আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোভিয়েট রাশিয়ার কে জি বি’র গল্প-১

কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্‌ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ ব্রায়ান ফ্রিমেন্টেলের লিখা কেজিবি বইটা পড়ে ভালো লেগে গিয়েছিল। øায়ু যুদ্ধ সময়কার সোভিয়েট রাশিয়ার আতংক ছিল এই কে জি বি।

কত থ্রিলার, গল্প, উপন্যাস কৌতুকের জন্ম দিয়েছিল এই ভয়ংকর মানব রচিত মানবতাবিরোধী এই রাষ্ট্র যন্ত্রটি। এর খবর ভাসা ভাসা ভাবে প্রায় সব বাংলাভাষী জানলেও এর ভেতরের নির্মমতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা ও এর অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন সম্বন্ধে অনেকেরই হয়ত তেমন স্বচ্ছ ধারণা নেই। সেবা প্রকাশনী থেকে ‘আমি ছিলাম কেজিবি’র লোক’ নামে একটা পেপারব্যাক বের হয়েছিল। বইটা পড়ে ভাল লেগেছিল। কেজিবি বইটাও তেমন ভাবে রোমাঞ্চকর ঘটনায় ভরপুর।

নিজের আনন্দ অনেকের মাঝে ভাগ করে নিতে ভাল লাগে। তাই বইটার ভাবানুবাদের কাজে হাত দিয়ে কিছুটা রুপান্তারের চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রজন্মে ভাষার লিখিত রুপ আমরা দেখছি, পড়ছি সবলিল ভাবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই ভাষা কতটুকু পড়বে তা ভাবার বিষয়। এখন থেকেই যদি তাদের মনে কিছুটা আগ্রহ সৃষ্টি করা যায় তাহলে তার টানে অন্য কোন ভাষার পাশাপাশি এই মাতৃভাষার কথাও মনে থাকবে ও মাতৃ ভাষা চর্চা অব্যাহত রাখবে।

সবার শুভেচ্ছো নিয়ে ভাষার প্রতি ভালবাসা থেকে এই প্রচেষ্টা। ভাল লাগুক এটাই প্রত্যাশা। শোভন শামস্্ সøায়ুযুদ্ধ বা ‘কোল্ড ওয়ার’ এর সময় সোভিয়েট রাশিয়ার আতংক ছিল কেজিবি । কেজিবি শব্দটা শুনলে এক সময় পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ আঁৎকে উঠত । তার কমুনিষ্ট ব্লক দেশগুলোতে এই শব্দটা মানুষের মনে ভয়ের জন্ম দিত, এটা ছিল প্রাক্তন সোভিয়েট রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা।

সাদামাটা ভাবে বলা হলেও এটার কাজকর্ম কিন্তু মোটেই সাদামাটা ছিল না। কেজিবি’র ছায়া সারা ওয়ারশ প্যাক্ট ভুক্ত দেশগুলোতে গা ছমছম ভাব ছড়িয়ে রাখত । এর থাবা অন্যান্য অনেক দেশেও প্রসারিত ছিল । আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার অবস্থান কালেও এর অনেক কীর্তিকলাপ শোনা যেত । এখন আর আতংক নেই তাই উৎসুক মানুষের জন্য কেজিবি’র না জানা অনেক কথা জানা যেতে পারে ।

সোভিয়েট লেবার ক্যাম্প গুলো এক ধরনের যন্ত্রনাদায়ক নির্বাসন কেন্ড এ সমস্ত গা শিউরে উঠা নির্মম নৃশংস কারাগার গুলো আর্কটিক তুন্দ্রা অঞ্চলের কাছে বানানো হতো । সেখানে নির্বাসন মানে নির্ঘাৎ যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু কিংবা মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করা । এসব ক্যাম্পে যাবার জন্য কেজিবি’র নিজস্ব রেল লাইন ছিল । যা সাধারণত ম্যাপে এ গুলো দেখা যেত না । রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় এধরণের লেবার ক্যাম্প ছিল ।

ষ্টালিন এর সময় রাশিয়ার কলিমা অঞ্চলে ১০০ টার মত এধরণের ক্যাম্প কমপ্লেক্স ছিল । এই এলাকাটা ফ্রান্সের চার গুনেরও বড় একটা এলাকা । এই ক্যাম্প গুলোর অনেক গুলো øায়ু যুদ্ধের শেষ অবধি কার্যকরী ও তৎপর ছিল । রাশিয়ার কোর্ট গুলো যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদন্ডের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মেয়াদের নির্বাসন দন্ড দিত। কাজাকাস্থান এর বিশাল অঞ্চল এধরণের নির্বাসন প্রাপ্ত কয়েদিরাই আবাদ করেছিল ।

