আমার ভিতরে আমি স্বতন্ত্র জীবন যাপন করি।
“ভাই কামডা করলেন কি? পুটকিটা পারা দিলেন?
-শীট! অভ্যাস ছগীর ভাই অভ্যাস। গত ১৫ বছরের অভ্যাস দুদিনে কি ছাড়তে পারি? আর আপনারে না বলছি পুটকি বলবেন না। ফিল্টার বলবেন।
ছগীর মোল্লা তার হলুদ দাঁত বের করে বলল “ভাইজান আমারও অভ্যাস”
মেজাজ খারাপ হবার কথা থাকলেও হো হো করে হেসে দিলাম।
ছগীরও একই শব্দে হাসছে। সে হাসছে কেন বুঝতে পারছি না।
-আফনে পনের বছর ধইরা বিড়ি খান? এই জিনিস আমি খাইতে পারি না ক্যান?
সিগারেটকে বন্ধুরা বিড়ি বললে ভালো লাগে, কিন্তু অশিক্ষিত কোন লোক বিড়ি বললে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। যাই হোক আপাতত মেজাজ খারাপ করলাম না। ছগীর মোল্লা লোকটা সাধাসিধে, তবে মাথায় টুপি না থাকা সত্ত্বেও নামের শেষে মোল্লা কেন তা কে জানে? ছগীরের সাথে দেখা হয়েছিল দুই দিন আগে।
আমি বরাবরই সিগারেট নিয়ে রোমাঞ্চ করতে পছন্দ করি। ঠিক এই উদ্দেশ্যেই বিকালে বাসা থেকে বেরুলাম।
দশটা সিগারেট নিয়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটিই ছিল উদ্দেশ্য, মাঝখানে ঝামেলা পাকালো এক লোক। দ্বিতীয় সিগারেটটা জ্বালালাম মাত্র, তখনই তাকে চোখে পড়লো। চোখে কেমন একটা চোর চোর ভাব।
আমাকে লক্ষ করছে। পাত্তা দিলাম না। সিগারেট শেষ করে এগিয়ে গেলাম। কেন জানি মনে হচ্ছিল লোকটা পিছনে আসছে, তাকাতেই দেখলাম আমার ফেলে দেয়া ফিল্টার হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। অবাক হবার বিষয়ে আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে, তাই সহজে অবাক হই না।
নিজের মত হাঁটা শুরু করলাম। মিনেট দশেক হেঁটে রাস্তার পাশে টং দোকানে চায়ের অর্ডার দিলাম। আমার সুক্ষ ধারনা ছিল আশেপাশে ফিল্টার বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোকটি রয়েছে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখলাম, বাম পাশে গাছের আড়ালে তাকে পেয়ে গেলাম। আমার চোখে চোখ ফেলার আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে, একটুও পাত্তা না দিয়ে আরামসেই চা-সিগারেট চালাচ্ছি।
সিগারেটটা শেষ করে ফিল্টার ফেলে পা দিয়ে চাপা দিতে যাবো তখনও লোকটা রীতিমত চেঁচিয়ে উঠলো “না ভাইজান থামেন, থামেন”। আমি থামলাম।
এবার অবাক হলাম। মনযোগ দিয়ে ফিল্টার পরীক্ষা করছে। পরীক্ষা শেষে “ধুত্তুরি” বলে হতাশ হল।
বলতে সমস্যা নেই আমি ভীষন অবাক এবং কৌতুহলী হলাম। বলেই ফেললাম “কি হয়েছে ভাই?
-না তেমন কিচ্ছু না।
-তাহলে?
চুপ। সে ভাবছে। আমিও তাকে ভাবতে সময় দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালাম।
তার ভাবনা রাস্তার ইট পাথর বোধহয়। নিচের দিকে তাকিয়ে সেই যে ডুবেছে উঠার নাম নেই। আমি অর্ধেক সিগারেটটাই ফেলে দিলাম তার পায়ের সামনে। আমি আবার অবাক! এই ফিল্টারটাও সে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। বলতে গেলে কৌতুহলটা আর দমাতে পারছি না।
আবার জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা আপনার সমস্যা কি বলেনতো?
