চিত্রদীপ জ্বেলে রেখো ময়ূখ পিদিম; রাত্রি-কথায় বেঁধে নেবো ভোরের খোঁপা। আজ ছুটির দিন বলেই বিছানা ছাড়তে দেরি হয়েছিলো । আমার ধারণা ঘুমের আমেজটা মূলত শুরুই হয় সকালে। যদিও আমার মনে হয় এটা খুব কম লোকেই বোঝে। তবে যারা ঐ বাণীকে পরম সত্য বলে মনে করেন প্রকৃতির সৌন্দর্য বা জ্ঞানার্জন ভোরের আলোয় করতে হয় কিংবা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে গেলেও ভোরের বাতাসের বিকল্প নেই, তাদের কাছে আমার এ ঘুম বিষয়ক ফ্যান্টাসি হাসির উদ্রেক করা ছাড়া আর কিছুর জন্ম দেবে না তা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।
গত সপ্তাহে একটা ছবি মুক্তি পেয়েছে যে সংবাদ আসা – যাওয়ার পথে দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার দেখে জানা হয়ে গিয়েছিলো। তাই গতকালই ছবিটা দেখার প্রস্তুতি হিসেবে টিকিট কেটে রেখেছিলাম।
পকেটে টাকা ছিল বলেই কিনা জানিনা, সন্ধ্যেটা চমৎকার লাগছিলো। সন্ধ্যের ফুরফুরে বাতাসে হাঁটতে গেলে বগলের নীচে বান্ধবীর হাত থাকা সবসময় , সবার জন্য প্রযোজ্য তাও নয়। আবার এরকমও হতে পারে আমার বান্ধবী-হীন শূন্যতা বা আক্ষেপ ঘোচাতে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি।
ছবির শেষাংশ বিয়োগান্তক হলেও ছবিটা আদতে ভালোই ছিল। ছবির বিষণ্ণ অংশটুকু বাদ দিয়ে যে অংশগুলো ভালো লেগেছিল তা চিন্তা করে দেখি আমার মনটা আকাশে উড়তে শুরু করেছে। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ভাবতে ভালো লাগছিলো যে ছবির নায়কটির মতো আমিও ইচ্ছে রাজ্যের কোনো মালিক। একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিপতি – যার একটি কুঁড়েঘর আছে। ঘরের বারান্দায় খাঁচাতে রাখা একটা ময়না পাখি আছে।
গরু-ছাগল চড়াবার জন্য বিস্তীর্ণ প্রান্তর আছে। আর আছে একটি ডিঙি নৌকো।
ছবিটিতে নায়কের একটাই কষ্ট ছিল যে, তার কথা বলার জন্য কোনো মানুষ ছিলো না। তাই প্রতিদিনই সে ময়না পাখিকে লোভ দেখাতো যে, কোনোদিন যদি সে কথা বলার জন্য একজন সঙ্গিনী খুঁজে পায় তাহলে সে পাখিটাকে মুক্ত করে দিবে। একটা ভালো ছবি দেখলে তার রেশটা অনেকক্ষণ থাকে বলেই বুঝতে পারছি যে, এই ছবিটার টুকরো টুকরো খণ্ড-চিত্র , জীবনদর্শন , নদীতে দাঁড়ের শব্দ আর কাশবনে নায়কের বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য আমার ঘুমকে রঙিন করে রাখবে সকাল অবধি।
