সুমিতকে পরপর দুদিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের পাড়ার রাস্তায় দেখে মনে করার চেষ্টা করলাম এর আগে তাকে এ রাস্তায় কখনো দেখেছি কি না। না, মনে পড়ল না। তাই তার সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাও, সুমিত?
মেলায় যাই, ভাইয়া।
বুঝলাম সে মেলায় যাওয়ার শর্টকাট রাস্তাটি বেছে নিয়েছে।
ওহ! ওকে।
যাও তবে। বলে বিদায় নিলাম।
পরদিন আবার, তার পরদিন আবার, এভাবে পরপর পাঁচদিন মেলার পথে তাকে দেখতে পেয়ে অবাক হলাম। সুমিত একটা প্রাইমারী স্কুলে সবে জয়েন করেছে। সন্ধ্যার পর মেলায় সাধারণত চেংরা পোলাপানরা যায়।
গান-বাজনা হয়, আমোদস্ফুর্তি হয়, জুয়া-টুয়াও হয় বলে শুনেছি। শুনেছি গত বছর বিজয়মেলায় মেয়েঘটিত কারনে নাকি একটা খুনও হয়েছিল। তাই একজন শিক্ষক হয়ে সুমিতের এভাবে প্রতি সন্ধায় মেলায় যওয়াটা আমার ভাল লাগল না। এলাকার ছোট ভাই হিসেবে তাকে স্নেহ করি। আমার স্নেহ আদায় করে নেয়ার মতো যথেষ্ট সভ্য ও ভদ্র ছেলে সুমিত।
তাই তাকে প্রশ্নটা আমাকে করতেই হল,
কী ব্যাপার? প্রতি সন্ধ্যায় এভাবে মেলায় যাও তুমি?
জ্বি ভাইয়া।
আজেবাজে কিছুতে নাই তো? দেইখো, দিনকাল বড়ই খারাপ।
না ভাইয়া, কি যে বলেন। সত্যি বলতে কী, মেলায় যাই লটারী কিনতে।
লটারী! আমার কৌতুহল আরো বেড়ে গেল।
জ্বি ভাইয়া, লটারী। প্রতিদিন একটা করে মোটর সাইকেল দিচ্ছে।
মোটরসাইকেল? কিন্তু আমি তো যদ্দুর জানি তুমি মোটর সাইকেল চালাতে জানো না।
জ্বি না, চালানোর জন্য না। যদি পাই তবে বিক্রি করে দিব।
ভাল বুদ্ধি। তাই বলে প্রতিদিন লটারী কিনতে হবে? ভাগ্যে থাকলে তো একটাতেই লেগে যায়।
আমার তো এখনো লাগেনি ভাইয়া। মাত্র দশ টাকা দামের টিকিট। যদি লেগে যায় ভাইয়া! টাকাটা আমার বড্ড দরকার।
টাকাতো সবারই দরকার। কিন্তু সুমিতের বুঝি এতো বেশি দরকার যে প্রতিদিন লটারী কিনতে হবে? বুঝতে পারলাম না। কৌতুহল থেকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, এতো টাকার দরকার হুট করে? ঘটনা কী?
কীভাবে যে বলি আপনাকে! শুনলে হাসতেও পারেন। সুমিতের মুখটা নিচের দিকে নেমে গেল।
কী হয়েছে? নিদ্বিধায় আমাকে বলতে পার।
আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, ভাইয়া। ফেব্রুয়ারীর ১৯ তারিখ।
বিয়ে! কনগ্রেচুলেশনস। এ তো খুশীর খবর। তা বিয়ে করার টাকা জোগাড় করতেই তবে তোমার এই লটারী কেনা?
জ্বি ভাইয়া।
যদি লটারী জিতে যাই তবে অনেক হ্যাল্প হয়।
তুমি খরচ কমিয়ে দাও না। তবেই তো হয়। আমি সমাধান দেয়ার চেষ্টা করলাম।
না ভাইয়া।
খরচ যথাসাধ্য কমানোর চেষ্টা করেছি। তবু তো অনেক খরচ। কম করে হলেও তো চার পাঁচ লাখ টাকা লাগবে।
সুমিত এখন আমার সাথে যথেষ্ট সহজ হয়ে উঠেছে।
তোমার আর কি চিন্তা সুমিত।
সরকারী চাকরী করো।
সরকারী চাকরী করে কতো টাকা আর পাওয়া যায়, ভাইয়া? আট হাজার টাকার মতো পাই সব মিলিয়ে। মাসের টাকা তো মসেই ফুরিয়ে যায়। টাকা জমানোর সুযোগ কই পেলাম?
তা ঠিক। তাহলে কি ব্যবস্থা নিলে।
এই তো ভাইয়া, লোন করলাম ব্যাংক থেকে। আরো কিছু ধার করলাম। বন্ধুদের থেকে। আব্বার কাছেও কিছু টাকা ছিল। তবু হচ্ছে না।
এখন যদি লটারী পেয়ে যাই! দোয়া করবেন।
অবশ্যই দোয়া করব।
সুমিত সাথে সাথে পায়ে ধরে সালাম করে ফেলল। অবাক হলাম। বললাম,
এর জন্য পায়ে ধরে সালাম করতে হবে না।
বি লাইক এ ম্যান। সাহস রাখো।
আজকে আপনাদের সবার দোয়া আমার প্রয়োজন আছে, ভাইয়া। আমি আজ আমার অতি কষ্টে জমানো ১০ হাজার টাকার লটারী কিনব।
১০ হাজার টাকা! বল কী? তুমি কি পাগল নাকি?
