জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই
‘কেমন আছেন ?’
রায়হান হা হয়ে চেয়ে রইল। একটা মেয়ে। সুন্দরী এবং চটকদার। তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে হা হয়ে ভাবার চেষ্টা করল।
এই মেয়েটিকে কি আমি চিনি ? কে এটা ? তার মনে পড়ল না।
‘কেমন আছেন?’, মেয়েটি আবারও জিজ্ঞেস করল।
রায়হান স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্যা সূচক মাথা ঝাঁকাল। মেয়েটি এবার চোখ বড় বড় করে তাকাল। তার চোখে বিস্ময়।
‘আপনি কথা বলছেন না কেন ?’, মেয়েটি বলল, ‘আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি আপনি কেমন আছেন ?’
‘ভালো আছি’, রায়হান সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
মেয়েটি হাসল। সুন্দর হাসি। আন্তরিক ও উষ্ণ। কিন্তু রায়হান মনে করতে পারল না এই মেয়েটি কে ? কী মুশকিল !
‘আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ?’, মেয়েটি আরেকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
রায়হান ঝটপট করে উত্তর দিল, ‘এমনি। ’
‘মনে তো হয় না। এই রকম মাঞ্জা মেরে কেউ এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকে না। তাও আবার পার্কের গেটের কাছে। ’, মেয়েটি অর্থপূর্ণ হাসি দিল।
রায়হানের গা জ্বলে গেল। কোথাকার কোন মেয়ে এসে হাজির হল এই সময়। অথচ যার আসার কথা তারই খবর নেই। কাজের সময় সব সময় একটা উটকো লোক এসে হাজির হয়। এই দেশে উটকো লোকের সংখ্যাই বেশি।
লামিছার আসার কথা ঠিক দশটায়। সে পৌনে দশটায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু লামিছার দেখা নেই। রায়হান ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে দশ।
লামিছা সম্ভবত ভুলে গেছে। অথবা মেয়েরা যে রকম হয় আর কি, ব্যাপক মাঞ্জা মারা চলছে। যুগ বদলেছে, কিন্তু মেয়েদের মাঞ্জা মারা বদলায় নি।
‘কী হল, আপনি কী ভাবছেন ?’, মেয়েটির প্রশ্নে সম্বিত ফিরল রায়হানের। কী যন্ত্রণা ! এই আপদ কোত্থেকে জুটল ? আর জুটল তো একেবারে সময় মতো।
‘শোনেন, আপনি কি এখনও কবিতা লেখেন ?’, মেয়েটি কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল।
রায়হান কবিতা লেখে। কিন্তু সে কবি না। মাঝে মাঝে ভাবের প্রকাশ ঘটে মাত্র। সেটা ব্যক্তিগত ডায়েরি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
হঠাৎ মনটা হু হু করে উঠলে সেগুলোই কবিতার রূপ পায়। কিন্তু সেই গোপন কথা তো এই মেয়ের জানার কথা না। নাকি গড় পড়তা একটা চাপা মেরে দিল ? যদি লাইগ্যা যায় ।
‘আপনি কবিতা লেখেন না ?’, একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে আবার করল মেয়েটি।
রায়হান জবাব দিল, ‘লিখি, মাঝে মাঝে।
’
‘আপনি কিন্তু ভালো লেখেন। ’
রায়হান একটা সূত্র পেয়ে গেল। এই মেয়েটি কোনভাবে তার কবিতা পড়েছে। তার মানে তার কাছের কেউ হবে। এমন কাছের কেউ যে তার কবিতা পড়েছে।
কে হতে পারে ?
সে ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি শাড়ি পরেছে। বাসন্তী রঙের শাড়ি। কিন্তু শাড়ি পরার ঢংয়ে এমন কিছু আছে যে, বোঝা যায় সে শাড়ি পরায় অভ্যস্ত নয়। কী একটা সুগন্ধি মেখেছে বোধ হয়।
সুক্ষ্ম একটা ঘ্রাণ নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। হাত ভর্তি চুড়ি। লাল ও হলুদ। চুড়ি রায়হানের চোখে পড়ত না, কিন্তু মেয়েটি এমনভাবে হাত নাড়াচ্ছে যে চুড়ির শব্দ কানে লাগছে।
‘আপনাকে পেয়ে ভালো হল।
অনেক ক্ষণ ধরে পার্কে বসেছিলাম। ’
‘কেন, বসেছিলেন কেন ?’
‘আমার এক বান্ধবীর আসার কথা। ও আসে নি। কয়েক বার ফোনে ট্রাই করলাম। খালি বলে, আসছি।
’
রায়হান আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে এগারো।
‘কারো জন্য অপেক্ষা করছেন ?’, মেয়েটির বেমক্কা প্রশ্ন ।
‘না’, রায়হান ঝটপট উত্তর দিল।
‘তাহলে আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী ? চলেন, ওখানে গিয়ে বসি।
’
রায়হান সামনের দিকে তাকাল। পার্কের ঘাসগুলো হলদেটে সবুজ। একটা হালকা শীতল বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে গাছের পাতার সর সর শব্দ হচ্ছে। পার্কের এখানে ওখানে লোকজন হেঁটে বেড়াচ্ছে।
কেউ কেউ ঘাসের উপর বসে গল্প করছে।
রায়হান মেয়েটি দিকে তাকিয়ে বলল,‘না, বসার দরকার নাই। ’
মেয়েটি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। বলল, ‘কেন ?’