প্রায় ৭০ শতাংশ জনবসতি ছিল এ ধরণের দন্ড প্রাপ্ত কয়েদীদের দ্বারা অধ্যুসিত । লেনিন এ ধরণের ক্যাম্প প্রবর্তন করলেও এর সর্বনিকৃষ্ট ব্যবহার করেছিল ষ্টালিন । ষ্টালিনের সময় এই সব লেবার ক্যাম্প গনহত্যার হাতিয়ার হিসেবে বেশ নিপুন ভাবে ব্যবহৃত হতো যা জার্মানীর থার্ডরাইখকেও হার মানিয়েছিল । অনুমান করা হয় যে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর সোভিয়েত জেল গুলোতে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ( প্রায় দেড় কোটি ) লোক বন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটিয়েছিল । একটা হিসেবে ষ্টালিনের শাসন আমলে এ সমস্ত বন্দীর প্রায় ১২ মিলিয়ন মারা গিয়েছিল।

ষ্টালিন এর দীর্ঘ শাসনকাল ও ক্যাম্প এর বিশাল সংখ্যা ও নৃশংসতার কথা বিবেচনা করলে মৃতের সংখ্যা আরো বেশী বই কম হবে না । ষ্টালিন এর দুঃশাসন শেষ হওয়ার পর লেবার ক্যাম্প এর সংখ্যা যদিও কমে গিয়েছিল তবে অত্যাচার ও নৃশংসতা কমেনি । তখনো প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ এ ধরনের কারাগারে বন্দি ছিল । পোটমা নামের এক শ্রম শিবির থেকে মুক্তি পাওয়া এব ব্রিটিশ বন্দী তার তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি জন সমখ্যে নিয়ে আসে । কারাগারের অত্যাচার ও পরিবেশকে ভুলে থাকার জন্য তারা কম বেশী চা পাতা ভিজিয়ে এক ধরণের বাদামী ঘন তরল পান করে নেশায় বুদ্ধ হয়ে থাকতে চেষ্টা করত ।

শ্রমশিবির ছাড়া অন্য কারাগারে অবশ্য একটু সুবিধা ছিল । মারামারির কারণে দন্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদি লেনিনগ্রাদের কারাগারের ঘটনা জানিয়েছিল । সে তার নাইলনের জ্যাকেট কারারক্ষীদের কাছে বিক্রি করে সে টাকায় কালো বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং সেখানে সে কয়েদিদের কাছে গোপনে চা বিক্রি করত । শ্রমশিবিরের অত্যাচার মানুষকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেত যে শাস্তি ও বিরতিহীন কাজ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য কয়েদিরা নিজেদেরকে গুরুতর ভাবে আহত কিংবা অংগহানীর/বিকলাংগ হওয়ার মত মারাত্মক ক্ষতি করত । কিছু কিছু কয়েদি অন্যান্য কয়েদিদেরকে ঘুষ দিয়ে নিজেদের হাতের ও পায়ের আংগুল লোহার বড় হাতুরী দিয়ে ভেংগে দেওয়ার অনুরোধ করত ।

এ ধরণের ঘটনা তৎকালীন অন্যান্য সোভিয়েত লেবার ক্যাম্পে ও স্বাভাবিক ছিল । ষ্টালিনের আতংকের সময়ে কলিমা বন্দী শিবিরের বন্দীরা কয়েক দিন বিশ্রাম পাওয়ার জন্য পায়ের পাতা জখম করত । এছাড়াও চামড়ার নীচে কেরোসিন তেল ইংজেকশন দিয়ে ইনফেকশন / ঘা সৃষ্টি করত এবং ভেজা কাপড় পড়ে এবং পায়ে জড়িয়ে রেখে ফ্রষ্টবাইট এ আক্রান্ত হতো । ঐ সব এলাকার তাপমাত্রা মাঝে মাঝে মাইনাস ৭০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যেত । পৃথিবীর শীতলতম সে সব স্থানে কয়েদিদের জন্য যে সব আন্ডারওয়ার সরবরাহ করা হতো তা ছিল রুমালের মত পাতলা ।

মোটা তুলার জ্যাকেট এবং ট্রাউজার বন্দীদেরকে ফ্রষ্টবাইটের হাত থেকে রক্ষা করতে পারত না । এই কাপড় গুলোও তুন্দ্রা অঞ্চলের প্রচন্ড ঠান্ডায় ভেজা ভেজা থাকত এবং কেউ যখনই সুযোগ পেত তখন অন্যের কাপড় শুকানোর রুম কিংবা ব্যারাকে রেখে আসলে তা চুরি করত । কয়েদীরা ফ্রষ্ট বাইটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে কোন ধরণের কাপড় তাদের পায়ের কাছে বেধে রাখত অতিরিক্ত রক্ষাকবচ হিসেবে । যা ক্যাম্প বানানোর সময় ব্যবহার করা মোটা ও ভারী কাগজের তৈরী সিমেন্টের খালি ব্যাগগুলো কালো বাজারে বিক্রি হতো । এগুলো শরীরের সাথে জড়িয়ে শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা চলত ।

ফেল্ট এর বদলে ক্যানভ্যাস দিয়ে প্রথমে বুট বানানো হতো পরে অবশ্য শ্রমশিবির গুলোতে ফেল্টের বুট সরবরাহ করা হয়েছিল । পুরোনো কার এর টায়ার দিয়ে জুতার সোল তৈরী করা হতো । বুটগুলো সারাদিন পানিতে ভিজত এবং দিন শেষে এগুলোর এতো ওজন হতো যে একজন কয়েদির পক্ষে এক কদম বাড়ানো কষ্টকর হতো । ষ্টালিনের দুঃশাসনের শেষে তাকে হেয় করার জন্য নিকিতা ক্রশ্চেভ এ সব গোপন তথ্য প্রকাশ করার অনুমতি দেয় । লেবার ক্যাম্পে কায়িক শ্রমের নিয়ম নীতির পরিবর্তন আনে ।

