তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দল মিডিয়া কাঁপানো বক্তব্য দিচ্ছে, সরকারি দল সংবিধানের আওতায় অবাধ, সুষ্ঠুু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমঝোতায় আসতে আপত্তি নেই—এমন বক্তব্য দেয়ার পর বুঝতে কারো বাকি নেই যে, দেশে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রায় এসে গেছে। হতে পারে ২৪ জানুয়ারির আগে, নতুবা ২৪ এপ্রিলের আগে। দুটো অপশনই সংবিধান মোতাবেক। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আন্দোলনের হুঙ্কার ছুঁড়ছে কয়েক মাস থেকেই। কিন্তু আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি তাদের নেই।
তবে নির্বাচনী প্রচারণা ও প্রস্তুতি নিচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। সরকারি দলও জেলা, উপজেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে প্রতিদিনই বসছেন, প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু জনসভা করেছেন। আমাদের দুই নেত্রীই যখন নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গেছেন তখন আমজনতা বুঝে ফেলেছে যে, নির্বাচন অত্যাসন্ন। ফলে চারদিকে নির্বাচনী হাওয়া ধীরে ধীরে বইতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যাচ্ছেন কানায় কানায় ভরে যাচ্ছে শ্রোতা-দর্শকে, বিরোধী দলীয় নেতা যেখানে যাচ্ছেন সেখানেও একই অবস্থা।
সুতরাং ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল নির্বাচন কমিশন ঘোষণা না করলেও মাঠে-ময়দানে রাজনৈতিক দল, সরকার এবং সাধারণ মানুষ যার যার মতো করে নির্বাচনী কাজে নেমে গেছেন।
বাঙালি আসলে নির্বাচন নামক বিষয়টি নিয়ে ক্রমেই এতোটা ব্যস্ত হয়ে উঠছে—যা সচরাচর অন্য কোনো দেশে দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়াতে নির্বাচন হয়ে গেছে। ভোটের আগে বা পরে খুব কম মানুষই এ নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। নির্বাচনে ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভোট দিতে যান, অপর অংশটি যান না।
তাতে রাষ্ট্রের খুব বেশি কিছু যায় আসে না—এমন একটি বাস্তবতা দাবি করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে উন্নত কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো ততোটা মাতামাতি নেই। মিডিয়ায় কিছু প্রচার-প্রচারণা, আলোচনা হয়। দলের কর্মীরা ভোটারদের বাড়িতে বড়জোর একটা প্রচারপত্র দিয়ে আসেন। মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশের আয়োজন তেমন একটা চোখে পড়ে না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে দুনিয়াব্যাপী যতোটা হৈচৈ শোনা যায়, খোদ মার্কিন মুল্লুকে তা ঠিক ততোটা পরিলক্ষিত হয় না। ব্রিটেনেও কিছুটা উত্তাপ লক্ষ্য করা যায় হয়তো। তবে উন্নত দেশগুলো নির্বাচন নামক বিষয়টির সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে অভ্যস্ত, পরিচিতও। সে কারণে এনিয়ে তাদের আগ্রহ, উচ্ছ্বাস, আবেগ অনেকটাই সংযত পর্যায়ে। সেই সব দেশে নির্বাচন কখন আসে কখন যায়—তা এখন অনেকেই টের পায় না।
মানুষ যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ঘরের খেয়ে মোষ তাড়ানোর অবস্থা উন্নত দুনিয়ায় তেমন একটা এখন নেই। তাছাড়া নির্বাচনে কারচুপি করা সম্ভব, প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব তেমন ধারণা ও বাস্তবতা না থাকায় নির্বাচন নিয়ে হৈচৈ-এর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সে কারণে উন্নত দুনিয়ায় নির্বাচন নিয়ে জোয়ার-ভাটা, এতো টকশো, এতো আলোচনা-সমালোচনা, এতো আন্দোলনের হুমকি-ধামকির কথা শোনার প্রশ্নই আসে না। মানুষ ভোটের দিন ইচ্ছে হলে ভোট দিতে যান, পছন্দ না হলে যান না।