ছবি দেখা শেষ করে ভাবছিলাম যে, আজ হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরবো। সিনেমাহলে থাকার কারণে টের পাইনি বাইরের আকাশ ভেতরে ভেতরে এমন ফুঁসে ছিল। দু’মিনিটও মনে হয় যায়নি, মুহূর্তেই এক দমকা বাতাসে রাজ্যের সব ধুলো-বালি , ছেঁড়া কাগজের টুকরো নিশ্ছিদ্র কোনো জায়গা না পেয়ে আমার নাকটিকেই পছন্দ করে বসলো। এ যে দেখছি ভীষণ যন্ত্রণায় পড়লাম। নাক , চোখ জ্বালা করছে সমানে।
বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে ইচ্ছে করছে কানে তুলো গুঁজে রাখি। বাতাসের বেগ দেখে মনে হচ্ছে ঘূর্ণি নাচনে পুরো শহর দৌঁড়ুচ্ছে। এ মুহূর্তে চোখে ঠিক মতো কিছু দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম, দৌঁড়ানোর ডাবল-মার্চে আমিও কখন যেন নাম লিখিয়ে ফেলেছি আলগোছে। আকাশের দিকে না তাকিয়েও আমার ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারছিলাম আকাশ রাতের অন্ধকারেও লাল , খুনে এক রঙে ঢেকে আছে।
কিছুক্ষণ আগের দেখা ছবির যে দৃশ্যের ভাবনায় সুখ সুখ একটা অনুভূতি কাজ করছিলো ভেতরে, কখন যে সে অংশটায় আতংক এসে বাসা বেঁধেছিল যার ফলে দেখলাম ঘরে না ফেরা মানুষগুলোর সাথে আমিও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌঁড়ুচ্ছি।
আশপাশ থেকে দড়াম, দড়াম শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম এই ঘূর্ণি বাতাসের তাণ্ডব ছাপিয়েও। শহরের কোন গলি ঘুপচির টিনের চালা উড়ে এসে ডেভিড কপার ফিল্ডের জাদুমন্ত্রে শূন্যে ভাসছে এখন তা দেখার আর সে কৌতূহলও নেই আমার মাঝে বিন্দুমাত্র। বুল-ডোজার দিয়ে বস্তি গুঁড়িয়ে দেয়া হয় বলে অসহায় মানুষগুলোর বাসস্থানের দাবীতে নিজেকে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে আন্দোলনে শরীক করলেও এই মুহূর্তে সরকারী নির্দেশ পালনকারী বুল-ডোজার চালকদের ধন্যবাদ দিতে লজ্জা পেলাম না মোটেও। কারণ তা না হলে আরো কতশত টিনের চালা যে আজ আকাশে উড়ে বেড়াতো তাদের চকচকে বা ভোঁতা কোণায় আমাকে আঘাত করতে কে জানে ! সাঁই করে একটা মোটর সাইকেল প্রায় আমার গা ঘেঁষে চলে গেলো। ক’দিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম যে, রাস্তায় এক সার্জেন্ট দুইজন আরোহীকে হেলমেট না পড়ার জন্য জরিমানা করেছেন এবং আরও সংবাদ ছিল শহরের বিভিন্ন চেক পোস্টে হেলমেট-বিহীন কোনো আরোহীকে পাওয়া গেলে তাদের জোরপূর্বক হেলমেট কিনতে বাধ্য করা ।
যদিও এখন মনে হচ্ছে এসব নিয়ম হঠাৎ করেই গজিয়ে ওঠে কিছুদিনের জন্য সরকারী খেয়ালে কিংবা পত্রিকা – নিউজ চ্যানেলে । তা না হলে আমাকে অতিক্রম করে যাওয়া আরোহীকে কেন দেখলাম না হেলমেট পড়তে !
