সাংবাদিকতাকে যিনি ইবাদতের মতো মনে করতেন তার নাম নাজিমউদ্দিন মোস্তান। তিনি আর নেই। লোকচক্ষুর আড়াল হলেন ১৮ আগস্ট-২০১৩। কিন্তু তার রেখে যাওয়া নীতি-আদর্শ ও প্রার্থনাসম ধ্রুপদ ধারার সাংবাদিকতা অমর হয়ে থাকবে। পদ-পদবির দিক থেকে এই মনীষী হয়তো শ্রম-মেধা আর বয়স অনুযায়ী খুব বেশি দূর অগ্রসর হননি।
কারণ তিনি যুগের কৃত্রিম হাওয়ায় গা ভাসিয়ে তৈলমর্দনের প্রতিযোগিতায় কখনো অবতীর্ণ হতে চাননি। সততা, আদর্শ, নৈতিকতা, মননশীলতা, ভাষাশৈলীর কারিগর এই সাংবাদিক সবার অলক্ষ্যেই দেশে বিকল্প সাংবাদিকতার এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে গেছেন। যার মূল্যায়ন করার মতো মনমানসিকতা, সময় কিংবা সেই অনুভূতিটুকুও আমাদের অনেকের নেই। পরিশ্রমী, দূরদর্শী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে তুলনাহীন এই সাংবাদিক তার পেশায় রেখে গেছেন অনন্য এক দৃষ্টান্ত। বয়সে ছোট কিংবা বড় যাই হোক না কেন, এক দিন একবারও তার সঙ্গে যার কথা হয়েছে তিনিও কিছু না কিছু জানতে বা শিখতে পেরেছেন।
২০০৩ সালে জোট সরকারের আমলে তাকে অমর একুশে পদকে ভূষিত করার পর যারা ব্যক্তিগতভাবে তাকে কম পছন্দ করতেন কিংবা ভিন্নমত পোষণ করতেন তাদেরও বলতে শুনেছি, এই সরকার আর যা-ই করুক না কেন অন্তত এই ব্যক্তিটিকে পদকের জন্য মনোনীত করে শত খারাপ কাজের মধ্যে অন্তত একটি ভালো কাজ করেছে। ৬৫ বছরের এই জীবনে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় দেশ কাঁপানো, সাড়া জাগানো এমন অনেক রিপোর্ট করেছেন, যা সত্যিই অনবদ্য শুধু নয়, দেশ-জাতির জন্য প্রকৃত অর্থেই ছিল মঙ্গলজনক। দৈনিক ইত্তেফাকের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও বের করেছিলেন। মাত্র আধা যুগ সময়ে তিনি এই সাপ্তাহিক কাগজটিকে একেবারে শূন্য থেকে যে জায়গায় উন্নীত করেছিলেন, তা 'আল্গা' টাকা-পয়সা বিনিয়োগ ছাড়া অন্য কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে গুণগতমানের দিক থেকে সেই 'সাপ্তাহিক রাষ্ট্র' ছিল অনন্য।
বিকল্প সংবাদপত্র হিসেবে ব্রড সাইজের সেই কাগজটি ছিল মূলত সাংবাদিকদের খোরাক। সপ্তাহের যেদিনটিতে তা বের হতো, সত্যিকার অর্থে যারা তখন রিপোর্টিংয়ে কাজ করতেন, তাদের নব্বই ভাগেরও বেশি এ কাগজটি সংগ্রহ করার চেষ্টা করতেন। কারণ সেখান থেকে সপ্তাহের বিশেষ রিপোর্টের অনেক বড় বড় ক্লু পাওয়া যেত। বিশেষ করে অর্থনৈতিক বিটের সাংবাদিকদের অনেকের কাছেই সাপ্তাহিক রাষ্ট্র পাঠ ছিল অপরিহার্য।
নাজিমউদ্দিন মোস্তানকে 'একজন ভালো মানুষ এবং একজন ভালো সাংবাদিক' হিসেবেই মনে করে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ।
কিন্তু তিনি নিজের আন্তরিক চেষ্টায় কত প্রক্রিয়ায় কত লোককে যে সাংবাদিক, আইনজীবী আর রাজনীতিবিদ বানিয়েছেন সেসব প্রক্রিয়া বা কর্মকাণ্ডের কথা যারা জানেন, তারা নাজিমউদ্দিন মোস্তানের স্মৃতি ভুলে যাওয়া তো দূরের কথা বরং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা অনুসরণের কথা ভাববেন। ইত্তেফাকের দায়িত্ব পালন শেষে রাতে বাসায় গিয়ে তিনি আর ঘুমাতেন না। রাতভর হয় অনুবাদ করতেন, না হয় সেই আমলে (১৯৯৬-৯৮) ইন্টারনেট ঘেঁটে বিদেশি সংবাদ বের করতেন। রাষ্ট্রের জন্য তিনি এভাবেই শ্রম দিতেন। যাতে ইত্তেফাকের কাজে তার কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