প্রতিদিন ১২ ঘন্টা শ্রম দেয়ার নিয়ম করা হয় যা বেড়ে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত হয়ে যেত । যে কয়েদি তার দৈনিক শ্রম ঘন্টা পুরণ করত সে দিনে আটশ গ্রাম রুটি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করত । যদি ঠিকমত শ্রম ঘন্টা শেষ করতে অসমর্থ হতো তখন রেশন কমে ৫০০ গ্রাম রুটিতে দঁড়াত । শাস্তি হিসেবে খাদ্যের রেশন প্রায়ই কমিয়ে দেয়া হতো । ৩০০ গ্রাম রেশন মানে ক্ষুধার্ত ও উপোষ থাকার মতই ।

কয়েদিরা ক্ষুধার জ্বালায় গ্রীজ, গাছের পাতা অন্যান্য মরা প্রাণীর মাংস খেত, তা যে রকমই পঁচা হউক না কেন। একজন সাধারণ মানুষ যে ৮ ঘন্টা কঠিন কায়িক শ্রম করে তার জন্য নূন্যতম ৩১০০ থেকে ৩৯০০ ক্যালোরী প্রয়োজন । কিন্তু শ্রম শিবির গুলোতে ১৯৭৭ পর্যন্ত মাত্র ২৬০০ ক্যালরীর খাবার সরবরাহ করা হতো । সাধারণ শাস্তি প্রাপ্তরা ২১০০ ক্যালরীর খাবার পেত এবং অবাধ্য ও বিশেষ শাস্তি প্রাপ্তরা একদিনে মাত্র ১৩০০ ক্যালরীর মত খাবার পেত । ষ্টালিন এর কলিমা শ্রম শিবিরে ভিটামিনের অভাবে স্কার্ভি রোগের মহামারি ঠেকানোর জন্য কয়েদিদেরকে ছোট উইলো গাছের পাতা ও পাইনের কাঁটা সিদ্ধ করা পানি খেতে দিত যাতে ভিটামিনের অভাব পুরণ হয় ।

জোঁক অন্যান্য পোকামাকড়ের আক্রমন প্রবল পওয়ায় শ্রম শিবিরে টাইফাস রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল । রাজনৈতিক বন্দীদেরকে সাধারণ কয়েদিদের সাথে রাখা হতো এ ধরনের কয়েদিরা তাদেরকে আতংকে রাখত, অত্যাচার করত, তাদের জিনিষ পত্র ছিনিয়ে নিত এবং ধর্ষন ও করত । মহিলাদের ক্যাম্পে বাঁচার তাগিদে অনেক মহিলা বন্দী পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে পড়ত । কলিমা শ্রম শিবিরে এক সময় প্রায় ২৫,০০০ মহিলা বন্দী ছিল । এলগিন নামে এক জায়গায় বানানো ক্যাম্পে প্রসুতিদের সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ।

এখানে যে সব নারী বন্দী পুরুষ কয়েদি বা অন্যান্যদের দ্বারা ধর্ষন কিংবা পতিতাবৃত্তির কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়ত তাদেরকে এনে রাখা হতো । সন্তান জন্ম দানের পর মা তার শিশুর সাথে এক সপ্তাহ থাকতে পারত এবং এ কারণে তার এক মাস কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হতো । মাকে বাচ্চাদের রুমে ঢুকতে দেয়া হতো না তবে। ভিজিটিং এলাকায় বাচ্চার সাথে দেখা করা যেতো । নয় মাস পরে মা যদি এলগিন বন্দী শিবির থেকে স্থানান্তরিত হয়ে অন্যত্র না যেত তবে প্রত্যেক মাসে তার শিশুকে দুই ঘন্টার জন্য দেখতে পারত।

মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এই নিয়ম মানা হতো না । কারণ তখন মহিলাদেরকে মাঠে কাজ করতে যেতে হতো । ক্যাম্পে জন্ম গ্রহন করা ও প্রতিপালিত শিশুরা যারা বেঁচে থাকত, সাত বছর বয়সে তাদেরকে তোলন এর একটা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় পাঠানো হতো ,তারপর কোন মা তার শিশুকে আর কোন দিন দেখতে পেত না । কলিমা সোনা, সীসার মাইন ও টিম্বার সংগ্রহের অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত ছিলো । ভরকুতা এবং পিশোরা কয়লার খনি সমৃদ্ধ অঞ্চল, পিশোরা নদীর বেসিন এলাকা বৃটেন এর চেয়ে বড়, বিশাল এক অঞ্চল এবং সুলভে বন্দীদের দিয়ে সম্পদ আহরনের জন্য ইউরোপিয়ান রাশিয়ার এই অঞ্চলেই বিশাল শ্রম শিবির গুলো গড়ে উঠে ছিল ।

