব্যনাটক তো বটেই; এই প্রহসনের নাম দিয়ে ইতিহাস বলছো কুলটা নারীর!
#
রাত্রিবেলা
চলেছি তোমার পথ পরিক্রমায়, আরো হারিয়ে যেতে
উত্তরের বাতাস এসে বলে, শীতকাল শুরু হলো
বাজছে রেডিওতে গান
ভাটিয়ালি কাঁদাচ্ছে শহরকে, পিছলে যাওয়া আলোর ভিতর নিয়নের
সমস্তই আবছা, নাকি কুয়াশা-ই শুরু হয়ে গেলো,
কেবল বিভ্রম;
(ফুঁ দিয়ে খেতে হবে এখন গরম শীতের পিঠা)
রাত্রি জাগলো, আরো বিসদৃশ্য হতে হতে ভাবনায়
জড়তা হলো মলিন,
তবে কি মুহ্যমান ঘুমের ভিতর আমি ধামাচাপা দেবো তোমাকে?
এসো ফাঁদ তৈরী করি,
আরেকটা মাছ ধরতে ধরতে বলি 'কি পেলব এই রাতের শরীর!'
গর্তে পড়ে গেলে সবাই চেঁচাচ্ছে
কে আর চুপ থাকে অথবা
নিরবতার দেয়ালে ছায়ারাও যে ভাষা তৈরি করে,
তাই গলিতে কুকুরটা রাত্রিবেলার সম্ভ্রম
ভয়ে ভয়ে তাকে এড়িয়ে চলছে টহল পুলিশ।
#
পরী ও চোর
চলে এসে বাষ্প জীব ভীষণ জলে চাটাই পাতা রোদ্দুর
খেয়ে দেয়ে তোমায় পাতে এঁটো করে হস হস হাসি
কী ধুরন্ধর ব্যাটা ছেলে! কান ম'লে নিয়ে যায় গরুর হাটে
বিক্রির মতো দাম পেলে, যাক বাবা এখন তো খুশি
আর ভালো দিন এমন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নয়, ছাতা-মেলা দিন
ঝরিয়ে পাতা-ঝরা নেমে এলো একি! চেনাই যায় না,
দগ্ধ ও কুৎসিত সব পাখিদের ডাকে বেলা ভোর আজ
তোমাকে দেখি তোমাকে দেখি বলে ঘুম ভাঙ্গে, যাহ্
দেখাই হলো না যদি, এতো রমরমা বাণিজ্য ভেস্তে গেলো
খোঁয়াড়-বদ্ধ গন্ধ দিকে দিকে ছড়ালো প্রলাপ আর তাতে মেতে
লোকজন বসালো সালিশ ডেকে ডেকে সমস্ত যখন চুরি
তখনো তার কান্না ভাসে ও জলের সখী এই মধু রাতে
ভবঘুরে ক্রাক মাথায় দিকে দিকে উন্মাদশালা আশ্রম তবু
যদি যাই আর... না গো আর... জন্মে যাবো না প্রভু...
#
রোগের বিবরণ
কিছুই খেতে পারছি না। একটা কিছু মুখে দেবার পর অনেকক্ষণ ধরে চিবাতে হচ্ছে, তারপরও গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। সবকিছু প্রচণ্ড ঝাল লাগছে, মনে হচ্ছে গলার ভিতরটাই যেন পুড়ে গেছে; যা কিছু গলার ভিতর দিয়ে নামছে, জ্বলে জ্বলে নামছে। আর পানি খেলে, যা খেয়েছি তা বমির সাথে বেরিয়ে আসছে।
পানি খেলেই বমি হচ্ছে, পেটে শুধুমাত্র পানি থাকলে তা-ই বেরিয়ে আসছে।
সারাক্ষণ একটা তন্দ্রাভাব, কিন্তু ঘুম কিছুতেই হচ্ছে না। মাথা ব্যথায় মনে হচ্ছে, মাথার ওপর একটা পাহাড় বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সারা শরীর চুলকাচ্ছে, ঊরুতে আর হাতে ছোট ছোট চামড়ার ক্ষত তৈরি হয়েছে। ঊরুর খাঁজে ভীষণ চুলকানি হচ্ছে সবসময়।
আমার ভিতরে আরেকটা সংগঠন গড়ে ওঠছে, শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে ক্রমশ। অতর্কিতে এই জীবাণু বাহিনী শক্তিশালী আমার প্রাণসংগঠনের চাইতেও। বারবার পরাজিত, আমার ইচ্ছেক্ষমতাও লুপ্ত হতে চলছে। গা ভাসিয়ে দিয়ে বসে আছি, বয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ।
#
ডাক্তার-বন্ধু
তোমার এপ্রনের স্যাভলন গন্ধে ভরে ওঠছে মন
এক অ্যাম্পুল অন্ধকার সিরিঞ্জের গল্প আর এক শিশি আলোর প্রেসক্রিপশন