এরমাঝেই ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। চটাস চটাস শব্দে চামড়ায় ফোঁটাগুলো পড়ছে বলেই ইচ্ছে করছে একেকটা ফোঁটার ব্যাস মেপে দেখতে। মেঘ দেখলে যে আমার মনে এতকাল সুখের দোলা ঢেউ খেলেছে আজ সে মেঘের ভার কতখানি ভয়াবহ তা কাছ থেকে অনুভব করতে পারছিলাম। অথচ আশ্চর্যের বিষয় যে, স্কুলের পাঠ্য বইতে মেঘের সমার্থক শব্দগুলোও যেন আজ আমার সাথে সাথে এই মুহূর্তে দৌঁড়ুচ্ছে রণন রণন প্রতিধ্বনিতে – জলধর , জীমূত , বারিদ , নীরদ , পয়োদ ।
মেঘের গভীর নিনাদে আমি যখন রীতিমত হাঁপাচ্ছি, ঠিক তখনই অমাবস্যার অন্ধকারকে কাছে ডেকে নিতেই যেন রাস্তার বাতিগুলোও নিভে গেলো অকস্মাৎ। যদিও এটা একটি গতানুগতিক ব্যাপার যে, ঝড়-বৃষ্টির মেঘ-মল্লারে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ চলে যাবে । নিজের বাড়ি হলে না হয় হাতড়ে হাতড়ে এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়া যেতো, কিন্তু এ মুহূর্তের বেরসিক লোডশেডিঙে নিজেকে অন্ধজনের চেয়েও বেশী অসহায় মনে হচ্ছিলো। সান্ধ্য-কালীন শো দেখতে গেলেও যে পঞ্জিকা দেখে পা ফেলতে হবে সে কথা কে আর জানতো ! বাড়ি ফিরে গেলে আজ অবশ্যই মনে করে দেখতে হবে এখন বাংলা কোন মাসটি চলছে।
মনে আছে, গতবার এরকম এক ঝড়- বৃষ্টির দিনে কেমন এক ভেজা ভেজা অনুভূতিতে গভীর রাতে আমার আরামের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো।
জানালার থাই গ্লাসের ফাঁক গলিয়ে পানি ঢুকে আমার বিছানার একটা অংশ ভিজে ভিজে কেমন তুলতুলে হয়ে গিয়েছিলো। ঘুমের ঘোরে সেখানটায় পা পড়তেই ঘুম থেকে জেগে আঁতকে উঠে বসেছিলাম। চার দেয়ালের নিরাপদ বেষ্টনীতে থেকে শুধুমাত্র জানালার ফাঁক গলে পানিতে বিছানা ভিজে যাওয়ায় সেদিন ভীষণ বিরক্ত হলেও ঘুম ঘুম চোখে গায়ে দেবার কাঁথাটা গুঁজে দিয়েছিলাম জানালার মুখে। পরদিন সকালে পত্রিকায় জেনেছিলাম উপকূলীয় অঞ্চলের সাইক্লোনের খবর। সেদিন সাইক্লোনের বীভৎস রূপ টের পাইনি বলে আজ খোলা আকাশের নীচে যেন সেদিনের প্রতিশোধ তুলে নিলো প্রকৃতি।
বৃষ্টি বিলাসিতায় কতদিন কল্পনা করেছি একটা হরর মুভি বা কোনো উপন্যাস পড়বো চা পান করতে করতে। বুঝি বা একটুখানি বৃষ্টির ছাঁট আঙুলে স্পর্শ করতে বারান্দায় গিয়েও শূন্যে হাত বাড়িয়েছিলাম। আর এখন খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড শীতে গা কাঁপছে আমার। পানিতে ভিজে যাচ্ছিলো পুরো শরীর।
যখন এসব ভাবছিলাম ঠিক তখনই একটা লোক দৌড়ে এসে আশ্রয় নিলো আমি যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম খানিকক্ষণ আগে।
দ্রুতলয়ে হাপরের মতো তার বুকের ওঠানামা শেষ হয়ে তার চোখ অন্ধকারে সয়ে এলে হয়তো তখনই সে টের পেয়েছিলো আমার উপস্থিতি। বিদ্যুৎ চমকের রশ্মিতে তার চোখের উপর যখন আমার চোখ পড়লো, তাকে দেখে আমি হতবাক হলেও পর মুহূর্তেই আমার মাঝে যেন কোনো বুনো-মোষের উথাল নাচন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। হয়তো তা আঁচ করতে পেরেই চমকে উঠলো সে লোকটাও।
ছয় বছর পর দেখলাম তাকে। আসলে দেখলাম বললে ভুল বলা হবে, এই অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না।