মোস্তান ভাই এক সময় প্রচুর সিগারেট খেতেন নিজের বেতনের টাকায়। কিন্তু দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব গ্রহণের পর হঠাৎ করে এক দিন সিগারেট খাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিলেন। তার সহকর্মীরা তো অবাক! জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, চিফ রিপোর্টার হওয়ার পর দিন থেকেই বাইরের লোকজনের অনেকেই সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু তিনি বলতেও পারছিলেন না যে তিনি অন্যের টাকায় কেনা সিগারেট খান না। কাজেই শেষ পর্যন্ত সিগারেট খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
তার সঙ্গে দুই বছরের কিছু বেশি সময় সাপ্তাহিক রাষ্ট্রে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সে সময়টার প্রায় প্রতিদিনই তিনি আমাকে গড়ে এক ঘণ্টা করে সময় সাংবাদিকতার ওপর নানা কৌশল শিক্ষা দিতেন। কোথায় কি প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, কার সঙ্গে কি ধরনের আচরণ করতে হবে। সব কিছুই বাতলে দিতেন, তবে তার প্রতিটি বাক্যের মাঝেই থাকত কমবেশি নৈতিকতার শিক্ষা। তার মতে, শিক্ষিত একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়ের জন্য ভালো সাংবাদিক হওয়ার অন্যতম উপাধান হলো, একান্ত আগ্রহ, কমন সেন্স আর কঠোর পরিশ্রম।
নাজিমউদ্দিন মোস্তান ছিলেন উঁচু নৈতিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, সারা দিন কাজ শেষে আপনি বাসায় ফিরেও সারা রাত জেগে কাজ করেন, বিশ্রাম করেন কখন? জবাবে বলেছিলেন, দিনে করি ইত্তেফাকের চাকরি। আর রাতে করি সাপ্তাহিক রাষ্ট্রের কাজ। তার দৃষ্টিতে ঘুমটা বিশ্রামের জন্য আলাদা কোনো প্রক্রিয়া নয়। সেটাও একটা কাজ।
কাজেই মানুষ একটা কাজ থেকে আরেকটা কাজে নিজেকে ডাইভার্ট করলে তার মাধ্যমেই বিশ্রাম হয়ে যায়। জানি না তার এই উপলব্ধি সত্য কিনা? কিন্তু ১৯৯৮ সালে মাত্র সোয়া দুই বছরের মাথায়ই দেখলাম, তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। তার শরীরের একপাশর্্ব অবশও হয়ে গিয়েছিল। তার পর থেকেই তিনি সাপ্তাহিক রাষ্ট্রও বন্ধ করার পাশাপাশি দৈনিক ইত্তেফাকের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। যদিও তাকে ইত্তেফাক থেকে বলা হয়েছিল, একজন অ্যাসিসস্ট্যান্ট বা টাইপ রাইটার রেখে অফিসে বসে কাজ করার জন্য।
রাজধানীর শুক্রাবাদে রাষ্ট্রের অফিস থাকাকালে দেখতাম কত রথী-মহারথীর আনাগোনা। সবাই তার সঙ্গে আগ্রহ ভরে আলাপ-আলোচনা করতে আসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসে বসে থাকতেন, কখন তিনি বাইরে থেকে রাষ্ট্র অফিসে আসবেন। আর মোস্তান ভাইও তাদের যথাসাধ্য বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। অনেককে পরে মন্ত্রী-এমপি হতেও দেখেছি।
কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর তার সঙ্গে সেই সব রথী-মহারথী খুব কমই দেখা করতে গিয়েছেন।
মোস্তান ভাইয়ের কর্মজীবনের কাহিনী লিখতে গেলে বছরেও শেষ হবে না। রাষ্ট্র প্রকাশে তার বড় মেয়ে নাজমুন্নাহার মিলি ও তার সহধর্মিণী অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সহযোগিতা করতেন। আমরা যারা কাজ করতাম, তারা তার সহধর্মিণীর নাম দিয়েছিলাম 'রাষ্ট্রমাতা'। আর এই রাষ্ট্রমাতা আমাদের যে কতদিন দুপুরে নিজের হাতে রান্না করা খাবার খাইয়েছেন, তার কোনো হিসাব আমার কাছে নেই।
বিশেষ করে আমার পছন্দের ইলিশ মাছের সঙ্গে বেগুনের তরকারির স্বাদ এখনো ভুলতে পারি না। কাজেই এ ক্ষেত্রে তার কিছু স্মৃতি ও কর্মতৎপরতার কথা না বললেই নয়। তিনি রাস্তার ছিনতাইকারীকে ধরে পর্যন্ত লেখাপড়া শিখিয়ে আইনজীবী বানিয়েছেন। সেই ব্যক্তি এখন সুপ্রিমকোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী। সম্ভবত তখন সংবাদে কাজ করতেন সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তান।
