আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৌদিতে সিনেমার মাধ্যমে সমাজ বদলে দেওয়ার স্বপ্নযাত্রা



সাহারের বিয়ের সময় হয়েছে; কিন্তু ক্যারিয়ার গড়ার দিকেই তার মনোযোগটা বেশি। কিন্তু ওর ভাই খালিদের চাওয়া, তার বোনটা তার মতোই রণশীল হোক এবং গৃহবন্দি থাকুক। 'কেইফ আল-হাল' [যাচ্ছে কেমন?] এই শীতে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা বড় বাজেটের আরব-ফিল্ম, যেখানে এমন এক পরিবারের গল্প আছে যার সদস্যদের মধ্যকার পারস্পরিক সমর্্পক আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের বিবাদে ছিন্ন ভিন্ন করে এগিয়ে যায়। ছবির পলট গতানুগতিক মনে হলেও 'কেইফ আল-হাল' আরব সিনেমার জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের হাওয়া আনার আভাস দিচ্ছে। সৌদি আরবে কোন বৈধ সিনেমা হল থাকার নিয়ম না থাকলেও সেদেশের ইতিহাসের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে এটি নির্মিত হয়েছে।

সৌদি সমাজের ভারাক্রান্ত দিকগুলোকে সূক্ষভাবে ফুটিয়ে তোলার লক্ষেই কেবল নয়, এ ছবির মাধ্যমে সৌদিতে সিনেমা জগতের উপর আরোপিত সব বাধা দূর করা, সিনেমা হল নির্মাণ ও চলচ্চিত্র শিল্পকে গড়ে তোলার আন্দোলন বেগবান করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করছেন ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। আশার ব্যাপার হচ্ছে, লাইসেন্স বা বৈধ অনুমতি না পেলেও ইতিমধ্যে সৌদি জুড়ে বেশ কিছুর সিনেমা হল নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। 'কেইফ আল-হাল' নির্মাণের ক্ষেত্রে সৌদি নির্মাতাদের বানানো গত দুই বছরের কতক শর্টফিল্ম ও ডকুমেন্টারিকে অনুসরণ করা হয়েছে_ যেগুলোতে ছিল সমাজ বদলের সাহসী ইঙ্গিত। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ আল মোহসীনের সায়েন্স ফিকশন 'থালাল আল-সামত' [নিঃশব্দের নিপীড়ণ]-এ রূপকের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সৌদি সমাজের পরতে পরতে সরকারের ভয়ানক নিপীড়ণের চিত্র; 'সিনেমা 500 কিলোমিটার'-এ দেখা যায় সিনেমা দেখার জন্য সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাহরান যাচ্ছে এক সৌদি যুবক_ যার এই জার্নি আসলে সৌদি সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতার সঙ্কীর্ণতাই প্রকাশ করে। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ব্যাপক আলোড়িত ও দ্রুত বর্ধণশীল মিডিয়া কোম্পানী 'রোটানা'র স্বত্তাধিকারী ও সৌদি রাজপরিবারের ধণাঢ্য রাজপুত্র আল-ওয়াহিদ বিন তাতাল চাইছেন আরব সিনেমার ধারাকে শক্তিশালী করে, সমাজের আনাচে কানাচে সিনেমার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রশ্নাবলী ছুড়ে দিয়ে রক্ষণশীল সৌদি সরকারকে খেপিয়ে তুলতে।

'ভয়ানক কিছু ভুলকে আনন্দের ছোঁয়ায় দিতে চাই আমরা। সৌদির মানুষকে বলতে চাই, তোমাদের অধিকার আছে সিনেমা দেখার এবং গান শোনার। ' তার এ ইচ্ছেতেই 'কেইফ আল-হাল'-এ অর্থলগ্নী করেছে 'রোটানা'। পারিবারিক গল্পের নামে সস্তা নাটক বানাতে পারে সৌদিরা; তা দেখাতে পারে স্যাটেলাইট চ্যানেলে। কিন্তু, সিনেমা হল, যেখানে নারী-পুরুষের মেলামেশার দৃশ্য দেখানো হবে, হোক অন্ধকারে_ তা কি ভাবা যায়! ফলে বানানো নিষেধ সিনেমা হল।

এমনকি গতবছর জেদ্দায় অনুষ্ঠেয় ছোটদের চলচ্চিত্র প্রদর্শণীর এক সিনেমায় নারী-পুরুষ স্বাধীনতার গন্ধ পাওয়ায় প্রদর্শণী বন্দ করে দিয়েছে সৌদি প্রশাসন। এসব দেখে প্রিন্স আল-ওয়াহিদ প্রতীজ্ঞা করেছেন, যে করেই হোক তিনি এই সিনেমাটি মানুষের কাছে পেঁৗছে দেবেন। তার সাফ কথা_ 'আমি গভীরভাবে খতিয়ে দেখেছি, ইসলামের কোথাও ক্ষুদ্রতম কোন শব্দেও বলা হয়নি যে, মানুষ সিনেমা দেখতে পারবে না। এতোদিন ধরে চলে আসা ভুল অভ্যাসটা বদলে দেওয়া উচিত বলেই ছবিটা বানিয়েছি আমরা। ' ফলে, রক্ষণশীল সমাজের গাঢ় চোখ রাঙানি থাকলেও মিসরীয় লেখকের রচনায় ও কানাডিয় পরিচালকের নির্দেশনায় দুবাইয়ে রিয়াদের বাড়ি ঘরের সেট নির্মাণ করে ছবিটির শূ্যটিং করিয়েছেন প্রিন্স আল-ওয়াহিদ।

