লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। কলার খোসা বৃত্তান্ত
মোহাম্মদ ইসহাক খান
রাস্তার ওপর পড়ে আছে একটা কলার খোসা। এমনভাবে পড়ে আছে, ভালোমতো ঠাহর করে না দেখলে বোঝাই যায় না।
নিচের দিকে তাকালেও যখন বোঝার কোন উপায় নেই, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হাঁটলে যে কলার খোসাটা চোখে পড়বে না, এটাই তো স্বাভাবিক। কাজেই সাদা শার্ট পড়া লোকটি বিকট শব্দে আছাড় খেয়ে পড়লো এবং তার কাপড়ে রাস্তার ধুলো-কাদা লেগে শার্টটা বিচ্ছিরি আকার ধারণ করতে সময় নিলো না।
লোকটি ব্যথা পেয়েছে বেশ। ডান কনুই ছিলে গেছে, আর বাম হাতটা বেকায়দায় শরীরের নিচে চাপা পড়াতে বোধহয় মচকে গেছে।
পেছন থেকে দুজন পথচারী এগিয়ে এসে লোকটাকে তুলে দাঁড় করাল, প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে দিলো, অসতর্ক হয়ে চলাতে খানিকটা বকাঝকা করতেও ছাড়ল না।
বলল, এরপর থেকে সাবধানে চলবেন মিয়া। রাস্তাঘাটের যে কী অবস্থা, "দিশা লাগিয়ে" না চললে উপায় আছে?
পুরো ঘটনাটাতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে হাসছিল রাজু। হো হো, কি মজা, "চোখ থাকিতেও অন্ধ" লোকটা কেমন ছাগলের মতো "উষ্টা" খেয়ে পড়ে গেল! হি হি। হাসি থামাতেই পারছিল না সে। কপাল খারাপ, এটা ভিডিও করে রাখলে অথবা ছবি তুলে ফেলতে পারলে ফেসবুকে আপলোড দেয়া যেত, কতগুলো "লাইক" পাওয়া যেত!
যে লোকটা আছাড় খেয়েছে, সে এখন চলে যাচ্ছে।
একবার রাজুর হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে যে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, তাতে রাজুর পুড়ে ছাই হয়ে যাবার কথা। রাজু অবশ্য কিছু মনে করলো না। না দেখে আছাড় খেয়ে পড়েছে, আবার রাগ দেখাচ্ছে, লোকটা আচ্ছে "ইয়ে" তো। সে লোকটিকে আরেকটা দরাজ হাসি উপহার দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
*****
রাজু বোকার মতো একটা হাত ওপরে তুলে আছে।
ভাবছে পথ চলতি কোন মানুষ এসে ওকে হাত ধরে ওঠাবে, কিন্তু মজার ব্যাপার হল, কেউ এসে ওকে ধরছে না।
একটু আগেই সে একটা প্রমাণ সাইজের কলার খোসায় আছাড় খেয়ে পপাৎ ধরণীতল হয়েছে। দোষটা ওরই। রাস্তার ওপাশ থেকে একটা মেয়ে হেঁটে আসছিল, তার সামনে একটু "ভাব" নেয়ার জন্য সে যখন ওপর দিকে তাকিয়ে নিজের মাথার "স্পাইক" করা চুলে হাত বুলাচ্ছিল, তখন পায়ের নিচের মাটি সম্বন্ধে যথেষ্ট উদাসীন হওয়াতে সে ধড়াম করে আছড়ে পড়েছে, এবং এখন মনে হচ্ছে নিতম্বের একটি হাড় গুরুতর জখম হয়েছে। আগামী কয়েকদিন কোথাও সে বসতে পারবে বলে মনে হয় না।
আশেপাশে অনেক মানুষ দেখেছে ব্যাপারটা। তাতে কোন সমস্যা নেই, তাই বলে একটা মেয়ের সামনে এভাবে বেইজ্জতি? পৃথিবীকে বড়ই নিষ্ঠুর জায়গা বলে মনে হল রাজুর। মেয়েটাও সুবিধের নয়, একটা মানুষকে পড়ে যেতে দেখে সাহায্য করা তো দূরে থাক, সে মুখে ওড়না চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেছে, রাজুকে প্রায় ডিঙিয়ে।
রাজু বহু কষ্টে নিজেই উঠে দাঁড়ালো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