পত্রিকার কাজ শেষে রাতের বেলায় যেতেন বাংলাবাজারে। সেখান থেকে বই নিয়ে এসে বাসায় বসে অনুবাদ/সম্পাদনার কাজ করতেন। এ জন্য তার ঘাড়ে একটি কাপড়ের ব্যাগ (ঝোলা) রাখতেন। এক দিন গভীর রাতে বাড়ি ফেরার সময় পুরান ঢাকার রাস্তায় ছুরি নিয়ে একদল ছিনতাইকারী তাকে গতিরোধ করে ব্যাগটি ছিনিয়ে নিতে চাইলে তিনি তা বুকে আগলে রেখে ছিনতাইকারী দলের সর্দারের উদ্দেশে বললেন, ব্যাগটি দিতে পারি, কিন্তু এর ভেতরে যা আছে তা আপনাকে গ্রহণ করতে হবে। সর্দার উত্তর দিল_ আচ্ছা নেব, তবুও তাড়াতাড়ি দিয়ে দে।
অতঃপর তিনি ঝোলার ভেতর থেকে বাংলাবাজারের বই বের করে দিলেন। তখন ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা অনাগ্রহ দেখিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তিনি উল্টোভাবে তাদের গতিরোধ করে সর্দার বা দলনেতাকে বললেন, আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন। এভাবেই পরদিন আসার সময় আবারও কথা হলো। তারপর এক দিন মোস্তান ভাই সেই সর্দারকে বই কিনে ও নিজে ফরম-ফিলাপ করে দিয়ে এসএসসি, এইচএসসি এবং পরে বিএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। এর পর এলএলবি পাস করিয়ে আইনজীবীতে পরিণত করেন।
ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার এক দিন দেখা এবং কথাও হয়েছিল। মোস্তান ভাইয়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ ছিল না। শত কৌতূহল থাকার পরও মোস্তান ভাইয়ের অনুরোধে পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে আর কখনো যোগাযোগ করিনি। আর পাছে নাম-ঠিকানা প্রকাশ হয়ে গেলে ওই ব্যক্তি সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হন সে জন্যই মূলত মোস্তান ভাই সেই আইনজীবীর বিষয়ে আমাকে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।
কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, বাংলাদেশের ইনফরমেশন ও টেকনোলজি (আইসিটি) সেক্টর, বিশেষ করে ইন্টারনেট ব্যবস্থা প্রসারের ক্ষেত্রে সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তানের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আইসিটি রিপোর্টিংয়ের ওপর রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তিনি। এ কথা সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেই অকপটে তারা স্বীকার করবেন। আর এ জন্যই তিনি অর্থনীতির ছাত্র হয়েও 'বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স' শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। কারিগরি পদক পান ১৯৯০ সালে। এছাড়া Special contribution to the ICT sector Journalist Award, BCS, জাতীয় প্রেসক্লাব ও বিজ্ঞান ফোরাম থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাকে।
এ ছাড়া তার সাংবাদিকতার ধরনই ছিল অন্য রকম। আমার মনে আছে, '৯৬ সালের শেষ দিকে একবার তাকে বলেছিলাম, ভাই একজন পলিটিশিয়ানের ইন্টারভিউ ছাপতে চাই সাপ্তাহিক রাষ্ট্রে। প্রথমে তিনি বললেন, আপনি কি রাজনীতিবিদদের দিয়ে বাঁদর নাচ নাচাতে চান? সাপ্তাহিক রাষ্ট্রকে একটি অলটারনেটিভ নিউজ পেপার হিসেবেই পাঠকরা জানেন। কাজেই এখানে গতানুগতিক 'তিনি বলেন, বা তিনি বলেছেন, কিংবা তিনি কেঁদেছেন/হেসেছেন' এ ধরনের রিপোর্ট ছাপাটা কতটুকু প্রয়োজন তা আপনি নিজেও উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। ' এর পর এক দিন তিনি শাহবাগের আজিজ মার্কেটে আহমদ ছফা সাহেবের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই ছেলেটি আপনার কাছে এখন থেকে মাঝে-মধ্যেই আসবে।