লোকটা মুখ উপরে তুলল,একবার তাকিয়ে আবার ফিল্টারে মনযোগ দিল। তার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে রীতিমত অপমানবোধ করছি। “ভাইজান আফনেরে কওন যায়, আফনে মানুষ খারাপ না মনে হয়” উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল সে।
-ভাইজান আমি ছগীর মোল্লা, আমি সিগারেটের পুটকি টোকাই।
-মানে?
-মানে হইল আপনারা খাইয়া যে সিগারেটের পুটকিটিটা ফালান ওইটা আমি টোকাই।
অবাক হবার উচ্চতায় কেবল উঠছি, আরও মনে হয় উঠিয়ে ছাড়বে এই লোক। একাধারে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেললাম কেন টোকায়,কি লাভ এসব আরকি। ছগীর মোল্লা ভড়কে গেল না। বরং ভীষন উৎসাহি হয়ে একটানে সব বলে ফেলল। তার গল্পের কাহিনী সংক্ষেপ হল তার বিশ্বস্ত এক মামাত ভাই এর মাধ্যমে জেনেছে গোল্ডলীফ সিগারেটে বাজারে এমন একটি সিগারেট ছেড়েছে যেটার ফিল্টারের রং সোনালী।
হাল্কা না গাঢ় সোনালী। তাই হঠাৎ করে বুঝা যায় না। এই ফিল্টার যে পাবে তাকে ২০ লাখ টাকা দেয়া হবে। সে অনুযায়ী ছগীর সোনালী ফিল্টার খুজে বেড়াচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ছগীর নিজে সিগারেট খায় না এবং তার মতে তার মামাত ভাই ফেরেশতা কিসিমের লোক।
আমি ছগীরকে বললাম “এত কষ্ট করার কি দরকার? আপনি বরং একটা ফিল্টারকে গাঢ় সোনালী রং করে নিয়ে যান।
-ছি ছি কি বলেন? আমি অসৎ কাজ করবো না। আর নিয়ে গেলেইতো ওরা বুঝে ফেলবে।
বুঝলাম অসৎ কাজ করার চেয়ে ধরা খাওয়ার ভয়ে সৎ থাকাটাই প্রধান। যাই হোক ছগীরের সাথে চুক্তি করে ফেললাম।
চুক্তি বললে ভুল হবে তার আবদার রাখলাম বলা যেতে পারে। যতদিন সে সোনালী ফিল্টার খুঁজে না পাবে ততদিন আমার সব সিগারেটের ফিল্টার তার জন্য। ফেলে দেয়া জিনিস কাউকে দিতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই। তাছাড়া ছগীরকে পেয়ে আমার ভালোই হল। পেশায় বেকার আমি বন্ধুবান্ধবহীন।
কিছুটা নিরীহ কিসিমের ছগীর পোষ মানা বন্ধুর মত।
ছগীর কেবল ফিল্টার পরীক্ষা নিরীক্ষাই করছে না গোপনে ফিল্টার জমাচ্ছেও দেখলাম। একদিন হাতে নাতে ধরে ফেললাম। প্রথবার চুরি করতে গিয়ে ধরা খাওয়া চোরের মত কাচুমাচু করে বলল “ভাইজান একটা কথা আফনার থেইকা লুকাইছি।
-কি কথা?
-কোম্পানী কইছে দশ হাজার ফিল্টার জমাইলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিবো
খুশীর সংবাদ, না পঞ্চাশ হাজার টাকা না ছগীর পুটকি না বলে ফিল্টার বলেছে।
কিছুটা হাসিও পেল। আহারে গরীব মানুষ। হাসিটা গোপন করে মুখ কিছুটা কঠিন করে জিজ্ঞেস করলাম “এটা আপনাকে কে বলেছে?
