মানবদেহের জন্য মারাত্দক ক্ষতিকর নানা ওষুধ ও রাসায়নিক সেবনের মাধ্যমে মোটাতাজা করা গরুতে সয়লাব হয়ে পড়েছে কোরবানির পশুর হাট। ক্রেতাদের চাহিদাও এসব গরুর দিকেই। রাজধানীসহ সারা দেশেই এসব মোটাতাজা গরুর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এগুলোর মাংস যে কারোর জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঈদুল আজহা সামনে রেখে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী পশুকে মোটাতাজা করতে অবাধে ব্যবহার করেছে নানা ব্র্যান্ডের পাম ট্যাবলেট, ডেক্সামেথাথন ও স্টেরয়েডের মতো ভয়ানক ক্ষতিকর উপাদানের ওষুধ। এসব ওষুধ পশুর দেহে প্রয়োগ করে রোগাক্রান্ত, কম ওজন ও চিকন স্বাস্থ্যের গরুকে মোটাতাজা করলেও হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।
এসব গরুর মাংস খেয়ে মানুষ লিভার, কিডনি, ক্যান্সার, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্তসহ মারাত্দক রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষজ্ঞের মতে, পাম, ডেক্সামেথাথন ও স্টেরয়েড ট্যাবলেট খাওয়ানোর পর পশুর চামড়ার ভেতরে বাড়তি পানির স্তর জমে পশুকে বেশি মোটাতাজা ও সবল দেখায়। তবে মাংসের ওজনে কম ও স্বাদহীন হয়ে পড়ে। এখন মোটা গরু মানেই মানুষের জন্য তাজা বিষ। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কোরবানি ঈদের পশুর হাটগুলোয় পশুর বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা খুবই প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ক্ষতিকর ওষুধ সেবনের মাধ্যমে মোটাতাজা করা গরু হাটে তোলা হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মোসাদ্দেক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এবার প্রতিটি গরুর হাটে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ টিমের মাধ্যমে গরুর রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যদি কোনো গরুর রক্ত পরীক্ষায় বিষাক্ত কিছু ধরা পড়ে তাহলে সেই গরুকে সিল করে দেওয়া হবে এবং গরু বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজধানীর আগারগাঁও গরুর হাটে আসা সাতক্ষীরার ব্যাপারি ইলিয়াস বলেন, আগে বাড়ি থেকে গরু বাজারে নেওয়ার সময় একটা গরু কয়েকজন মিলে নিয়ে যেতে কষ্ট হতো। আর এখন গরুগুলোর সে রকম তেজ নেই।
মনে হয় মাদকাসক্ত মানুষের মতো ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে থাকে। এর কারণ জানতে চাইলে ওই ব্যাপারি বলেন, 'বর্তমানে শতকরা ৭৫-৮০ ভাগ গরুই ইনজেকশন বা ওষুধ দিয়ে দ্রুত মোটাতাজা করা হয়। ফলে গায়ে শক্তি থাকে না, মাদকাসক্ত মানুষের মতো ঝিমায়। অনেক সময় মানুষের মতো স্ট্রোক করে মারাও যায় এসব গরু। কয়েক মাস ধরেই গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় গরু মোটাতাজাকরণের নানা কার্যক্রম চালায় খামারিরা।
রোগাক্রান্ত গরু অল্প টাকায় কিনে মোটাতাজা করে বেশি লাভে বিক্রি করতে কিছু কথিত পশু চিকিৎসক উৎসাহিত করেন সাধারণ মানুষকে। অধিক লাভের আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা গরু মোটাতাজাকরণে ব্যবহার করছে চোরাপথে আসা ভারতীয় ডেঙ্নি, স্টেরয়েড, হরমোন, উচ্চমাত্রার রাসায়নিক দ্রব্যাদি। এসব ওষুধ ব্যবহারের ফলে মোটাতাজা গরুর মাংসও মানবজীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এসব ওষুধ বিভিন্ন ফার্মেসি ও গবাদিপশু চিকিৎসালয়ে পাওয়া যাচ্ছে। ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা সহজেই গরুর খামারি বা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
এসব ওষুধ গরুকে খাওয়ালে কয়েক মাসের মধ্যে গরুর শরীর ফুলে মোটা হয়ে যায় এবং দেখতেও সুন্দর হয়। এতে দামও ভালো পাওয়া যায়।
যেভাবে করা হয় মোটাতাজা : বাজারে এ ধরনের মোটাতাজা গরুর মধ্যে পাবনা ব্রিড, অস্ট্রেলিয়ান-ফ্রিজিয়ান ব্রিড, ইন্ডিয়ান হরিয়ানা ব্রিড, পাকিস্তানি সাহিয়াল ব্রিড কিছু পরিচিত ব্র্যান্ড। তবে এর পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় ব্রিডিং পদ্ধতি যা লোকাল ক্রস ব্রিড নামে পরিচিত। এসব ব্র্যান্ডের সব গরুই মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় বড় করে বাজারে তোলা হয়।
গরু মোটাতাজাকরণ একটি নিয়মিত ও প্রচলিত পদ্ধতি। সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ এ জন্য গরু চাষিদের দুই থেকে আড়াই কেজি বিশেষ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত ইউরিয়া, লালিগুড় ও খড়ের একটি বিশেষ ধরনের মিকচার খায়ানোর পরামর্শ দেয়। আট দিন কোনো পাত্রে এ মিকচার বন্ধ করে রেখে তা রোদে শুকিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়। তিন মাস ধরে এটা খাওয়ালে গরু খুব দ্রুত মোটাতাজা হয়ে ওঠে। পশু চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত মোটাতাজা করতে ক্যাটাফস, বার্গাফ্যাট, বায়োমিঙ্ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছে।
ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে গরু মোটাতাজা করেছেন এমন একজন চাষি জানান, ১৫টি গরু মোটাতাজা করতে চিকিৎসকের পরামর্শমতো অনেক দামি ইনজেকশন, ট্যাবলেট ও পাউডার ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। গরুকে ক্যাটেল কেয়ার, ইনজ্যাইভিট, এনোরা, সেটরন ইত্যাদি ওষুধ খাওয়ানো হয়ছে। এ ছাড়াও বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গ্রো লিকুইড, বর্গাফেট, গ্রোভিট, ভারমিক, ডেক্সাভিট ইত্যাদি ওষুধ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। প্রাণিবিদরা মনে করেন, গরুকে স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ খাওয়ালে তার মারাত্দক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। গরুকে স্টেরয়েড-জাতীয় ড্রাগ খাওয়ালে তা যেমন গরুর জন্য ক্ষতিকর তেমনি ওই গরুর মাংসও বিষাক্ত হয়ে পড়ে।
বাজারের এসব ওষুধ গরুর শরীরে একপ্রকার বিষাক্ত চর্বি দ্রুত জমায়। এ মাংস ফরমালিনের মতো মানুষকে ধীরে ধীরে নিস্তেজ করে ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন : ভেটেরিনারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার বলেন, মানবদেহ বা গবাদিপশুর জন্য সব ড্রাগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। তাদের উচিত জনস্বাস্থ্যের স্বার্থেই এগুলো যথেচ্ছ বিক্রয় ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু আমাদের জানা মতে, এ ধরনের কোনো মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক সেলিম বারামী বলেন, গবাদিপশুর ক্ষেত্রে আমরা কেবল ওষুধ উৎপাদন ও আমদানি সংক্রান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকি। কিন্তু এর মধ্যে কোনো ওষুধের অপব্যবহার হয় কি না তা দেখার দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রাণিসম্পদ বিভাগের ডা. এস এম আমিনুল হক বলেন, ডেঙ্ামেথাথন-জাতীয় ওষুধ পশু বা মানুষকে খাওয়ালে এক সপ্তাহের মধ্যে মোটাতাজা হবে। তবে এই মোটাতাজা বেশি দিন স্থায়ী হয় না, বড়জোর দুই থেকে তিন মাস। আর এই ডেঙ্ামেথাথন গরুকে খাওয়ালে আর সেই গরুর মাংস মানুষ খেলে লিভার, কিডনি, ক্যান্সার, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্তসহ ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে।
সতর্কতার চিঠি, তবু বন্ধ হয়নি : প্রতি বছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত খেলায় মেতে ওঠে একশ্রেণীর অতিলোভী ব্যবসায়ী। এবার প্রাণিসম্পদ অধিদফতর আগাম সতর্কতা হিসেবে সারা দেশে চিঠি পাঠায়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সব কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশনা দিয়ে পাঠানো চিঠিতে অবৈধ উপায়ে গরু মোটাতাজা করার প্রক্রিয়া আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে বন্ধ করতে বলা হয়। পাশাপাশি চাষি ও বেপারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যও নানা রকম প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই বন্ধ করা যায়নি গরু মোটাতাজা করার ভয়ঙ্কর ব্যবস্থাটি।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, প্রতি বছরই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কোথাও যাতে কোরবানির কোনো পশুকে পাম, স্টেরয়েড-হরমোন বা এ-জাতীয় কোনো আইটেমের বিষাক্ত ওষুধ প্রয়োগ করতে না পারে সে ব্যাপারে আগাম নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। মহাপরিচালক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এবার প্রতিটি গরুর হাটে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ টিমের মাধ্যমে গরুর রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যদি কোনো গরুর রক্ত পরীক্ষার পরে বিষাক্ত কিছু ধরা পড়ে তাহলে সেই গরুকে সিল করে দেওয়া হবে এবং গরু বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কত গরু মোটাতাজা হচ্ছে? : জেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এ বছর দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেই অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা মূল্যের আড়াই লক্ষাধিক গরুকে অবৈধ পন্থায় মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কুষ্টিয়া জেলা কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জানান, এবার এ জেলায় ৫৫ হাজার গরু কোরবানির হাটগুলোতে বিক্রির জন্য মোটাতাজা করা হয়েছে। প্রতি গরুর গড় দাম ৪০ হাজার টাকা হিসেবে যার মূল্য দাঁড়ায় ২২০ কোটি টাকা। কেউ কেউ এক-দুটি, আবার কেউ সাত-আটটি করে খামারে গরু মোটাতাজা করছেন। কোরবানির পশুর বাজারে কুষ্টিয়ার গরুর ভালো চাহিদা আছে বলে তিনি জানান। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. কোহিনুর ইসলাম বলেন, এ জেলায় এবার কোরবানির হাটগুলোয় বিক্রির জন্য চাষি ও ব্যবসায়ীরা ৩০ হাজার গরু মোটাতাজা করেছেন।
মাগুরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শ্যামল কুমার পাল জানান, এবার এ জেলায় ২০ হাজার গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। শৈলকুপা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার সরদার খায়রুল বাশার জানান, গত বছর এ উপজেলায় ৮ হাজার গরু মোটাতাজা করা হয়েছিল, এবার ৬ হাজার গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। পশুসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে, গত বছর ঈদে ৫৭ লাখ পশু জবাই হয়েছিল, যার অধিকাংশই গরু। এ বছরও প্রায় একই পরিমাণ গরু কোরবানি হতে পারে বলে তাদের ধারণা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।