'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'
2003 সালে মারিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় সিসিডির এক কর্মশালায়। এরপর বন্ধুত্ব, প্রেম খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই। আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার গণ্ডি পেরিয়ে আজকের কাগজে রাজশাহীর দায়িত্ব পেয়েছি। বাসার কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলি ওই বছরের অক্টোবর মাসে। কিন্তু পর্যাপ্ত আয় না থাকায় সংসার পাততে পারছি না, বাড়িতেও জানাতে পারছি না।
ফলে মারিয়া তার মতো হলে থাকে আর আমি থাকি বন্ধুদের সঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়ে। সকালে কিছুটা সময় দেখা করতাম। ক্যাম্পাসের মধ্যেই এখানে ওখানে ঘুরে সময় কাটাতাম। তবে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতার সুবাদে ক্যাম্পাসে আমার পরিচিতি অনেক বেশি। তাই চেষ্টা করতাম খুব খোলামেলা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানে বসে গল্প করতে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যারা দেখেছেন, তারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ফুলগাছ ভরা জায়গাটা কতো খোলামেলা। বন্ধুবান্ধব নিয়ে দল বেঁধে অনেকেই সেখানে আড্ডা দেয়। তিন পাশ দিয়ে রাসত্দা। রাসত্দার অন্যপাশে অডিটরিয়াম, রাকসু ভবন, প্রেসকাব আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্ট্যান্ড। মানে আমি বোঝাতে চাইছি যে স্পট হিসেবে সেটি সম্পূর্ণ পাবলিক স্পট।
তো, প্রায়ই আমরা সেখানে রাসত্দার পাশে একটি বেঞ্চিতে বসে স্বাভাবিক দূরত্ব ও ভদ্রতা বজায় রেখে গল্প করি। তারিখটা মনে নেই। 2004 সালের একেবারেই শুরুর দিকে সম্ভবতঃ (তার আগেও হতে পারে)। অডিটরিয়ামে শিবিরের কর্মী সম্মেলন হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা এসেছেন।
সে এক মহা হুলুস্থূল ব্যাপার। আমি আর মারিয়া যথারীতি বেঞ্চিতে বসে গল্প করছি। হঠাৎ করেই দেখি আমাদের সামনে দিয়ে 6 জন ছেলে হেঁটে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। আমরা গল্পই করছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেনো কাকে ডাকছে, 'ওই একটু উঠে আয় তো'।
আমি তাকিয়ে বুঝলাম, ওই 6 জনের একজন ডাকছে। কিন্তু কাকে? তাকিয়ে তো আছে আমার দিকে। কিন্তু আমাকে তো তুই বলে ডাকার কথা নয়, আমি তো তাদের ইয়ার-দোসত্দ হিসেবে চিনতে পারছি না। কাকে ডাকছেন এমন ভঙ্গি করতেই তাদের মধ্যে মোটা করে একজন আমার উদ্দেশ্যে বললো, 'তোকেই ডাকছি। এদিকে আয়।
' বেশ বিব্রত পরিস্থিতি। চিনছি না, অথচ তুই তোকারি করছে! অগত্যা বেশ বিব্রত হয়েই উঠে তাদের কাছে গেলাম। কাছে যেতেই 6 জন ঘিরে ধরলো আমাকে।
মোটা করে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলো, 'ওই ছেমরি তোর কে হয়?'
'বউ', বললাম আমি।
এবার চোখে চশমা নিয়ে আমার প্রায় অর্ধেক সাইজের এক ছেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, 'এখানে বসে আছিস ক্যান?'
'দেখতে পাননি কেনো বসেছিলাম?' একটু উষ্মার সঙ্গে বললাম।
হঠাৎই খেপে উঠলো আমার ডানপাশের ছেলেটি। গায়েগতরে বেশ শক্তি ধরে। চট করে সে এসে আমার গেঞ্জির কলার চেপে ধরলো। এ ধাক্কায় বেশি খানিকটা পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো, 'দেখতে পাইছি বলেই তো তোকে ডেকেছি।
এখানে বসা যাবে না। '
সে অবস্থাতেই আমি তাদের প্রশ্ন করলাম, 'গল্প করাটা দোষের কী?'
