দেশের দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায়ী সদস্যদের প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটায় ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা চলছে। অথচ সারা দেশের দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের স্বার্থ দেখতে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে তাদের কমিটিতে পাঠানো হয়। খামারিরা বছরের পর বছর থেকে যায় বঞ্চিত। তারা দুধের ন্যায্য মূল্য পায় না। ঘুষ না দিলে বিপদে ঋণ পায় না।
অসুস্থ গবাদিপশুর সুস্থতায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা পায় না। সব মিলিয়ে যাদের দুধের ওপর নির্ভর করে মিল্ক ভিটার সব কার্যক্রম, সেই প্রান্তিক খামারিরাই চরম উপেক্ষার শিকার।
খামারিরা অভিযোগ করেছে, বর্তমানে ২৩৪ জন পশু চিকিৎসা সহকারী (এএলএফআই) থাকলেও তারা প্রয়োজনের সময় গবাদিপশুর ডাক্তারের দেখা পায় না। কেউ কেউ কখনো অসুস্থ গবাদিপশু দেখতে গেলেও টাকা ছাড়া কাজ করে না। মাঠপর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশু চিকিৎসা সহকারীদের পাওয়া যায় না।
এর পরও সম্প্রতি অগ্রিম টাকা নিয়ে আরও ২০০ জন পশু চিকিৎসা সহকারী নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছেন কয়েকজন পরিচালক। নিয়োগ পেতে টাকা দিয়েছেন এমন একাধিক চাকরিপ্রার্থী অভিযোগ করেছেন, মিল্ক ভিটা ব্যবস্থাপনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, বাঘাবাড়ি ও নোয়াখালী অঞ্চলের দুজন সদস্য সাম্প্রতিক নিয়োগের ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর। বছরে পৌনে ৭ কোটি লিটার দুধ উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানে ২৩৪ জন চিকিৎসা সহকারীই ঠিকমতো কাজ করছেন না। সেখানে আরও ২০০ জন পশু চিকিৎসা সহকারী নিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়োগের অনিশ্চয়তায় যারা নিয়োগ পেতে ঘুষ দিয়েছেন সেসব মানুষের ঘরে ঘরে এখন কান্নার রোল।
দুর্নীতি দমন কমিশনে এরই মধ্যে এ নিয়ে অভিযোগ গেছে।
এদিকে, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এলাকায় একটি দুগ্ধ শীতলীকরণ প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ এর আগে তিনবার সার্ভে করা হয়। প্রতিটি সার্ভে রিপোর্টে এটি লাভজনক হবে না বলে মত দেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ সার্ভে রিপোর্টে ইতিবাচক মত দেওয়া হয়। চেয়ারম্যান হাসিব খান ও সদস্য বেল্লাল হোসেন ভূঁইয়ার তৎপরতায় খন্দকার মোশাররফকে খুশি করতে সেখানে নতুন প্লান্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বেল্লাল হোসেন ভূঁইয়া ১৯৭৮ সাল থেকে ২২ বছর মিল্ক ভিটায় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। সে সময় কাজ না করা, চেয়ারম্যানসহ একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নাজেহাল করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুই দফা চাকরিচ্যুত হন তিনি। সর্বশেষ ২০০৪ সালে তাকে চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরিকালে তিনি কমপ্লিমেন্টের নামে মিল্ক ভিটার লাখ লাখ টাকার প্রোডাক্ট বাইরে বিক্রি করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বর্তমানে অন্তত শত কোটি টাকার মালিক।
বনানীতে বাড়ি, গাড়ি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে ফাইলও রয়েছে। গত নির্বাচনে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করান বলে অভিযুক্ত তিনি। বর্তমানে মিল্ক ভিটার অনিয়ম, লুটপাট ও অরাজকতার ক্ষেত্রে তিনি মুখ্য ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। গতকাল মিল্ক ভিটা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর অনেক ভুক্তভোগী পাঠক ফোন করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। ২০০৮ সালে অ্যাডহক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি অবৈধভাবে মিল্ক ভিটার অফিস, পিয়ন, গাড়ি, জ্বালানি ব্যবহার করেন। এ নিয়ে ২০১০ সালে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অনিয়মের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি গত নির্বাচনের আগে ৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা মিল্ক ভিটায় জমা দেন। এরপর নির্বাচিত হয়ে পুনঃতদন্ত করিয়ে পুরো টাকা মিল্ক ভিটা থেকে তুলে নেন।
বর্তমানে তার নেতৃত্বে নিয়োগ বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খামারিদের প্রতি লিটার দুধের বিক্রয়মূল্য থেকে ৪০ পয়সা করে কেটে রাখা হয়। এটি সমবায়ী কৃষকদের আপদকালীন সময়ে গাভী কেনার ঋণের জন্য নেওয়া হয়। বর্তমানে ৮ কোটি টাকা তহবিলে আছে। কিন্তু ঘুষ না দিলে ঋণ পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেছেন খামারিরা।
অন্যদিকে চেয়ারম্যান, পরিচালক, তাদের আত্দীয়স্বজন ও প্রভাবশালীদের স্বার্থে মডেল ফার্ম নামে প্রকল্প করে অনেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, এসব নিয়োগ অনিয়ম ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক কেনাবেচায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মিল্ক ভিটার সর্বশেষ একটি তদন্ত প্রতিবেদনে অনুমোদনহীন খাতে টাকা ব্যয়, এক বিল দুবার পরিশোধের মাধ্যমে টাকা আত্দসাৎ, এমনকি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কেনার ঘটনা ঘটেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মিল্ক ভিটার জন্য ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকার বাজেট অনুমোদিত ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রথম ১০ মাসেই ব্যয় করেছে ১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
এ অর্থবছরে মিল্ক ভিটার চারটি গাড়ির চার জোড়া টায়ার কিনতে রহিমআফরোজকে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৪০ টাকা দেওয়া হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে একই বিলের আওতায় একই পরিমাণ টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নথি জালিয়াতির মাধ্যমে মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান ওই অর্থ আত্দসাৎ করেছেন। মিল্ক ভিটা ২০১১-১২ অর্থবছরে জনতা কেমিক্যালের কাছ থেকে নাইট্রিক এসিড কিনেছে ৭০ টাকা কেজি দরে। মিল্ক ভিটার প্রতিযোগী দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ একই কোম্পানির কাছ থেকে নাইট্রিক এসিড কেনে ৬০ ও ৬১ টাকা কেজি দরে।
এতে মিল্ক ভিটার আর্থিক ক্ষতি হয়, ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাণ-আরএফএল প্রতি কেজি ইথাইল অ্যালকোহল কেনে ২৪৩ টাকা ৯০ পয়সা দরে। মিল্ক ভিটা কেনে ৪৩৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এতে মিল্ক ভিটার ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এভাবে প্রায় প্রতিটি কেনার ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মিল্ক ভিটার ১০৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতনের বিপরীতে ৮০ লাখ এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির ১০ সদস্যকে ৭২ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। সদস্যদের অগ্রিম পরবর্তীতে সম্মানী হিসেবে সমন্বয় করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেতনের বিপরীতে অগ্রিম দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। আগের অগ্রিম আদায় হওয়ার আগেই একই ব্যক্তিকে আবার অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়ম বর্তমান চেয়ারম্যানের অনুমোদনে করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।