ছবিতে 'সাহার' চরিত্রে অভিনয় করেছেন জর্ডানের অভিনেত্রী মাইস হামদান [সংযুক্ত ফটোতে সাহার, মানে মাইস হামদানকে দেখা যাচ্ছে]। তার এতিম কাজিন 'সুলতান' চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌদি হার্টথ্রব হিশাম আব্দুল্লাহরহমান। এখানে সুলতানের সমাজে শিল্পচর্চা নিষিদ্ধ অথচ সে সিনেমা বানানোর স্বপ্নে বিভোর থাকে; আর ভালোবেসে ফেলে সাহারের মিটি মিটি চাহনি! সাহারের ভাই খালিদ অনুমান করে বোনের গোপন সম্পর্ক আর ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে যায়, কারণ তার সমাজে ভালোবাসা তো চরম নিষিদ্ধ এক পাপের বিষয়! 'আমেরিকা আর আরব বিশ্বের মেলামেশায় সৌদি সমাজে এখন অগুনতি অনুসঙ্গ এলামেলোভাবে ঘুরে বেড়ায়: গ্রহণ করবে, না বর্জন_ ঠিক বুঝে ওঠে না মানুষগুলো। ' সিনেমার প্রযোজক আইমান হালাওয়ানির মতামত এরকম। তিনি আরো বলেন, 'অনেক পরিবারই মতাধর ও চরমপন্থী।

আমি তাদের সন্ত্রাসী বলছি না, বরং যে ভিত্তির উপর তারা দাঁড়িয়ে থাকে তা সন্ত্রাসকে উস্কে দেয়। আমরা এই স্ট্রাগলকে প্রকাশ করতে চাই। ' এ ছবিতে সাহারের বেস্টফ্রেণ্ড 'দুনিয়া' চরিত্রের অভিনেত্রী হিন্দ মোহাম্মদ সৌদি সিনেমা ইতিহাসের প্রথম নারী। 25 বছর বয়সী মোহম্মদ ক্যারিয়ারের শুরুতে রেডিওতে পারিবারিক নাটকে কণ্ঠ দিতেন, পরে কার্টুন ছবিতেও কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত সৌদি নাটকে অভিনয়ের জন্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যদেশের নারীদের আনা হয়, কোনো সৌদি মেয়েকে পর্দায় দেখা যেতে পারে_ এটা ভাবতেই চায় না সৌদির রক্ষণশীল সমাজ।

সেখানে মোহম্মদের এই পদপে সাধারণ মনে হলেও ঐ সমাজে নারীর অবস্থানকে সম্মানজনক করার ব্যাপারে অসামান্য সাহস যোগাবে অন্যদের। উল্লেখ্য, সৌদির নারীরা মাত্র কয়েকবছর ধরে ঘরের বাইরে বেরুনোর অধিকার পেয়েছে। এখন তারা প্রয়োজনে পত্রিকায় ছবি ছাপতে পারে। আর্কিটেক্ট বা আইনজীবি হওয়ার চেষ্টা মাত্রই শুরু করেছে তারা। বিবাহ বিচ্ছেদ পদ্ধতিও সহজ হয়েছে।

মোহাম্মদের বিশ্বাস, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অবস্থান নারীরা খুব দ্রুতই করে তুলতে পারবে_ 'আমি জানি, সামাজিক আন্দোলন নারীদের অবস্থান সুসংহত করবে। আমি যদি একটু অবদান রাখতে পারি এই প্রত্যাশিত সামাজিক পরিবর্তনকে বেগবান করতে, আমি যেকোন অবস্থাতেই তা করব। ' 'কেইফ আল-হাল' ছবিতে হাস্যরসের মাধ্যমে সৌদি সমাজের অন্ধকার দিকে আলো ফেলার চেষ্টা চালানো হয়েছে। একটি দৃশ্যে বন্ধুর সঙ্গে বিতর্কের পর রক্ষণশীল খালিদ রাজি হয়, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোনো সিনেমা দেখবে এবং তার দাদার দেওয়া দীর্ঘকালের হিতোপদেশের সঙ্গে এর গভীরতা তুলনা করবে। প্রযোজক হালাওয়ানির পরিকল্পনা হচ্ছে ক্যানাস, লন্ডন, বৈরুত, কায়রোসহ সমগ্র আরববিশ্বে ছবিটি ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ আরবদর্শকদের মধ্যে মিশে যাওয়া।

প্রিন্স আল-ওয়াহিদও ভাবছেন স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে মূলধারার দর্শককে দেখাতে_ 'আমরা বদলাচ্ছি আমাদের দেখানোর ধরণ; কেননা, সৌদির প্রচলিত কাজগুলোতে বাস্তবতা নেই। ... আমরা সাধারণ মানুষের চিন্তার জগতটাকে পাল্টে দিতে চাই। ... আইন ও যুক্তির মাধ্যমে আমি প্রশাসনের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত আছি। ' খবর হচ্ছে, আধুনিক মানসিকতার এই প্রিন্স আরো নতুন নতুন সৌদি সিনেমা বানানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। [রুদ্র আরিফ : খিলক্ষেত, ঢাকা : নভেম্বর 2006]


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।