আপনি দয়া করে তাকে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ছফা সাহেবও সম্মতি দিয়েছিলেন। যদিও এর পর মাত্র দু-এক দিনই আমার ছফা সাহেবের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আর সেটাও মোস্তান ভাইয়ের উপস্থিতিতেই ছফা ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ই, যা পরবর্তীতে সাপ্তাহিক রাষ্ট্রে 'আহমেদ ছফার বুদ্ধিবৃত্তি' শিরোনাম হিসেবে ছাপা হয়েছিল। এর পর এক দিন মোস্তান ভাই সেই রাজনীতিবিদের নাম জানতে চাইলে আমি আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সাহেবের নাম বলেছিলাম।
তিনি বলেছিলেন, পরিচয় কীভাবে, দল করেন নাকি। আমি বলেছিলাম ঠিক তা না, সাংবাদিকতার সুবাদেই পরিচয়। তবে মাঝে এক দিন দেখা হলে জিজ্ঞেস করছিলেন কোথায় আছ এখন। রাষ্ট্রের কথা বললে তিনি বলেছিলেন, 'ও মোস্তানের পত্রিকা'। কাগজটা ভালো।
কিন্তু একটু বেশি হার্ড। আর বিশেষায়িত। আমি তখন তাকে একটি লেখা দেওয়ার কথা বললে আবদুল জলিল বলেছিলেন, লেখালেখির সময় কোথায় রে ভাই। তুমি এক দিন সময় করে এসো, তোমাকে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে দিব নে। পরে রাষ্ট্রে থাকাকালে একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল সাহেবেরই একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম আমি।
কিন্তু এতে তার জন্ম থেকে শুরু করে কর্মময় জীবনের সার্বিক ইতিহাস পর্যন্তও লিখতে হয়েছিল সিঙ্গেল কলামে (বঙ্) প্রকাশিত সেই ইন্টারভিউয়ে। কিন্তু বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুল জলিলও আর পৃথিবীতে নেই। অনেক রাজনীতিবিদকেই কলাম লেখা কিংবা সাংবাদিকতা শিখিয়েছিলেন নাজিমউদ্দিন মোস্তান। সরাসরি তাদের সঙ্গে কথা বলে সেগুলো ইন্টারভিউ আকারে না ছাপিয়ে তাদের ভাষায় লিখে সোর্স হিসেবে তাদের নামে ছাপিয়ে লেখালেখির কাজে রাজনীতিবিদদের উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তিনি। কাজী জাফর আহমেদসহ অনেক বড় বড় রাজনীতিককে এভাবে লিখতে দেখেছি।
আরেকটি রিপোর্টের স্মৃতির কথা খুবই মনে পড়ছে আমার। সেটি হলো '৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি বানানোর এক বছর পর একটি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি তার এক বক্তৃতায় দেশের সুশীল সমাজের প্রশংসা করে সবাইকে সুশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার জবাবে নাজিমউদ্দিন মোস্তান 'মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনি কাদের সুশীল সমাজ বলেন?' আমার দেশের দুই বেলা খেতে পারা হাঁটুর ওপর কাপড় পরা কৃষককুলই হলো আসল সুশীল সমাজ_ এই শিরোনামে একটি কলাম লিখে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সেই কলামে তিনি দেশের ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে ব্যবহার করে দেশের বড় বড় এনজিও ব্যক্তিত্বরা কীভাবে ডোনেশন এনে নিজেদের ভোগ-বিলাসিতার কাজে ব্যবহার করেন এবং তাদের জীবনে অর্থের চাহিদা কত, আর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন কৃষক যে কিনা প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই মাঠে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তথাকথিত এই সুশীল সমাজের মানুষের মুখে অন্নের জোগান দেন, তার চাহিদা কত এবং দেশের জন্য কার অবদান কতটুকু? কাজেই সুশীল সমাজ যদি কাউকে বলতেই হয়, তা হলে আমার দেশের এই হাড়ভাঙা দুই বেলা খেটে খাওয়া এবং হাঁটুর ওপর কাপড় পরা কৃষককুলকেই বলতে হবে। দেশের নাম বেচে বিদেশ থেকে ডলার এনে ভোগবিলাসিতাকারী ছদ্মবেশী ব্যক্তিরা আর যাই হোন না কেন, কখনো সুশীল সমাজ হতে পারে না।