সারা কাজাকাস্থান অসংখ্য কয়লার খনি নরলিকস্্ মলিবডেনাম খনির জন্য বিখ্যাত ছিল। এ ছাড়াও কেমেরোভোতে নিকেল, মলিবডেনাম ও ক্রোম এর পাশাপাশি টিম্বার আহরণের কেন্দ্র ছিল । ষ্টালিনের সময়কালে এডাম গালিনক্সি এই বিশাল পিশোরা কমপ্লেক্সের একজন কয়েদি ছিল । তার নিজ দেশ পোলান্ডে সোভিয়েত দখলদারীর সময় আন্ডার গ্রাউন্ড তৎপরতার কারণে এডামকে প্রথমে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল । পরবর্তীতে কোন এক অজানা কারণে দন্ড পরিবর্তীত হয়ে ১৫ বৎসরের কঠিন সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয় ।

এডাম গালিনক্সি তার মেয়াদের বেশীর ভাগ সময় কাটায় ভরকুতা শ্রম শিবিরের কারাগারে । ক্রশ্চেভের ক্ষমতা গ্রহনের পর এই ভরকুতা কারাগারের কয়েদিরা বিদ্রোহ করে । ক্রুশ্চেব এর সময় কারাগারের অবস্থা ও অন্যান্য দন্ড শিথিল করার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়। যা পরে কখনোই মানা হয় নি । সে সময় কেজিবি সেনারা রায়ট থামানোর জন্য ট্যাংক নিয়ে আসে ।

ভরকুতা শ্রম শিবিরে মহিলাদের ও কারাগার ছিল । মহিলারা বিদ্রোহী কয়েদী ও ট্যাংকের মধ্যে বাধা দান করার জন্য একত্রিত হয় । কেজিবি এসবে ভ্র“ক্ষেপ না করে মহিলাদের উপর ট্যাংক চালিয়ে দেয় এবং এসব মহিলা কয়েদী পিষ্ট হয়ে তৎক্ষনাৎ মারা যায় । ১৫ বৎসর কারাদন্ডের পাশাপাশি গ্যালিনস্কিকে ৫ বৎসরের জন্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং ভরকুতা স্থায়ী ভাবে বসবাসের দন্ড দেয়া হয় । গ্যালিনস্কির মতে এই বিচারক আসলে কেজিবির অফিসার ।

তা ছিল বিচারের নামে প্রহসন । তার মেয়াদ পুর্তির পর মৃত্যুদন্ড যে ভাবে বদলে গিয়েছিল সেই অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তাকে আমেরিকাতে অভিভাসন এর অনুমতি দেয়া হয় এবং সে ওয়শিংটনে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে । ওয়াশিংটনে সে কংগ্রেশনাল তদন্ত দলের কাছে সোভিয়েত রাশিয়ার লেবার ক্যাম্পের ও জেলখানা গুলোর জীবনযাত্রা সম্বন্ধে তথ্য প্রদান করে । গ্যালিনস্কি তার ভরকুতা যাওয়ার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলে যে, আমাদেরকে পশু বহনের খাঁচায় করে নেয়া হয়েছিল । তাকে যে সময় কারাগারে নেয়া হচ্ছিল তখন কয়েদিদেরকে নেয়ার জন্য বিশাল কনভয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং সাধারণ কয়েদী বহনকারী ভ্যানগুলোতে কাজ হচ্ছিল না ।

প্রায় একহাজার লোক এই কনভয়ে ছিল । এদেরকে ক্যাটল কার এ করে নেয়া হচ্ছিল এবং কারগুলোতে ষ্টালবার লাগিয়ে মজবুত করা হতো এর চারপাশে ছিল তারকাটার বেড়া এবং এ গুলো বাহির থেকে তালা লাগানো থাকতো। কয়েদী বহনকারী কনভয়ের ট্রেন গুলোর দুই দিকেই খুব শক্তিশালী সার্চ লাইট লাগানো থাকত এবং প্রহরীরা সশস্ত্র শিকারী কুকুর নিয়ে পাহারা দিত। প্রতিটি কামরার চারপাশে তাক বানানো এবং এতে ত্রিশ জনের মত থাকার ব্যবস্থা ছিল । কিন্তু এ সব কার এর কামরাতে পঞ্চাশ থেকে একশত জন কয়েদি ঢুকানো হতো ।

কামরার মধ্যে একটা লোহার চুলা বসানো কিন্তু ঠান্ডা এত বেশী ছিল যে কয়েদির নিঃ শ্বাস দেয়ালে বরফ হয়ে জমে যেত। এই বরফ গুলো কয়েদির মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনেছিল । কারন পানি এত কম দেয়া হতো যে পিপাসা পেলে কয়েদিরা এই বরফ চুষে কোনমতে পিপাসা মেটাতো । কামরাগুলোর মেঝেতে একটা গর্ত ছিল টয়লেট হিসেবে ব্যবহারের জন্য । এই ছিদ্র দিয়ে গোপন বাণিজ্যও চলত।