দশ হাজার টাকায় এক হাজার টিকিট।
আজ আবার পাঁচ পাঁচটা মোটরসাইকেল দিবে। এক হাজারটা টিকিট থেকে তো একটা টিকিট লাগবেই। একটা মোটর সাইকেল অন্তত আশি হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারব। ৭০ হাজার টাকা লাভ থাকবে। বিয়ের জন্য টাকাটা খুব কাজে আসবে।
আর যদি না লাগে? আমি তাকে ভয় দেখাতে চাইলাম।
কি যে বলেন ভাইয়া! গতকাল যে লোকটা ৫০০ টা টিকিট কিনেছিল সে তো মোটরসাইকেল জিতে গেল। আমিও জিতব নিশ্চয়ই।
তবু না লাগারও তো একটা চান্স থাকে সুমিত।
তা থাকে।
তবে ভেবে নেব আমার ভাগ্যটাই খারাপ। দোয়া করবেন।
সুমিত চলে গেল। পাগল ছেলে! লটারী জেতার টাকা দিয়ে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে!
মেলার মাঠের কাছেই আমার বাসা। রাত দশটার দিকে যখন লটারী করা হয় তখন মাইকে আওয়াজ ভেসে আসে।
কখনো ঐ আওয়াজকে ততোটা গুরুত্ব দেইনি যতোটা সে রাতে দিয়েছিলাম। গভীর মনোযোগ দিয়ে লটারী ্িবজেতাদের নামগুলি শুনছিলাম। সবকটি নাম বলা হয়ে গেলে নিশ্চিত হলাম পাঁচটা মোটরসাইকেলের একটাও সুমিত জিতেনি। কেন জানি না মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরদিন সন্ধ্যা বেলা আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম সুমিতের জন্য।
যদি দেখা হয় তবে তাকে স্বান্ত্বনা দেব। কিছু টাকাও দেব খরচ করার জন্য। না, তার দেখা পেলাম না। পরদিনও না। এভাবে মেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম।
না, সুমিতকে পেলাম না। স্থির করলাম সময় করে একদিন তার বাসায় যাব। কিন্তু সুযোগের অভাবে সেটা করা হল না। এবং একসময় ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেলাম।
মেলা শেষ হবার পনের-বিশ দিন পর আবারো সুমিতের সাথে হঠাৎ দেখা।
সাথে শাড়ি পড়া একটা মেয়ে। আমাকে দেখে দুজন সালাম করল। কথা বলে জানতে পারলাম মেয়েটি তার বউ।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু তোমার বিয়ের তো এখনো ছয় দিন বাকি আছে সুমিত। যতোদূর মনে পড়ে তুমি ১৯ ফেব্র“য়ারী তারিখের কথা বলেছিলে।
জ্বি, আপনি ঠিকই বলেছেন।
তাহলে? আমার অবাক প্রশ্ন।
লাজুক হেসে সুমিত বলল,
ভাইয়া, বিয়ের আগেই সে চলে এসেছে। আমরা নিজেরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি।
কাজী অফিস? কিন্তু কেন? তোমাদের বিয়ে তো পারিবারিকভাবেই ঠিক হয়েছিল।
তা হয়েছিল। কিন্তু সে যখন আমার লটারীতে টাকা খোয়ানোর গল্প শুনতে পেল, তখন সে নিজে থেকেই চলে আসল ভাইয়া। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম।
মেয়েটি সপ্রতিভ ভাবে বলা শুরু করল।
আমি নিজেই এসেছি ভাইয়া। বিয়ের খরচ নিয়ে উনার চিন্তার কথা জানতে পেরেই, আমার এ সিদ্ধান্ত। উনি এতো টেনশন করছেন এটা সহ্য করতে না পারিনি।
কিন্তু তোমার বাবা-মা? তারা তো কষ্ট পাবেন।
সাময়িক কষ্ট পাবেন।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ের খরচ জোগাতে আমার বাবাকেও গলদঘর্ম হতে দেখেছি। এভাবে বিয়ে করে বাবাকেও বাঁচিয়ে দিলাম। পরে তিনি যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন তখন, আমি জানি, তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি যদি তাদের অপছন্দের কাউকে বিয়ে করতাম তবে একটা কথা ছিল।
কিন্তু ছেলে মেয়ের বিয়েতে সবাই একটু আনন্দ করতে চায়।
প্রতিবাদ করলাম আমি। এটা আমাদের ট্র্যাডিশন।
না ভাইয়া। যে আনন্দের খোরাক যোগাতে এতো খরচ করতে হয়, সে আনন্দের দরকার নেই আমাদের। সুমিতের বউয়ের ঝটপট জবাব।
আমরা দুজন একত্রে আছি। সুখে আছি। এটাই আমাদের অানন্দ। যাই ভাইয়া। দোয়া করবেন।
সুমিত তার বউকে নিয়ে এগিয়ে চলল।
আমি পেছন থেকে অনেকক্ষণ তাদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।