পড়ে শোনালো এক ব্যান্ডেজ বাঁধা পা
তোমার অপেক্ষা করতে করতে দেখছি, লম্বা করিডোর দিয়ে কেবল স্ট্রেচারে রোগী, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই
প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে অনুসন্ধানী তথ্যগুলি,
কার্ডফোনে একটা ফোন সেরে দাঁড়িয়ে আছি
দেখছি তুমি আসছো গণিকাবৃত্তির পেশায় পতিতাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য-পরীক্ষা বিষয়ে কথা বলতে বলতে
তোমার এপ্রনের স্যাভলন গন্ধে ভরে ওঠছে মন।
#
বোতল-বন্দী
সাগর পাড়ে এসে মনে হল পুরানো দিন। ঢেউ এর জয়গান। মাদকাসক্ত কিশোর ছেলের মাথায় হাত রেখে মা সূর্যাস্ত দেখছে। উত্তাল পবন ভাসাবে এই দৃশ্যও! বালির বুকে স্যান্ডেলের ছাপ রেখে এসো নামি বোতলে। ছিপি অাঁটা ভালো করে; উল্টা করে নিলে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ে একটু; তীব্র রোদের আঁচ নিয়ে পিঠে টুপ করে নেমে পড়ি তাতে।
দেখি, একি ম্যাট্রিঙ্ দৃশ্য! শ্যাওলা-পড়া পানির ভিতর আমি না পারছি সাঁতরাতে, না পারছি ভেসে যেতে! চিৎপটাং হয়ে শুয়ে প্লাস্টিকের পর্দা দিয়ে পৃথিবী দেখছি, ভাবছি এ কি মনোরম খেলা ইলু্যশনের। আর রিয়ালিটি _ বোতল ঝাঁকালে, লুফালুফি খেললে ছেলেমেয়েরা অথবা স্বামী-স্ত্রীর গাদাগাদিতে পাল্টাচ্ছে আমার পারসেপশন। ভ্রমণে আমি হীনমন্য হয়ে উঠি। ভাবি এর শেষ কোথায়! ঠাণ্ডা হাওয়ায়, শীতের স্রোতে শত শত মানুষের ভিতর আমিও চলেছি বোতল ভরা পানি হাতে, সাগরের তীরে। প্রাণ-ভোমরা ওই বোতল, তার ভিতর পানি আর হতহি্ববল আমার হৃদয়; চলো ওইখানে, ওই ঝাউয়ের ভিতর গুটি সুটি, মোটামুটি দূরত্বে অস্পৃশ্য হয়ে বসে থাকি।
সব পানি খেয়ে নিলে, তাও আমি আষ্টেপৃষ্ঠে প্লাষ্টিকে জড়িয়ে রয়ে গেছি, বিদগ্ধ বাতাসের দোলা আমিও পেয়েছি, ভেজা কাপড়ও দোললো, দেখ প্রমাণ! হাইড এন্ড সিক। হাইড এন্ড সিক। তারপরও তো বেরিয়ে আসা একদিন, তখন চোখ ঘোলাটে, হৃদয় চটচটে, অভিজ্ঞতা হায়, সে তো ভোলার নয়!
#
শোক-উচ্ছ্বাস
1.
কখনো মনে হয়, হৃদয় কান্নার মতো
যে কোন মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়তে পারে;
হৃদয়ের চোখ, কান্না ভরা বৃষ্টির দেয়াল
বিকেলে ঝরে গেল, তারপর সন্ধ্যায়, স্থির
ফোটা ফোটা আকাশের থেকে ঝরে পড়লো অনেক হৃদয়
*
স্বপ্ন সম্ভব অস্তিত্বের কাছে যারা নত হয়ে আছে
তাদের চেনা যায় না; প্রতিকৃতির খেয়াল
কেবল পাল্টাচ্ছে, সরে যেতে যেতে, অন্ধকারে
বৃষ্টির আলোতে তারা উদ্বেলিত
চমকে ওঠে হঠাৎ পথ পার হলো
*
তোমাকে কি দেখবো না আর
বাতাস আরো ধীর হয়ে আসে
ঢেউগুলি তাদের; কাঁপে গাছের পাতা, অনালোকিত পথ
গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাওয়া;
পথভ্রষ্ট, স্ট্রীটল্যাম্পও কাঁপছে হু হু করে,
বৃষ্টিতে ভেজা মুহ্যমান রাতের পুলিশ।
*
ছড়িয়ে গেছে বিস্তৃত প্রতিরূপ
হতোদ্যম সিঁড়িগুলি, ভাঙ্গছে প্রাসাদের
আকাশের দিকে কয়েক হাত ফাঁকা জায়গায়
মেঘগুলি উড়ছে, ডানা নেই তাদের, তবু
তোমার দিকেই চলেছে বার্তা বহন করে
2.