গ্রামের লোকজন এ সব ছিদ্র দিয়ে রুটি দেখিয়ে বলত আমাদেরকে জুতা বা কাপড় দাও রুটি দেব। এভাবে কয়েদিরা ক্ষুধা নিবারণের জন্য তাদের কাপড় চোপড় এর বদলে রুটি সংগ্রহ করত। কেজিবির প্রহরীরা ও দায়িত্বপুর্ণ ব্যক্তিরা কয়েদিদের জন্য সরকারী ভাবে বরাদ্দ খাবার না দিয়ে কাপড় বা জুতার বিনিময়ে সে সব খাবার খেতে দিত । এরা আবার ট্রেন যে সব গ্রামের উপর দিয়ে যেত সে সব গ্রামবাসীদের কাছ থেকে এই সব কাপড়ের বিনিময়ে ভদকা সংগ্রহ করত। এ সব ঘটনা এতই স্বাভাবিক ছিল যে ভরকুতা শ্রমশিবিরের ট্রেন গুলো আসার আগেই এর স্টেশন গুলোতে মানুষ ভদকা নিয়ে দাড়িয়ে থাকত তার বদলে কাপড় জুতা নেবার জন্য ।

ট্রেনে করে ভরকুতা যেতে গালিনস্কির ২১ দিন লেগেছিল । তাঁর মেয়াদকালে যে সর্বমোট ৬ টা শ্রম শিবিরে বন্দি ছিল এবং কয়লার খনিতে কাজ করত। ভরকুতা এত ঠান্ড যে মাটি তুন্দ্রার মত অর্থাৎ জমে বরফ হয়ে থাকত । এই শ্রমশিবির তৈরীর আগে স্থায়ী ভাবে এখানে কোন জনবসতি ছিল না । ক্যাম্প স্থাপনের পর কিছু কিছু কয়েদীকে এখানে স্থায়ী ভাবে থাকার শাস্তি দেয়া হয়েছিল এবং কিছু লোক ষ্টালিনের ব্যাপক স্থানান্তরের পরিকল্পনার শিকার হয়ে বাধ্য হয়েছিল এখানে আসতে ।

রাজবন্দী হিসেবে গালিনস্কির অবস্থা বেশ করুন ছিল বলা যায় । এই ধরনের কয়েদিদেরকে গার্ডরা যে কোন সময় ছ্টো খাট কারন দেখিয়ে গুলি করে হত্যা করতে পারত। ছোট খাট ভুলত্র“টি হলেই ক্যাম্পের কয়েদিদেরকে নির্জন কক্ষে রাখা হতো । বাইরের জগত থেকে তা একেবারেই আলাদা । এধরনের রুমে সিমেন্টের দেয়াল ঠান্ডায় জমে থাকত কারণ এর ভিতরে কোন আগুন থাকত না ।

কয়েদিদের কে কাপড় খুলে উলংগ করে এই তীব্র শীতে এখানে রাখা হতো । কাউকে কাউকে হাতে পায়ে শিকল দিয়ে রাখা হতো। এ ধরণের নির্জন কক্ষে থেকে বের হওয়ার পর একজন কয়েদিকে দেখতে বিভৎস লাগত । নোংরা এবং নিজের বর্জের গন্ধে তার চারপাশ দুর্গন্ধ হয়ে যেত। মারের আঘাতের চিহ্ন গুলো নীল ও কালো হয়ে যেত এবং তার শরীরে বিভিন্ন রকমের পোকামাকড় থাকত ।

এ সব দেশে অন্যান্য কয়েদিরা দুঃখ ও সহানুভূতি দেখালেও এ ধরণের পোকামাকড়, পঁচা ঘা ও দুর্গন্ধ সহ এসব কয়েদি থেকে সরে যেত। প্রহরীরা কয়েদিদের কে শাস্তি হিসেবে ভেজা শার্ট পড়তে বাধ্য করত। এ ধরণের শার্টে এক ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য ঢেলে দেয়া হতো। কিছুক্ষণ পর একটু শুকালে এ সমস্ত জামা কাপড় শক্ত ভাবে টাইট হয়ে যেত। এটা এমন এক পর্যায়ে যেত যে চাপে হাড্ডি পর্যন্ত ভেংগে যেত ।

এ ধরনের অত্যাচারের কথা অন্যান্য কয়েদিদের কাছ থেকেও জানা গিয়েছিল। এই শাস্তিতে অনেক কয়েদি অজ্ঞান হয়ে পড়ত এবং কেউ কেউ মারাও যেত । গালিনেস্কির ভাষায় রাশিয়ান কারাগার ও শ্রম শিবির গুলোকে ক্ষুধা, নৃশংস আচরণ, কিটপতঙ্গের আবাস এবং মানুষের প্রতি নির্মম ব্যবহার এর জায়গা ছিল যে কয়েদীরা মানুষ হিসেবে তাদের মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলত। কয়েদিদেরকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনা হতো । তারা শুধুমাত্র নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রান চেষ্টা করত।