-জ্বে আমার মামাত ভাই। হে ভাই জীবনে মিথ্যা কয় নাই।
-হুমম বুঝলাম।
তা তোমার দশহাজার হতে আর কত বাকি?
ছগীরের উৎসাহ বেড়ে তিনগুন হয়ে গেল। জং ধরা হলুদ দাঁত বের করে বলল “বেশী হয় নাইক্কা মানুষ সিগারেটের পুটকি মাটিতে ফালাইয়া পারা দিয়া দে। কোম্পানী কইছে ফ্রেশ পুটকি চাই তাদের। তাইতো ভাইজান আপনার লগে আছি। এখন তিন হাজারের মত আছে”
আমার হো হো করে হাসা উচিত কিন্তু হাসিটা কেন যেন আসলো না।
চুপসে গেলাম।
********
পাশ করে বেরিয়েছি প্রায় তিন বছর হতে চলল। টিউশনি করে করে নিজের ঘানি নিজেই টানছি। সামাজিকতা পায়ে ঠেলে দিয়েছি বহু বছর আগে। পরিবারও ছেড়ে দিয়ে গেল এক বছর।
প্রথম প্রথম টাকা আয় করার অনেক চেষ্টা করেছি। ব্যার্থ হয়ে ছেড়ে দিলাম শেষে। টিউশনি করে চলে যাচ্ছে। আজ ছগীরের আয় করার উৎসাহে কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেল। বেচারা আমার পিছনে ভালোই শ্রম দিচ্ছে।
সকাল সকাল আমার বাসায় চলে আসে। আমি বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমাই। ততক্ষন সে গতরাতের রাখা ফিল্টারগুলো পরীক্ষা করে। রাত পর্যন্ত আমার পিছু ছাড়ে না। রাত দশটা বাজে ছগীর বিদায় নিল।
বিদায় নেবার আগে সোনালী ফিল্টার পেলে কি করবে? দশ হাজার ফিল্টার পেলে কিভাবে টাকাটা তুলবে তার বিস্তারিত বর্ণনা করলো। স্যাঁতস্যাঁতে মেসে আমার ভাবনা ছগীর। রাত কিভাবে চলে গেল টেরই পেলাম না। ফযরের আযান দিচ্ছে। উঠে পড়লাম, এস্ট্রে হাতে নিলাম।
প্রত্যেকটি ফিল্টার বের করে চেক করতে লাগলাম। নাহ! কোনটাতেই গাঢ় সোনালী রং নেই। নিজেকে নিজে ঠিক চিনতে পারছি না। গুণে গুণে সতেরটা ফিল্টার ড্রয়ারের ভিতরে রেখে দিলাম। নাহ ঠিক হচ্ছে না।
আটটা বের করে ফেললাম। এগুলো ছগীরের জন্য।
ব্যাপারটা আমাকে পেয়ে বসলো। সিগারেট কেনার সময় আমি ফিল্টার দেখে কেনা শুরু করলাম। ছগীরের আড়ালে একটা দুটো করে ফিল্টারও সরিয়ে ফেলতে শুরু করলাম।
ছগীর অবশ্য আমাকে নিয়ে ভারি হতাশ। তার মতে আমার কি জানি হয়েছে, সিগারেট কম খাচ্ছি। আমি নাকি অসুস্থ! সত্যি সত্যি ভাবতে গেলে আমি সামান্য অসুস্থই বটে। দুলাখ টাকা পেয়ে যাবার লোভ বিরাট অসুস্থতা। পঞ্চাশ হাজারইবা কম কিসের?
-ছগীর?
-জ্বি ভাইজান
-একটা কাজ করেন, কাল আসার সময় আপনার ফিল্টারের বাক্সটা নিয়ে আসেন
-ক্যান ভাইজান?