বাসায় যেতে হবে।
*****
শেষ বিকেলে চমৎকার হাওয়া খেলে যায় ছাদে। তাই রাজু ছাদে উঠেছে একটু বাতাস খেতে। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে। নিচে তাকালে বেশ মজা লাগে, কারণ ওদের এই এপার্টমেন্ট দশ তলা, ওপর থেকে দেখলে রাস্তার মানুষগুলোকে একেবারে পিঁপড়ের মতো লাগে।
এখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অফিস ছুটি হয়েছে, ঢাকা শহরের সব কর্মজীবী মানুষজন যেন একসাথে রাস্তায় নেমে এসেছে, বাড়ি ফেরার জন্য বাদুড়ঝোলা হয়ে যাত্রা করেছে।
একটা বাস, গাড়ি, সিএনজি, কিছুই খালি নেই, পুরো রাস্তা ধরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অগনিত যানবাহন। এই সময়টা হল ট্রাফিক জ্যামের "পিক আওয়ার", এখন মানুষগুলোর পনেরো মিনিটের রাস্তা যেতে তিন ঘণ্টা লাগবে।
রাজু ছাদের বাতাস খেতে খেতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
নিচের সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহন আর তার ভেতরের মানুষগুলোকে দেখে তার খারাপ লাগছে না, বরং বেশ ভালোই লাগছে। কবিপ্রতিভা ঝিলিক দিয়ে উঠছে ওর। দিগন্তবিস্তৃত এই ট্রাফিক জ্যাম যেন একটা স্থির জলের নদী। খুব সুন্দর একটা দৃশ্য, সবকিছু থেমে আছে, যেন একটা সমাহিত সৌম্য পরিবেশ। ভালোই তো, ট্রাফিক জ্যাম অস্থিরচিত্ত বাঙালিকে ধৈর্য শিক্ষা দিচ্ছে।
রাজুর মনে হল, ট্রাফিক জ্যাম জিনিসটা ঠিক খারাপ নয়। ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি খেলে যায় তার।
*****
রাজু মনে মনে এমন সব গালি দিচ্ছে, যেগুলো ঠিক ছাপার ভাষায় প্রকাশ করার যোগ্য নয়।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে একটা প্রতিষ্ঠানে সিভি ড্রপ করতে সক্ষম হয়েছে। আজ ওকে ইন্টার্ভিউতে ডেকেছে তারা।
ঠিক দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সময় নিয়ে দু'ঘণ্টা আগে বের হয়েছিলো সে, কিন্তু এই একটি সিগন্যালেই সে গত সোয়া এক ঘণ্টা ধরে আটকে আছে।
মন কু-ডাক ডাকছে ওর। কেন যেন মনে হচ্ছে, চাকরির এই বাজারে যা-ও বা একটা সুযোগ এসেছিলো, তা-ও ফসকে যাচ্ছে।
আজও তেমনি "দিগন্তবিস্তৃত" জ্যাম, শান্ত-সমাহিত পরিবেশ, কিন্তু আজ কেন যেন রাজুর কাছে দৃশ্যটাকে সুন্দর মনে হচ্ছে না।
একবারও মনে হচ্ছে না, সামগ্রিকভাবে জাতির ধৈর্য বাড়াতে ট্রাফিক জ্যাম একেবারে মোক্ষম ওষুধ। ওর এখন তাড়া আছে, এখন দরকার তাড়াতাড়ি পৌঁছনো।
ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে সে যখন ঐ অফিসে পৌঁছল, তখন বাজে সকাল সাড়ে এগারোটা। নাকের ডগা দিয়ে নয়, চাকরিটা ফসকে গেছে দেড় ঘণ্টা আগেই।
*****
রাজু আজকাল আর মানুষের দুর্ভোগ দেখে হাসে না।
সে লক্ষ করেছে, সে যে জিনিসটা নিয়েই একটু হেসেছে, সেই ব্যাপারটিই ওর ক্ষেত্রে ঠিক ঠিক ঘটে গেছে, এবং আরও খারাপভাবে ঘটেছে। একে "নিয়তির খেলা" ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়।
(২৪ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।