‘এমনিই। ’
‘এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি ? কোথাও তো বসবেন ?’
‘আপনি গিয়ে বসুন।
আমি আসছি। ’
মেয়েটি কেমন যেন ঝামটা মেরে হাঁটতে শুরু করল। রায়হান তাকিয়ে রইল। মেয়েটি গিয়ে বসল পার্কের বেঞ্চিতে। তারপর রায়হানের দিকে তাকাল।
রায়হান অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিল।
রায়হান ভাবার চেষ্টা করল। তার তো স্মৃতি শক্তি এত দুর্বল না। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে ভুলে বসে থাকার কোন কারণ তো নেই। তাহলে ? এই মেয়েটি কে হতে পারে ? না, কোনক্রমেই মনে পড়ছে না।
রায়হান আবার মেয়েটির দিকে তাকাল। গোমড়া মুখ করে বসে আছে। গাছপালা দেখছে। গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ওর গায়ে। ফর্সা মুখ।
খাড়া নাক। কপালে একটা বড় লাল টিপ। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। মাথার চুলগুলো ঘন কালো। চুল খোপা করে তাতে একটা কাঠের ঝুনঝুনিওয়ালা কাটা গাঁথা।
না, কোনক্রমেই স্মরণ করা যাচ্ছে না। দূর, মাথা ভোতা হয়ে গেছে। যাক, এই উটকো ঝামেলা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। লামিছার কী যে হল ! রায়হান লামিছার নাম্বারে কল দিল। ফোন বিজি।
এই মেয়ের আরেক সমস্যা। সব সময় ফোন বিজি। কার সঙ্গে এত কথা বলে কে জানে। সামনা সামনি জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘কই না তো। আমার ফোন তো বিজি না।
’
রায়হান মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা হাসল। সুন্দর হাসি। ওর হাসি-মাখা মুখের উপর রোদ-ছায়া খেলা করছে। কেমন একটা আকর্ষণ আছে ওর চেহারায়।
¯িœগ্ধ আকর্ষণ।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকাটা ঠিক হবে না। রায়হান ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। পরিচিত মেয়ে যেহেতু নয়, এমন হতে পারে মেয়েটি কোন ধান্দাবাজ। পার্কে অনেক ধান্দাবাজ মেয়ে থাকে বলে রায়হান শুনেছে।
এমনকি ভাড়া করা প্রেমিকাও নাকি পাওয়া যায়। আবার ভাড়া করা প্রেমিকার ছদ্মবেশে ছিনতাইকারীর সহযোগীও এসে জোটে। এই মেয়েটা কোনটা কে জানে।
রায়হান ভাবল, দাঁড়িয়ে না থেকে রোমান্টিক কোন দৃশ্য ভাবলে ভালো হয়। লামিছা এবং ওর এটা প্রথম ভ্যালেন্টাইনস ডে।
গত কনকনে শীতে ওদের সম্পর্ক হয়। লামিছাই ওর এক বান্ধবীর মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠায়। রায়হান দ্বিধায় ছিল। তার একটা প্রেম করার শখ ছিল। একটা লাবণ্যময়ী তন্বীর চেহারা তার মানসপটে আঁকা ছিল।
মনে মনে ভাবত, কোন দিন সেই লাবণ্যময়ীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এবং সে হঠাৎ করেই প্রেমে হাবুডুবু খাবে। বাস্তবে যে তার প্রেমে অন্য কেউ হাবুডুবু খাচ্ছিল, সেটা জানল লামিছার বান্ধবীর কাছ থেকে। লামিছা নাকি ওর বান্ধবীকে বলেছিল,ওই ‘লবেনজুস’কে না পেলে আর বিয়েই করবে না।
রায়হান বলেছিল, ‘লবেনজুসের দাম তো মাত্র ২ টাকা। একটা কিনে খেলেই হয়।
’
‘অই মিয়া, আপনে কি বলদ নাকি ?’
ওর বলার ধরনে রায়হান ‘বলদ’ হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক সুন্দরী বলতে যা বোঝায় লামিছা তেমন মেয়ে নয়। কেমন যেন একটু রোবোটিক। একটু বেশি শুকনা বলে লামিছাকে ওর বান্ধবীরা ‘কাঠবডি মুড়ির টিন’ বলে ডাকে। হাড্ডি হাড্ডি চেহারার চশমা পরা এই মেয়েটাকে তার ভালো লেগে গেল।
লামিছার চোখ সুন্দর। পাওয়ারফুল চশমার ভেতরে ঢুকে সেই চোখ আরো সুন্দর হয়ে গেছে। রম্বস চোখ। ছলছলে দৃষ্টি। ওর গভীর দৃষ্টির সামনে দাঁড়ালে রায়হান নিজের বুকের কাঁপন টের পায়।
‘নেন, ঝালমুড়ি খান। ’
রায়হান চমকে তাকাল। শাড়ি পরা মেয়েটি একটা ঠোঙ্গা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সর্বনাশ ! এই মেয়ে তো বিরাট ধান্দাবাজ। ঠোঙ্গা খাইয়ে বোঙ্গা বানিয়ে দিয়ে যাবে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।