বনের পাখি কোয়েল উড়ে বেড়াত জঙ্গলে। কথা বলত প্রকৃতির সঙ্গে। গাইত গান, জীবনধারণ করত পোকামাকড় খেয়ে। উড়ে বেড়াত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপে। এমনভাবে পাখিগুলো অবতরণ করত, দেখে মনে হতো দ্বীপগুলো যেন কোয়েলে ছেয়ে গেছে।
কালের আবর্তে আস্তে আস্তে ১৯৯০ সালের দিকে এগুলো বাংলাদেশের গৃহপালিত পাখি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করছে। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা সদরের তারাকান্দা গ্রামের যুবক আশরাফ আলী কোয়েল পালন করে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তার কোয়েল খাদ্য হিসেবে জেলা ছাড়িয়ে এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ চলে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। কোয়েল পাখির চাষ করে আশরাফ আলী নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি এলাকার কিছু মানুষের কর্মসংস্থানও করেছেন। শখের বসে পাখি পালতে গিয়ে এখন মূল পেশায় রূপান্তরের পাশাপাশি পথপ্রদর্শকও হয়ে গেছেন আশরাফ আলী।
দেশের বিভিন্ন স্থানে কোয়েল পাখি খাবারের পাশাপাশি পালনের জন্য সরবরাহ হচ্ছে। খাবারে মাংসের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক আয়ও বাড়ছে। তারাকান্দা গ্রামের ব্যবসায়ী হাজী মো. দুলাল মিয়ার ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে আশরাফ ৫ম। পড়াশোনায় বেশিদূর এগোতে না পেরে পূর্বধলা বাজারে প্রসাধনী এবং পাদুকার দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৭ সালে শখের বসে যশোরের ঝিকরগাছা পিএসডিএফ সংস্থা থেকে ১০০ কোয়েল পাখির বাচ্চা আনেন।
শুরু করেন সিজনালভাবে পালন। ২০১১ সালে পূর্বধলা বাজারে এক অগি্নকাণ্ডে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পুড়ে যায়। তখন কি করবেন বুঝতে না পেরে দিশাহারা ছিলেন তিনি। ভেবে দেখলেন পাখি পালন চালিয়ে গেলে হয়তো মন্দ হবে না। এভাবে আরও ৫০০ পাখি এনে শুরু করেন পাখি পালন।
৩৬ শতাংশ জমিতে কোয়েল পাখির জন্য খামার তৈরি করেন আশরাফ আলী। এভাবে চলতে চলতে এখন অর্ধ কোটি টাকার পাখির জমজমাট ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এখন তার মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় প্রায় দেড় হাজার খামারি কোয়েল পালনে ঝুঁকে পড়েছেন।
বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ডিম ফোটানোর পর ৩০ দিনে খাদ্য উপযোগী হয়ে উঠে পাখিগুলো। ৭-৮টি পাখিতে এক কেজি মাংস হয়।
পাখির মাংস প্যাকেটজাত করে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। আবার জীবিত পাখিও অনেক সময় সরবরাহ করেন ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় বিভিন্ন স্থানে। শহরের হোটেলগুলোতে পাখির সুস্বাদু মাংস বিক্রি হয় উচ্চমূল্যে। এক প্যাকেটে প্রায় ৮টি পাখি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে দেদার। কোয়েল পাখি মোরগের মাংসের পাশাপাশি সুস্বাদু খাবারের চাহিদা যেমন মেটাচ্ছে তেমনি এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় পালনে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি করছে।
প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার পাখি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু খামারে আসার পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় বিপাকে ব্যবসায়ীসহ ক্রেতারা। তবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি হতে পারে পোলট্রি খামারের মতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু এগ্রিকালচার অ্যান্ড এনিমেল হেলথ নামক গবেষণা কেন্দ্রের ডিন ডা. আমিনুর রহমানের 'কোয়েল পালন' বইয়ে জানা যায়, পাখিটি একসময় গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। ১৯৩৫ সালে গবেষক টাকাসুকাসা কোয়েলের প্রজনন যত্ন এবং এগুলোর গানের প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত্র তথ্য প্রকাশ করেন।
সে সময় কোনো কোয়েলের সুর অত্যন্ত মধুর ছিল। সেসব কোয়েলের গানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। গায়ক কোয়েল প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলে বনো কোয়েল ঠিকভাবেই বেঁচে ছিল এবং এখনো জাপান, কোরিয়া, পূর্বচীন, মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে আছে।
বাংলাদেশে একসময় বেশ কয়েক প্রজাতির কোয়েল বাস করত। কিন্তু নির্বিচার শিকার, আবাস এলাকা ও ঝোপঝাড় হ্রাস, খাদ্য ঘাটতি প্রভৃতি কারণে এগুলোর সংখ্যা কমে যায়।
তবে বর্তমানে সাধারণ বা ধূসর কোয়েল, কালো বুক কোয়েল, রঙ্গিলাঝোপ কোয়েল প্রভৃতি প্রজাতির অস্তিত্ব রয়েছে।
এদেশে নীল বুক চিনা রঙ্গিলা কোয়েল এবং মনিপুরঝোপ কোয়েলও বাস করে। প্রকৃত কোয়েল ছাড়াও তিন প্রজাতির বাটন কোয়েল দেখা যায়। যেমন ছোট বাটন কোয়েল, বাসটার্ড কোয়েল, সাধারণ বা নিলপার্বাটন কোয়েল এবং ভারতীয় হলদে পা বাটন কোয়েলগুলো প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় ঘাসবন উপত্যকায় এবং উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের কিছু জেলায় ঝোপজঙ্গলে ও ঘাসবনে বাস করে। এ ছাড়াও কয়েক প্রজাতি রয়েছে যেগুলোর নাম পাহাড়ি কোয়েল, কেলিফোর্নিয়া কোয়েল, মনপিজুমা কোয়েল, আসালু কোয়েল, চিনারঙ্গিলা কোয়েল, ববহোয়াইট কোয়েল।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৯ হাজার ৬৭২ প্রজাতির পাখি রয়েছে। পাখির শ্রেণীবিন্যাস থেকে কোয়েলের অবস্থান জানা যায়। বর্তমানে এটি লাভজনক একটি পাখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।