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাকে চিঠি দিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পাশাপাশি বঙ্গভবন থেকে লোক পাঠিয়ে সাপ্তাহিক রাষ্ট্রের সেই সংখ্যাটির ১০টি কপি সংগ্রহ করেছিলেন তা এখনো আমার পরিষ্কার মনে আছে।
সম্ভবত ১৯৯৭ সালে সংসদে বাজেট পেশের পরের ঘটনা। মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের পিআরও ছিলেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল নামের এক কর্মকর্তা। তার সঙ্গে রীতিমতো বাকবিতণ্ডা শেষে রাষ্ট্র অফিসে এসে বিক্ষুব্ধ অবস্থায় মোস্তান ভাইকে বললাম, ওই ব্যাংকের অনিয়মের তথ্য নিয়ে এসেছি। একটি রিপোর্ট করতে চাই।
তিনি আমার মনের অবস্থা দেখে বললেন, তাড়াতাড়ি লিখে ফেলুন। আমি দুপুরের খাবার খাওয়ার আগেই তা লিখে শেষ করে ফেললাম। কিন্তু সে সপ্তাহে রিপোর্টটি আর ছাপা হলো না। কারণ জানতে চাইলে মোস্তান ভাই বললেন এখন তো আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি প্রথম দিনের মতো রাগ-বিরাগ কিংবা বিক্ষুব্ধ অবস্থা আপনার মধ্যে নেই। ওটা প্রশমনের জন্যই সেদিন সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলতে বলেছিলাম।
তবে এখন থেকে মনে রাখবেন রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কারও বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখাটা একজন ভালো সাংবাদিকের কাজ নয়। একই সঙ্গে তার দেশপ্রেমও যে কত অকৃত্রিম ছিল তারও পরিচয় মিলে বেশ কিছু ঘটনায়। এর মধ্যে একটি ঘটনা ছিল সোনারগাঁও হোটেলে একটি ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের সংবাদ সম্মেলনে। হলভর্তি সাংবাদিক অবস্থান করলেও একজন ব্রিটিশ নাগরিক বাংলাদেশকে অসম্মান করে কথা বলার পরও যখন কেউ কিছু বলছিলেন না, তখন নাজিমউদ্দিন মোস্তান পেছন থেকে উচ্চকণ্ঠে ওই ব্রিটিশ নাগরিকের উদ্দেশে বলে উঠলেন_ 'ইউ ব্রিটিশিয়ার্স, ইউ'র পিপল হান্টারিং দ্য ই-লিগ্যাল রোলস ইন দিস কান্ট্রি টু হান্ড্রেড ইয়ার্স। সো ইউ শুড নট সে লাইক দেট, স্টপ ইউর মাউথ প্লিজ।
' মোস্তান ভাইয়ের এই বক্তব্য শোনে থ হয়ে যায় সেই ব্রিটিশ প্রতিনিধি দল। পরে তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তারা।
দেশের বেকারত্বের অবস্থা নিয়ে একটি রিপোর্ট করার আগে তিনি আমাকে এক দিন পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, এক দিন হয়তো আমি থাকব না, আপনাকে একটি কথা বলে রাখি। বাংলাদেশের বেকারত্বের যে অবস্থা, সে অনুসারে আপনার মতো একটা সচেতন ছেলে যদি মৃত্যুর আগে আরও পাঁচটি ছেলেমেয়ের বৈধ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে যান- তাহলে মৃত্যুর পর আপনার জন্য বেহেশত হারামও হয়ে যেতে পারে। মোস্তান ভাই বিভিন্নভাবেই চেষ্টা করে গেছেন সেটি পালন করতে এবং করেছেনও।
কিন্তু মানুষ কত বিচিত্র চরিত্রের। তাদের অনেকেরই হয়তো আর নাজিমউদ্দিন মোস্তানের নামটিই এখন মনে নেই। কিন্তু তাতে সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তানের কী আসে-যায়। তিনি তো তার দায়িত্বটুকু ইবাদতের মতোই পালন করে গেছেন। আর পচা নর্দমায় যাদের হাবুডুবু খাওয়ার কথা তারা সেখানেই আছেন।
লেখক : সাংবাদিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।