-আমি একটু চেক করে দেখবো।
ধরুন আপনার মিসওতো হতে পারে
-হ ভাইজান আপনে শিক্ষিত মানুষ। আমি কি না কি ভুল করছি
ছগীর ভীষন খুশী হল। খুশী মনে ফিল্টার নিয়ে নানা রকম গল্প করতে লাগলো। এক ছেলে কিভাবে সিগারেট ধরাতে গিয়ে ফিল্টার ধরিয়ে দিয়েছিল সে বিষয়ক ভারি মজার গল্প। তবে কেন জানি আমি মজা পাচ্ছি না।
মজাটা বোধহয় অন্য কোথাও।
পরদিন সত্যি সত্যি একটা বাক্স নিয়ে ছগীর হাজির হয়েছে। আজ আর আমি ফিল্টার লুকালাম না। ছগীরের ভারি উত্তেজনা “ভাইজান ফিল্টার কখন দেখবেন,আমারতো সহ্য হইতাছে না”। তাকে আশাবাদ দিলাম গুনবো বলে।
সে নিয়মিত ফিল্টার বলছে এজন্য তাকে সাধুবাদও জানালাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে ফিল্টারের প্রতি আমার কোন আকর্ষন না দেখে ছগীর বলেই ফেলল “ভাইজান আমি খুইলা আপনারে একটা একটা দিই? আপনে দেখেন?”
-নাহ থাক। শোনেন ছগীর আপনি চলে যান। আজ রাতে আমার কাজ হলো এগুলো পরীক্ষা করা। রাত নীরব, কাজ করা যাবে আরামসে।
ছগীর আমার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে চলে গেল।
খুব সকালে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ছগীর ঢুকেই চোখ বড় বড় করে বলল “ভাইজান পাইছেন কিছু?
মাথাটা চুলকে নিয়ে বললাম “ছগীর একটা সমস্যা হয়ে গেছে যে”
-কি সমস্যা ভাইজান?
-কাল রাতে সিগারেটের ফিল্টার পরীক্ষা করতে করতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন আবার আমার মুখে সিগারেট ছিল। আগুন ধরে গেছে সব।
অল্পের জন্য বিল্ডিংয়ে ধরেনি। আমিও জানে বাচা বেচে গেছি।
ছগীর পাগলের মত হয়ে গেল। কি করবো বুঝে উঠতে পারছে না। অবিশ্বাসি চোখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে।
তাকে নিয়ে দেখালাম আগুনে পোড়া বাক্স এবং আশেপাশের পরিবেশ। সে তার অবাক হবার লিমিটেশন অতিক্রম করেছে। পাগলের মত বেরিয়ে গেল। আমার মুখের কোণায় যে হাসি ফুটে উঠলো সেটা কেবল আমিই দেখলাম। ফিল্টার পুড়েনি, আদতে ফিল্টার পুড়ে যাবার জন্য তৈরি হয়নি।
ফিল্টারগুলো সরিয়ে আমিই বাক্সটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। না পাই সোনালী ফিল্টার, তিন হাজারতো রয়েছে। অশিক্ষিত ছগীর তিন হাজার সংগ্রহ করতে পারলে বাকি সাত হাজার আমার কাছে ব্যাপার না। তাহলেতো পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার পকেটে।
বিকেলে উদ্দেশ্যহীন হাঁটার জন্য বেরিয়ে মেজাজ ধরে গেল।
মাসের শেষের দিক। পকেট শূণ্য। অথচ সিগারেটের বাকি দোকান বন্ধ। সিগারেট আর হল না। পা দুটি যখন এখনও ফ্রিতে সার্ভিস দিচ্ছে অতএব হাঁটতে মানা নেই।
সামনের লোকটা সিগারেট খাচ্ছে, চেয়ে নিবো কিনা ভাবছি। ভাবতে ভাবতে লোকটা সিগারেট শেষ করে ফেলে দিল। পা দিয়ে ফিল্টারটা চেপে দিবে এই মুহূর্তে আমার অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো “ভাইজান থামেন থামেন,পারা দিয়েন না”
আমি আহত ফিল্টারটা চেক করে দেখছি। “কি ভাইজানা ভালানি? শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখলাম হলুদ দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে ছগীর মোল্লা। মুখে আত্নপ্রসাদের হাসি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।