কোন শ্রম শিবির থেকে কোন কয়েদি পালানোর চেষ্টা করলে তাকে সবার সামনে ধরে আনা হতো এবং দেখানো হতো যে সে পালাতে পারে নি । তারপর তাকে গুলি করে হত্যা করে প্রধান ফটকে তার লাশ রেখে দেয়া হতো যাতে সকালে যখন কয়েদিরা খনির কাজে যেতো তখন যেন সবাই তার লাশ তারা দেখতে পায়। ভরকুতার কয়লা খনিতে অমানবিক পরিবেশে ও অপ্রশস্থ জায়গায় কাজ করতে হতো। মানুষ হাঁটু গেড়ে বসে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে কাজ করত। এ সব জায়গায় কাজ করতে গিয়ে কয়েদিদের হাটু কনুই সব ছিড়ে যেত ।

খনির ছাদের খুটি গুলো ছিল সব নড়বড়ে । কয়েদিরা আগুন জ্বালানোর জন্য খুটি চুরি করার কারণে মাঝে মাঝেই খনিতে ধ্বস নামতো । মোমবাতি ব্যবহার করার কারণে খনিতে মাঝে মাঝে গ্যাস বিস্ফোরণ হয়ে কয়েদি মারা পড়ত। গ্যালিনেস্কির সাজার মেয়াদের শুরুতে কারাগারের কার্য দিবস ছিল ১২ ঘন্টা এবং দিন রাত ২ শিফটে কাজ হতো। ৬৫০ গ্রাম রুটি এবং দিনে দুবার ২০০ গ্রাম স্যুপ দেয়া হতো খাবার হিসেবে।

তুলা বীজের তেল ও মাছ দিয়ে স্যুপ বানানো হতো এবং মাছ গুলো লবণে ডোবানো নোনা এবং রুটি গুলোর মান ছিল নিু। কখনো তাজা মাছ ও সব্জী দেয়া হতো না । যদিও কয়েদিদেরকে পাইনের কাঁটা ও উইলো পাতার রস খাওয়ানো হতো তবুও স্কার্ভি রোগ মাহামারী আকারে বিরাজ করতো। শীত কালে ভরকুতার তাপমাত্রা মাইনাস ৪০০ - ৪৫০ ডিগ্রী নেমে আসত এবং মাঝে মাঝে এটা মাইনাস ৭৫ ডিগ্রী ও নেমে যেত। বৎসরের ৮ মাসই এখানে প্রচন্ড শীত ।

এই শীতে পড়ার জন্য মোটা ট্রাউজার ও ওয়েষ্টকোট এবং রাবার সোলের জুতা দেয়া হতো যার উপরটা সিনথেটিকের । সোভিয়েট ইউনিয়ন সব সময় তাদের কারাগার ও শ্রম শিবির সম্পর্কীয় পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনাকে ভয় পেত। সেজন্য তারা কিছু সাজানো শ্রম শিবির ও কারাগার তৈরী করেছিল পশ্চিমা মানুষকে দেখানোর জন্য । উন্নত বিশ্বের লোকজনকে এ সব জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো যাতে তারা এগুলো দেখে ধারণা করে যে রাশিয়ার কারাগার ও শ্রমশিবিরে ভাল আচরণ করা হয় । মস্কো থেকে ২৯ মাইল দুরে এ ধরণের একটা বানোয়াট শ্রমশিবির তৈরী করা হয়েছিল ।

এখানে যে কোন সরকারী সফরের আগে ৭০০ লোককে কেজিবিরা এনে রাখত এবং দেখাত যে এরা কয়েদি । পরিদর্শনকারীরা দেখতে পেত কয়েদীরা টেবিল টেনিস খেলছে, জাজ ব্যান্ড গুনছে, বাস্কেটবল ও ভলিবল খেলছে যা আসলে সাজানো। দর্শনার্থীদেরকে তথাকথিত কয়েদিদের রান্না ঘরে নিয়ে যাওয়া হতো । দেখানো হতো ৩৬০০ ক্যালরির মান সম্মত খাবার দেয়া হচ্ছে তাদের । কয়েদিদের কক্ষগুলো ছিল বেশ আরাম দায়ক ।

তাদের জানানো হতো যে কয়েদীরা পরিবার থেকে যে কোন সময় চিঠির মাধ্যমে খবর পেত এবং কেউ দেখতে চাইলে দেখা করতে পারে। বাস্তবে তা ছিল ঠিক উল্টো এবং নৃশংস। এভাবে কলিমার সোনার খনিতেও পরিদর্শনের জন্য দর্শনার্থীদের নিয়ে যাওয়া হতো । ১৯৩১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ লক্ষ কয়েদি শুন্য তাপমাত্রার নীচে এ সব খনিতে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল । হিসাব করে দেখা গেছে প্রতি এক টন সোনা আহরণ করতে কলিমা স্বর্ণ খনিতে ১০০০ মানুষ প্রান হারাতো ।

১৯৪৪ সালে রাশিয়ানরা আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরী ওয়ালেসকে কলিমা খনি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল । তার আগে কেজিবি গোটা ক্যাম্প খালি করে ফেলেছিল এবং কয়েদিদের জায়গায় কেজিবি নিরাপত্তা রক্ষীদের রাখা হয়েছিল । কাঁটা তারের বেষ্টনী সরিয়ে গার্ড টাওয়ার ভেংগে ফেলা হয়েছিল। গুদাম গুলো খাবারে পুর্ণ করা হয়েছিল । পরিদর্শন শেষে ফিরে এসে ওয়ালেস লিখেছিলেন কলিমা খনিতে কর্মরত শ্রমিকরা বিশাল দেহী মানুষ যারা ইউরোপীয় রাশিয়া থেকে দূর প্রাচ্যে এসেছে কাজ করতে ।