তাতে কিছু যায় আসে না। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হচ্ছে, সরকার গঠিত হচ্ছে, দেশ চলছে, এগুচ্ছেও। কোনো সরকার মেয়াদকালে কী কাজ করছে জনগণ সেই কাজের মূল্যায়ন করেই ভোট দেয়। তাতে খারাপ কাজ করে কেউ ভোট পাওয়ার আশা করতে পারে না। এ হচ্ছে উন্নত দেশগুলোর বাস্তবতা।
আমাদের বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্নতর। ১৯৫৪ সালের পর থেকে এই ভূখণ্ডে নির্বাচন খুব একটা নিয়মিত হয়নি। ফলে যখনই সুযোগ পেয়েছে মানুষ ভোট দিয়েছে, নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মানুষ যেভাবে অংশ নিয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। ১৯৭৩ সালেও উত্সাহে ভাটা পড়েনি।
একাত্ম হয়েছিল ১৯৯১, ১৯৯৬-এর জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে। ছেদ পড়েছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে। তবে যেসব নির্বাচনের পরিবেশ অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল সেগুলোতে বৃদ্ধদেরও ভোটদানে উত্সাহী হতে দেখা গেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ভোট দিচ্ছে।
বাংলাদেশে ভোটদানের দৃশ্য দেখার মতো বিষয়। মনে হয় আমাদের জনগণ যে কোনো নির্বাচনকে ভেতর থেকে গ্রহণ করেছে, নির্বাচনকে এক ধরনের উত্সবের আমেজ দেয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে এখন গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যানদের নির্বাচন কতোটা জমে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এসব ছাড়াও সাধারণ একটি স্কুল কমিটির নির্বাচনের আয়োজন দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার অবস্থা। প্রার্থীর যেমন অভাব হয় না, প্রচার-প্রচারণা, পোস্টারিং, ভোটারদের উপস্থিতি—সবই চোখে পড়ার মতো।
এসব নির্বাচনেও এখন প্রার্থীরা প্রচুর অর্থ খরচ করছে। নির্বাচন নিয়ে বাঙালির উত্সাহ, অংশগ্রহণ বেশ চোখে পড়ার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুজুগে বাঙালি নামক প্রবাদটি বাঙালির ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য। যে কোনো নির্বাচন দেখলেই তাতে অংশ নেয়া, প্রচার-প্রচারণায় যোগ দেয়া, প্রচুর অর্থবিত্ত খরচ করা, কর্মী-সমর্থকদের রাতদিন পরিশ্রম করা, মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশসহ যাবতীয় কাজে অংশ নেয়া নিয়ে বাঙালি বেশ আনন্দ অনুভব করে।
এ মুহূর্তে গ্রামগঞ্জের চায়ের দোকানে, এখানে সেখানে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে- বিপক্ষে নানা বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়েও প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে।
বোঝাই যাচ্ছে, সবাই নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। কেউ কেউ নানা কথা শুনে উদ্বেগও প্রকাশ করছে, কেউবা এর বিপরীতে কথা বলছে। বলা চলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় সর্বত্র মানুষের মুখে মুখে নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে, সরকারের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়েও কথা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে, বিপক্ষে নানা কথা হচ্ছে। জামায়াত, শিবির, হেফাজত নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। সব কথাই যে তথ্যভিত্তিক বা যুক্তিনির্ভর তা বলা যাবে না।
সাধারণ এসব মানুষ তাদের বুঝ মতোই সবকিছু নিয়ে কথা বলছেন। বেশির ভাগ কথাই পত্রপত্রিকার নানা শিরোনাম বা টিভি চ্যানেলের খবরাখবরের ওপর ভিত্তি করে, এছাড়া অপপ্রচারের বিষয়টিও রয়েছে। মোট কথা গ্রামাঞ্চলে এখন আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে, বাদানুবাদ হচ্ছে, ফলে সমাজের তলদেশে এখন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে, জোয়ার এসে গেছে। সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে, বিরোধী দলের পক্ষে ও বিপক্ষে, জামায়াত-হেফাজতের পক্ষে-বিপক্ষে কথা হচ্ছে কথা হয় ২০০১ সাল পরবর্তী সময় নিয়ে, কথা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়েও। কথার শেষ নেই, তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদেরও শেষ নেই।