'জানিস না, এই ক্যাম্পাস শিবিরের? আমরা শিবিরের কর্মী। আমাদের দায়িত্ব কোনো ছেলে-মেয়ে এই চত্বরে একসঙ্গে বসতে পারবে না। ', এবার আরেকটু সামনে এগিয়ে আমার মুখোমুখি হয়ে জবাব দিলো গতরে অর্ধেক।
'কিন্তু এমন তো কোনো আইন নেই।
আর আমরা তো অন্যায় কিছু করছি না। ', বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। হঠাৎ করে আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরিয়ে দিয়ে কলার ধরণেওয়ালা আমাকে বললো, 'এখান থেকে জান নিয়ে ভাগ। এরপর তোকে দেখলে খারাপি আছে কপালে।
একটা কথা বলবি তো মেরে মুখের সেপ চেঞ্জ করে দেবো। ' মারিয়াকে উদ্দেশ্য করে সেই অর্ধেক গতরের ছেলেটি বললো, 'ওই তোর এইটাকে বুঝাবি। যা বলছি তা করতে বল। না হলে তোর সামনে ওকে টুকরা টুকরা করে ফেলবো। ' যথারীতি এই কথায় কাজ হলো।
আমার বউ আমাকে জোর করে ধরে সরিয়ে নিয়ে গেলো। দেখলাম, ওই চত্বরে বসে থাকা সবার ওপরই চলছে একই কায়দায় শিবিরীয় থেরাপি।
কিন্তু বিষয়টি আমি মেনে নিতে পারলাম না। আমি তখন রাগে কাঁপছি রীতিমতো। অপারগতা আর অমতার রাগ।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি তখন ছিলেন এখনকার কেন্দ্রীয় নেতা রেজাউল করীম। সেক্রেটারি ছিলেন ফারুক (পুরো নামটি মনে আসছে না)। তারা তখন অডিটরিয়ামে স্টেজে। কিন্তু আমার তর সইলো না। আমি দু'জনকেই মোবাইল করলাম।
সেক্রেটারি ফারুক বেরিয়ে এলেন। হুমকিদাতা গ্রুপ তখন অদূরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে। আমি পুরো বিষয়টি ফারুককে খুলে বললাম। কিন্তু দেখিয়ে দেয়ার আগেই তাকিয়ে দেখি, ওমা, সব পরিস্কার। ওই গ্রুপের কেউ আর আশেপাশে নেই! ফারুক যথারীতি অস্বীকার করলেন, তারা তাদের সংগঠনের কেউ নন।
কী আর করা! বিষয়টি ক্যাম্পাসের সাংবাদিক বন্ধুদের জানালাম। তারা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই 6 জনের নাম পরিচয়ই বের করে আনলো। সবাই শিবিরের হল পর্যায়ের নেতা। এদের নেতৃত্ব দেয় বঙ্গবন্ধু হলের শিবির নেতা মোয়াজ্জেম।
এই মোয়াজ্জেমের সঙ্গে পরে পরিচয় হয়েছিলো সম্পূর্ণ অন্য এক প্রোপটে।
সেই বিষয়টি আর বলতে চাই না। তবে পরের বার যখন পরিচিত হলাম, তখন মোয়াজ্জেম বারবার করে অনুরোধ করছিলো, সেদিনের বিষয়টি যেনো ভুলে যাই। মোয়াজ্জেমের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক হবার পরেও সে আমার বাসায় আসেনি। আমার সনত্দান জন্ম নেয়ার খবর পেলেও বাসায় দেখতে আসেনি। একদিন দেখা হলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিষয়টা কী? সে জানালো, সে এখনো নাকি লজ্জিত।
বললাম, 'কেনো করো এইসব। ' মোয়াজ্জেমের উত্তর, 'সংগঠনের সিদ্ধানত্দেই এইসব একটু-আধটু করতে হয়। ' মোয়াজ্জেম সম্ভবতঃ এখন শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নেতা।
ঘটনাটির পর আমি অনেক ভেবেছি। আমি দেখেছি, ঢাকা কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এরা এমন সাহস দেখায় না! তাহলে রাজশাহীতে কেনো দেখায়? আসলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংগঠনটি খুবই শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে।
অনেকটা মতাতেই আছে তারা! শক্তিশালী হবার পর সংগঠনটি দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের কাছে এখন দখলদারিত্ব আর পেশিশক্তির মহড়া মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মের কথা মুখে বলে ঠিকই, কিন্তু করে দখলদারিত্ব অটুট রাখার রাজনীতি। ঠিক যেমনটি ছাত্রলীগ, ছাত্রদল করে। অর্থ্যাৎ মুখে যতোই ধর্মের কথা বলুক, মতায়িত হবার পর শিবিরের সঙ্গে এেেত্র অন্যদের পার্থক্য মেলে না।
দখলদারিত্ব বজায় রাখতে আর সংগঠনগুলোর মতো তারাও একই পথ ধরে। তাহলে ইসলামী আন্দোলন বলে চিৎকার করে তাদের মতায়ন তো আলাদা কিছু দিচ্ছে না। তারাও তো দখলদার। তারা তো মুক্ত চিনত্দার কিংবা স্বাধীন চলাফেরার ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাহলে শিবিরের তথাকথিত ইসলামী আন্দোলন কি সত্যিই ইসলামী আন্দোলন, না নিজেদের মতায়িত করে শোষণের মঞ্চ প্রস্তুত করার আন্দোলন?
এরপরের পোস্টে থাকবে : গোলাম আজমের পোস্টার রাজনীতির কোথায় ইসলাম?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।