সাইবেরিয়ার বর্তমান জীবন আগে শোনা সেই অতীতের নির্বাসিত নির্মম জীবনের মত নয় । এটা প্রান প্রাচুর্যে ভরা । এ ধরনের পরিদর্শন আসলে রুপকথার গল্পের মত ছিল । তবে পার্থক্য এটাই যে রুপকথা ছিল কাল্পনিক আর শ্রমশিবিরে কয়েদিদের জীবন ছিল নির্মম রূঢ় একজন পুরানো কয়েদি আব্রাহাম সিফরিন আমেরিকার কংগ্রেসনাল তদন্তকারী দলের কাছে বন্দী জীবন সম্বন্ধে বিবৃতি দিয়েছিল । ১৯৫৩ সালে ষ্টালিন এর ইহুদী নিধন কার্যক্রমের ডক্টরস প্লট বাস্তবায়ন কালে তাকে গ্রেফতার করা হয় ।

। সিফরিন ২৫ দিন লুবিয়াংকা জেলে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়েছিল। তাকে ২৪ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলো ও ৬ টি টীম পালাকরে তাকে প্রশ্ন করত। সে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলে তাকে পানির ভিতরে ফেলা হতো যতক্ষণ না সে আবার নিজ পায়ে দাড়াতে পারতো । লুবিয়াংকা থেকে পরে তাকে মস্কোর আরেকটা কারাগারে স্থানান্তর করা হয় ।

তার সেলটা ছিল ৪ ফিট বাই ৫ ফিটের এবং মেঝে পাঁচ ইঞ্চি কাদা ও পানিতে পুর্ণ । তাকে হিলের উপর বসে থাকতে হতো কারণ সেলে শোয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না । এখানে সে প্রায় আটচল্লিশ দিন ছিল । প্রতিদিন খাবার এর সময় সে একটা দাগ দিয়ে রাখতো দেয়ালে এবং এভাবে সে দিন গননা করত। পরে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং আমেরিকা ও ইসরাইলের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্থ করা হয় ।

রায়ে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এবং মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের সেলে স্থানান্তর করা হয় । সেখানে রাতে দশটার সময় আলো নিবে যেত এবং ১১ টার সময় হত্যা যজ্ঞ চলত। এই এক ঘন্টা এখানে মৃত্যুর মত নিঃশব্দ নীরবতা বিরাজ করত। মৃত্যুর সারিতে দাড়ানো কয়েদিরা প্রহরীদের পায়ের শব্দ শুনত আর ভাবত আজ তার দিন কিনা । মাঝে মাঝে তারা মৃত্যুর পুর্বের শেষ আর্তনাদ শুনত ও মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার শব্দ পেত এবং বুঝত সব শেষ।

গালিনস্কির মত সিফরিনের দন্ডাদেশও অজানা কারনে বদলে যায় এবং সে লেবার ক্যাম্পে পঁচিশ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডের রায় পায় । এর সাথে তাকে ৫ বৎসর নির্বাসন ও ৫ বৎসর নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত করা হয় । সিফরিনের প্রথম ক্যাম্প ছিল শ্যালিয়াবিনস্ক । কারগার থেকে রেলওয়ে ভ্যানে করে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় । ভ্যানটার বাইরে একটা ভল্লুক আইসক্রিম খাচ্ছে এ ধরণের ছবি আঁকা ছিল ।

ছোট ভ্যানে গাদাগাদি করে কয়েদিদেরকে ঢুকানো হয়েছিল । শেষ তিনজন কয়েদির জন্য কোন জায়গা ছিল না তাদেরকে অন্য কয়েদিদের কাঁধের উপর ছুড়ে দেয়া হয়েছিল। এর পর তাকে নভোসিব্রিস্ক ও তারপর ওমক্স লেবার ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয় । নিষ্ঠুরতাকে ক্যাম্প গার্ডদের মাঝে জনপ্রিয় করা হতো । ষ্টালিনের সময় কিন্তু খুনের দায়ে হত্যা করা হতো না।

সোভিয়েট বিরোধিতার জন্য হত্যা করা হতো । সিফরিন জানিয়েছিল যে গার্ডরা যদি কোন পলায়নরত কয়েদিকে হত্যা করতে পারতো তবে ১৫ দিনের ছুটি পেত এবং তাদের আত্মীয় স্বজনদের দেখতে যেতে পারত। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য রক্ষীরা কয়েদিদেরকে পালানোর জন্য প্রলোভন দেখাতো এবং পালানোর চেষ্টা করলে গুলি করে হত্যা করত। বাইরের কাজের জায়গায় লাল পতাকা পুতে রাখা হতো। এসব পতাকার মার্কিং কেউ ভুল করে পার হয়ে গেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হতো ।