যে পাপ ছিল প্রায়শ্চিত্তেই গেলো
আর এই পানির ধারে এসে পানির কথা বলে গেলাম
ট্রেনটা চলে গেলো
আর গতকাল আসতে আসতে আজ পর্যন্ত
হারিয়ে যে গেলো কোথায়
গতকালই ছিল
আর আজ তার কিছুই নেই
স্তব্ধ নদীর পানি গড়াতে গড়াতে সাগর পর্যন্ত যায়
যেখানে হাঙর, তিমি গতকাল গিলে খায়
সবাই নিজ মনে থাকে
পানির ধারে এসে পানির কথা বলে গেলাম
কে আর মনে রাখে
#
মুহূর্তের কবিতা
প্রস্থান
কথা বলা তার, জীবনের সরীসৃপ প্রত্যঙ্গগুলি
হেসে হেসে বলে গেছে,
নিশ্চুপ আলোর ভিতর আসছে সকাল
মায়াময় তার অবয়ব ছায়া; চলে গেছে।
সন্ত
ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছে সন্ত
সন্তের পথে ছায়া
মুগ্ধ পথিক চেয়ে দেখো তার, একটি চলে যাওয়া
রাতের ট্রেন
আকাশ উপুড় হয়ে আছে অন্ধকারের কাছে
অন্ধকার নত মাঠের ভিতর
তিরতির কাঁপছে
বায়বীয়
মদ্যপ বেশ্যা, কাঠখড়ি আগুন
রাত্রির গ্রাফাইট রং, এঁকেবেঁকে শীত আলো
চলেছে একক, সন্ধ্যায় মন
সংক্ষিপ্ত গান
কী যে সুন্দর, মায়াময়
বৃক্ষটি দাঁড়িয়ে আছে, হেঁটে যাচ্ছে না
এমনও কান্না আসে;
উদ্ভ্রান্ত পালকের - এই গান
উচ্চস্বর
উচ্চস্বর, নেমে যাবে
সন্ধ্যার কালো আলোয়
বাতি ফুটে ওঠে,
সিঁড়িঘর
দোদুল্যমানতা
নেমে যাবে দীর্ঘ দীর্ঘ ছায়ার প্রাচীর
বাস্তবিক
সুতপা ফিরছিলো স্কুলবাসে
হিন্দিগান বাজাচ্ছে দোকানদার
'রোদে চোখ জ্বলবে, সানগ্লাসটা পরে নাও'
হাওয়া বলছে গাছকে, দুপুরবেলায়
#
রোগশয্যায় শুয়ে লেখা
বাইরে, পৃথিবী সুন্দর
ঝিরঝির পাতা
বাতাসে কাঁপছে হ্দয়
প্রাণময় স্বপ্নের ফোয়ারা।
#
জঙ্গলে
এসো পথরেখা ধরে এগিয়ে চলি
দুর্গম বনাঞ্চলে অবশেষে এসে গেছো বন্ধুরা
হাওয়ায় দোল খাওয়া শিম্পাঞ্জিগুলি দেখে মনে হয়েছে
'নেহায়েত একটা লেজ পেলে মন্দ হতো না'
ভারী পায়ের শব্দ করে চলেছে হাতি, তার গদাইলস্করী চাল
মন্থর ও ভাবগম্ভীর, সমবেত প্রার্থনায় যাচ্ছে
আড়ালে উঁকি দিচ্ছে সরীসৃপ, গোপনে
আমাদের যাত্রায় খুঁজে পেতে চাইছে স্বর্ণখনির ম্যাপ
আর কে বা তা জানে, আমরা হাস্যপরিহাসরত, একে অন্যের খোঁচায়
অজগর হাসি উপহার দিচ্ছি 'বিষটা সঞ্চয় করো দেহে অন্তত
রোগবালাইয়ে কাজে লাগবে অথবা নিজেকেই মারবে'
প্রাচীন হিতোপদেশের ভিতর দিয়ে পথ চলে যাচ্ছে
গভীরতর বনের দিকে আরো আসো
সিংহের নির্জন গুহায় বসে চিত্রল হরিণের বর্ণসমালোচনা করি
নিজেদের গোত্র ভাগ করার আগে আমরা চিনে নিতে থাকি
কে কে তার চিহ্ন গোপন করেছে, কতখানি
#
মৃতু্য-নদী
মৃতু্য কাছে এলে ঘ্রাণ পাই সরে যাবার;
অাঁধারে জ্বলছে রাত্রির হাওয়া, উত্তাল নদীর বুকে
সারারাত ফুঁসছে; অন্ধ তার আবেগ, আমাকে নিয়ে যাবে
মোহনায় জল বাড়ার আওয়াজ, অবিরত
এই তরল মসৃণ, সি্নগ্ধ; আলো নয় কি কেবল?
কে জানে গভীর প্রপাতের তলায়
কোন পাথর খাড়া হয়ে আছে
'তোমাকে নিয়ে যাবো মৃতু্য নদীর ওপারে'
জলের কান্না প্রতিহিংসাপরায়ণ, বন্ধু মুখের আড়ালে আমাকে খুঁজছে।
#
স্তিমিত গানগুলি
শ্লেষবিন্দু
শ্লেষবিন্দু, তোমাকে বলি
ভাবনা তো নে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।