সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার
কর্সিকার ফেরী ইটালী ও ফ্রান্সের বিভিন্ন শহর থেকে ছাড়ে। আমাদের জন্যে সুবিধাজনক ছিল ইটালীর লিভোরনো বন্দর থেকে ফেরী নেয়া। মিউনিখ থেকে ফেরীর টিকিট ইন্টারনেটে আগেই করে রেখেছিলাম। সুতরাং বন্দরে পৌছে টিকিট পাবো কি না পাবো, তা নিয়ে কোন ভাবনা রইল না। 25 শে জুন রোববার সকাল ন'টায় ছাড়বে ফেরী, আমাদের দেড় ঘন্টা আগে বন্দরে পৌছুতে হবে।
শনিবার সকাল থেকেই ছোট গাড়ীতে বোঝাই শুরু হলো। সামনে আমাদের নিজেদের বসার জায়গাটুকু ছাড়া আর কিছুই খালি রইল না। লটবহর তো কম নয়! তাবু, কাপড়চোপড়, রান্নাবান্নার তৈজসপত্র সবই সাথে নিতে হলো। রওয়ানা হয়েই সুপারমার্কেট থেকে আরো কিছু যোগ হলো।
সাতশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অষ্ট্রিয়ার ব্রেনার পাস পেরিয়ে লিভরনোর কাছাকছি একটা হোটেলে রাত কাটালাম।
রাতে হোটেলের লাগোয়া এক পিজা রেষ্টুরেন্টে নৈশভোজনের সাথে বিশ্বকাপ দেখা হলো। পরদিন সকাল ছ'টায় রওয়ানা হলাম লিভোরনোর দিকে। নাস্তা করার সময় হলো না, তাই হাইওয়ের পাশে এক পেট্রোলপাম্পের দোকানেই এক কাপ করে কফিতে নিজেদেরকে তাজা করে নিতে হলো।
বন্দরে পৌছানোর একটু আগে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে ঘাবড়ে গেলাম বেশ। দুরু দুর বক্ষে তাই আটটায় পৌছলাম 'মবি লাইনের' অফিসের সামনে।
শত শত গাড়ী ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায় লাইনে। বিভিন্ন দ্বীপের বিভিন্ন শহরের উদ্দেশ্যে। এর মাঝে নিজেদের লাইন খুজে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তারপরও বেশ দ্রুতই ইটালীয়ার অরাজকতায় অভ্যস্ত হয়ে সঠিক লাইন খুজে পেলাম। আমার মতো বাংলাদেশীর জন্যে এ অরাজকতা তো কিছুই নয়।
তারপরও আমরা ঘেমে নেয়ে উঠলাম গরমে।
জ্াহাজের খোলসে গাড়িটিকে আপাত: বিসর্জনে ছেড়ে সবচেয়ে উপরের ডেকে উঠে আসলাম। নীচের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরা আরামবহুল গদি এই গরমের মাঝেও আমাদের ভেতরে কোন লোভ জাগাতে সক্ষম হলো না। কাঠফাটা রোদের মাঝে জাহাজের রেলিংএর পাশে দুটো ইজিচেয়ারে বসে ঘামতে ঘামতে জাহাজ ছাড়ার অপেক্ষায় রইলাম। মাঝে মাঝে সামুদ্রিক বাতাস বহুপ্রতিক্ষীত প্রেমের ছোঁয়াচ বুলালেও রোদের তাপ তাতে বাগড়া দিল বারবার।
যান্ত্রিক আওয়াজে ইটালীয়ান, ফরাসী, ইংরেজী ও জার্মান ভাষায় আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর পরই ঠিক ন'টার সময় ছাড়লো জাহাজ। সামুদ্রিক বাতাস তার প্রেমপরশে উড়িয়ে দিল ঘামের শেষ ফোটাটুকু। আমরা ইজিচেয়ারে পাশাপাশি আরামে গা এলিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে পেছনে মিলিয়ে গেল ইটালীর সমুদ্রতট, আর সামনে তখন ভুমধ্যসাগরের অসীম নীলাভ জলরাশি। জাহাজের ডেকে ডেকে তখন আধা উদোম ভ্রমণার্থীর এদিক সেদিক ইতস্তত: ঘোরাফেরা।
চার ঘন্টার সমুদ্রভ্রমণ আধ ঘন্টার মাঝেই যেন শেষ হয়ে গেল। ছোট্ট একটা কর্সিকার প্রায় লাগোয়া দ্বীপ পেরিয়ে যখন কর্সিকার উপকুলভাগ চোখের সামনে স্পষ্ট হতে শুরু করলো , তখন ঘড়ির কাটায় দুপুর সাড়ে বারোটা। প্রথম দেখা গেল শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আমি পাহাড় ভালোবাসি, তারপরেও অজানা পরিবেশের কথা ভেবে গুড়গুড় করে উঠলো বুক। আস্তে আস্তে সেই পাহাড়ের গায়ে স্পষ্ট হলো বাড়ীঘর, রাস্তাঘাট।
বাস্তিয়া বন্দর, আমাদের যেখানে পৌছানোর কথা, স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। মোটর বোটে করে ফরাসী পাইলট এলো, বন্দরে ধীরে ধীরে থামলো আমাদের জাহাজ।
আমরা সবাই জাহাজের খোলে গাড়ীতে বসে। বিশাল দরজা ঘড় ঘড় শব্দে খোলা হলো। আমরা বেবিয়ে এলাম কর্সিকার মুক্ত বাতাসে।
সামুদ্রিক বাতাসে ও সকালের নাস্তার সল্পতার কারনে চো চো করে উঠলো পেটের ভেতর। বন্দরের পাশেই একটা খোলা চত্তরে রেষ্টুরেন্টে খোলা আকাশের নীচে বসে পেট পুজা সারা হলো। এখন ক্যাম্পিংএর ভালো পছন্দসই জায়গা খোজার পালা। আমরা বেশ কিছু ঠিকানা নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো এ শহর থেকে চলি্লশ কিলোমিটার দুরে ছড়ানো ছিটানো।
নেভিগেশানকে ঠিকানা জানিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম সেই অজানার দিকে। পাহাড়ী চড়াই উতরাই পেরিয়েই যে নৈসর্গিক দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে, তাতেই অভিভুত, পাগল হয়ে উঠলো মন। এত সৌন্দর্য জীবনে একসাথে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়লো না।
চলবে.....।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।