বলা যায় ছয় বছর পর তার অস্তিত্ব অনুভব করলাম। এতকাল পর লোকটাকে দেখে আমার মাথার শিরাগুলো দপদপ করে উঠলো। সে লোকটাও মনে হয় এই অন্ধকারে আমাকে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে। কিছুক্ষণ আগের ঘূর্ণি বাতাসে যখন রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো দৌঁড়ুচ্ছিলাম তখন যদি একটা টিনের চাল উড়ে এসে আমার মুণ্ডুটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতো কিংবা ঐ মোটর সাইকেলের ধাক্কায় যদি বেকায়দায় আমার প্রাণটাই চলে যেতো, তাহলে হয়তো এই দুর্যোগের রাত্রিতে আমার বাড়ির লোকগুলো এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু সংবাদ পেতো না। যেমন করে পাবে না আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির বাড়ির মানুষগুলোও যদি এখন আমার পরম শত্রু এই ফরহাদ হাসানের গলা টিপেও ধরে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করি।
বাইরে ঝড়- বৃষ্টির যে হারে দাপাদাপি চলছে তাতে তার আর্তচিৎকার ইথারেই হারিয়ে যাবার কথা ।
ব্যাপারটা মাথায় আসতেই মনে হলো তাকে একটু ভয় দেখানো যাক। তার দিকে দু’ পা এগোতেই সে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। চোরা চোখে সে হয়তো বা এক পলক দেখে নিলো আকাশটাও। বৃষ্টি ধরে এলো কিনা।
আর ফাকে ফাঁকে আমার গতিবিধির উপর নজর রাখতেও সে ভুল করছিলো না । ছয় বছর আগে আমার ছোট বোনকে যখন সে ডিভোর্স দিয়েছিলো তখন অনেক চেষ্টা করেও আমরা কেউ পারিনি তাদের সংসারটাকে টিকাতে। এই বদমাশটাও এমন হারামি যে, টুনুকে ছোট বোনের কোল ছাড়া করবে ভয় দেখিয়ে দেন-মোহরের টাকাটাও শোধ করেনি। মনে মনে কতদিন ভেবেছি ব্যাটাকে হাতের নাগালে পেলে মাথা থেঁতলে দেবো। ঠ্যাং ভেঙে দেবো।
খুনও হয়তো করে ফেলবো। আজ এতদিন পর তাকে হাতের নাগালে পেয়েও কিছুই করতে পারলাম না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই অন্ধকারে দাঁড়িয়েও মরমে মরে যাচ্ছে। বরং এখান থেকে পালাতে পারলেই যেন বেঁচে যায় সে। থেকে থেকে বিজলী চমকের আলোয় তার সংকুচিত হওয়া দেখে স্পষ্টতই মনে হচ্ছে অন্যায়টা তারই ছিল।
একই অনুভব তার মাঝেও কাজ করছে কিনা জানার অবশ্য কোনো উপায় ছিলো না আমার।
তাকে কিছু বলার জন্য আমি মুখ খুলতেই সে টুপ করে এই ঝড়ের মাঝেই রাস্তায় নেমে দৌঁড়োতে লাগলো। কয়েক মিনিট আগের উন্মত্ততা ভুলে গিয়ে আমি না হেসে পারি না। এ রকম একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু ভয় ছাপিয়ে যে মানুষ আমার মতো একজন নিরীহ মানুষকে ভয় পেতে পারে, তার মাঝে বুক ভরে শ্বাস নেবার শক্তি আদৌ আর অবশিষ্ট আছে কিনা তা আমাকে এই মুহূর্তে ভাবিয়ে তুললেও কয়েক ঘণ্টা আগের দেখা রুপালি পর্দার দৃশ্যগুলো আস্তে আস্তে আবার আমার ভাবনায় ফিরে আসতে লাগলো।
ঝড়ো বাতাসের বেগ কমে আসছে ধীরে ধীরে ।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টিটা ধরে এলে বাড়িও পৌঁছাতে পারবো নিরাপদে। আমার ঘুমোতে কখনোই সমস্যা হয় না। হয়তো আজকের এই ঝড় – বৃষ্টি , ফরহাদ হাসান এর সাথে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যাওয়া , জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি ,সন্ধ্যের ছবির নায়কের জীবনচরিত সব নিয়ে কোনো সুন্দর স্বপ্নও দেখে ফেলতে পারি।
( সমাপ্ত ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।