প্রমানের জন্য প্রহরীদেরকে লাশ আনতে হতো না শুধু মাত্র হাতের আংগুল কেটে আনলেই চলত । পরে তা ফিংগার প্রিন্ট এর সাথে মিলিয়ে দেখা হতো। একটা কয়েদিকে একবার উলংগ করে গাছের সাথে বেধে রাখা হয়েছিল। বৎসরের এ সময় শ্রমশিবির এলাকাতে বিষাক্ত মশা ও অন্যান্য কীট পতঙ্গের চরম উৎপাত ছিল। সন্ধ্যার আগেই সে কয়েদি পোকামাকড় ও মশার কামড়ে মৃত্যু বরণ করে ও তার লাশ হাজার হাজার লাল কামড়ের দাগে ভরে যায় ।

এ সময় দিনের বেলায় ও পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য কয়েদিদেরকে নেট এর কাপড় দেয়া হতো । ক্যাম্প নং-৪১০ এর সেল গুলো ৬ ফিট বাই ১২ ফিটের এবং সেখানে ১২ জন কয়েদিকে রাখা হতো । জানালার ধারে একটা তাক ছিল সবার জন্য। একটা খোলা টয়লেট পট ছিল সব কয়েদিদের জন্য । কয়েদিদের শ্বাস প্রশ্বাস এর বাতাস ফ্লোরে জমে থাকত ।

কাদার মত ৬৭৫ গ্রাম কালো রুটি ছিল কয়েদিদের জন্য বরাদ্ধ এবং প্রতিদিন পঁচা বাধাকপির সাথে ছোট ছোট নোনা মাছের স্যুপ তাদের খেতে দেয়া হতো। ১৯৬০ সালে সিফরিনকে ব্রিস্ক এর কাছে ভিখোরিভকা অঞ্চলের এক ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় । ক্যাম্পের চারপাশ কাটাতারের কয়েল দিয়ে ঘেরা তার ভিতর নয় ফিট উচ্চতার কাঁটা তারের বেড়া এরপর ৩ গজ চষা জমি এবং তারপর ১২ ফিট উচ্চতার কাঠের দেয়াল যার উপর আবার ৩ ফিট কাটা তারের বেড়া । এরপর আবার ৩ গজ চষা জমি এবং এরপর আবার ৯ ফুট কাঁটাতারের বেড়া । সবশেষে আবার কাঁটাতারের কয়েল দিয়ে চারপাশ ঘেরা এবং চার কোনায় ৪ টা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।

সেলের মধ্যে অসুস্থ ও পাগল কয়েদিদের সরানো হতো না । তাদেরকে সেখানে চিৎকার ও কাঁৎরানোর জন্য রাখা হতো এতে অন্যান্যদের মাঝে মানষিক চাপ পড়ত। এরা মেঝেতে মলমুত্র ত্যাগ করত এবং সেলের পরিবেশ পুতিগন্ধময় করে তুলতো এতে আরো কয়েদি অসুস্থ হতো । এই চারশত দশ ক্যাম্পে এক রবিবারে সিফরিন কিছু মহিলাকে প্রহরীরা গোসল করার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় দেখে । তাদের মধ্যে কয়েকজন নান ছিল তারা ঐ দিন পবিত্র বলে না।

অন্য সময় গোসল করতে চেয়েছিল । প্রহরীরা তাদেরকে নগ্ন করে চুল ধরে বরফের উপর দিয়ে টেনে হিচড়ে গোসলের জন্য নিয়ে যায় । মহিলা নানদেরকে আরো নানা ভাবে অত্যাচার করা হতো এ সব ক্যাম্পে । এরপর সিফরিনকে উদারনী ক্যাম্পে সরিয়ে নেয়া হয় । তাদের সেখানে যেতে ছয় দিন লাগে ।

এ সময় কয়েদিদেরকে দিনে ২ কাপ পানি রুটি ও লবণযুক্ত নোনা মাছ দেয়া হতো। উদারনী ক্যাম্পের সেল গুলো দশফিট বাই নয় ফিট । সাতজন থাকত এক সেলে । একজন মানুষের জন্য বরাদ্ধ ছিল ৩০ ইঞ্চি বাই সাড়ে ছয় ইঞ্চি । গ্রীষ্মে কয়েদিরা মাটি দিয়ে ইট বানাতো ।

শীতে যখন কিছু করা যেত না তখন তাদেরকে সেলে আটকে রাখা হতো । সেলে একটা পট ছিল মলমুত্র ত্যাগের ও একটা টেবিল ছিল অন্য কোনায় । বাকী ছোট্ট একটু জায়গাতে ২ জন এক সাথে একটু ব্যায়াম করে শীত তাড়াত তখন বাকী ৫ জন কক্ষে শুয়ে থাকতে হতো । এই ধরনের নির্মম জীবন ছিল বন্দী শিবির গুলোতে । সেই অমানবিক দিন আজ হয়তো নেই।

এ সব নাম না জানা বন্দীদের কষ্টের ও ত্যাগের বিনিময়ে আজ লৌহ কঠিন সোভিয়েত প্রশাসন ভেংগে গনতন্ত্রের হাওয়া লেগেছে। আশা করা যায় বর্তমান রাশিয়ার মুক্ত মানুষ সে সুফল ভোগ করবে। -অনুবাদ- ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।