এ মুহূর্তে যখন দুই দলের প্রধানগণ জনগণের কাছে ভোট চাইতে শুরু করেছেন তখন সাধারণ মানুষ স্বস্তির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়া সরকারি দলের এমপি, মন্ত্রীরাও যখন এলাকায় ঘন ঘন যাচ্ছেন তখন মানুষ ধরেই নিচ্ছেন যে, 'নির্বাচনের সময় এলো বলে'—এদের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দও অনুরূপভাবে গ্রামেগঞ্জে যেতে শুরু করেছেন। ফলে সাধারণ ভোটারগণ বুঝেই নিচ্ছেন যে, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুয়ারে প্রায় এসে গেছে। বিভিন্ন দলের সভা-সমাবেশও শুরু হয়েছে।
তাই গ্রামের মানুষ নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও জোয়ার নামক কথাটিও চালু হয়ে গেছে। এসব কথা নির্বাচনের ক্ষেত্রে শতভাগ বিশ্বাস করার মতো কিনা জানি না। তবে দেশে অনেকটা সকলের অজান্তেই এবার নির্বাচনী জোয়ার আসতে শুরু করেছে। তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে যতো ভীতিকর প্রচারণাই গেল কয়েক মাস আগে শোনা গিয়েছিল ৫ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর বিরোধী দল কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে গোপনে তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেই।
আর কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো প্রতিটি নির্বাচনী আসনে কে কে সরকারি বা বিরোধী দল থেকে মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন তা জানা যাবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে হয়তো। অচিরেই হয়তো সেটি পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু আসনে প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ, যাওয়া-আসার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রিহারসেল ইতোমধ্যেই গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়ে গেছে। মানুষজন খোঁজ-খবর নিচ্ছেনও যার যার পছন্দের আসনে যাচ্ছেনও।
ফলে যে জোয়ারটি এখনই নীরবে শুরু হয়ে গেছে বলে খবর পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে সরকারি বা বিরোধী দলের যে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জনগণই তাদের একহাত নিতে পারেন। নির্বাচনটি যদি কেউ ভণ্ডুল করবে বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হয়ে যেতে পারে।
এ জোয়ার থামবে কীভাবে? আমার ধারণা কিছুতেই তা থামানো যাবে না। কেউ তা করতে গেলে ভয়ানক বিপদ আসতে পারে। মনে হচ্ছে বিষয়টি সকলেই অনুধাবন করতে শুরু করেছেন।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নির্বাচনী জোয়ারটি আরো বেগবান হয়ে যাবে, তখন তা রুখবে কে? রোখা কারো পক্ষে সম্ভব হবে কি? বাংলাদেশের ভোটারগণ উন্নত দুনিয়ার ভোটারদের মতো নন যে, মাঠে নামতে যাবে না। বাংলাদেশে যখনই নির্বাচন নিয়ে কোনো দল বাড়াবাড়ি করেছে তখনই জনগণই মাঠে নেমেছে। জোয়ারকে আইলা, সিডর, সুনামি আর নানা নামের জলোচ্ছ্বাসে রূপান্তরিত করতেও এদেশের ভোটারগণ পিছ পা হয়নি। এবার তেমনটি হবে এমন বাস্তবতা আমরা দেখছি না। আমরা বরং উভয় জোটের মধ্যেই নির্বাচনী প্রস্তুতিসহ নানা আয়োজন নিয়ে যেভাবে কাজ করতে দেখছি তাতে মনে হয় সমঝোতা হবে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনও হবে, নির্বাচনী আনন্দে দেশ অচিরেই ভাসতে শুরু করবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।