রাতে বাস জার্নি করতে বেশ লাগে। গরম কম থাকে, রাস্তায় জ্যামও থাকে না। রাতে যাত্রীরাও বেশ শান্ত থাকে, তাই কোলাহলও কম। বাইরের কিছু অবশ্য দেখা যায় না। অন্ধকারের মধ্যে শা শা করে ছুটে চলা, স্থির হয়ে বসে থেকেও ছুটে চলেছি ক্রমাগত।
আমাদের জীবনের মতই, মনে হয় ঠায় দাড়িয়ে আছি, তবু কী করে যেন হাত-পা বেড়ে বড় হয়ে গেলাম, চামড়ার ভাজ বাড়তে বাড়তে বুড়ো হয়ে গেলাম, কিছুই বুঝলাম না। মনে হয়, সেই ঠায় দাড়িয়ে আছি। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকার চেয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ভালো। আমি বসে বসে হারুদার কথা ভাবতে লাগলাম।
আমাদের হারুদা, পুরো নাম হারুণুর রশীদ।
আমাদের পিতৃপ্রদত্ত নাম যাই থাকুক না কেন, তা ক্রমাগত ছোট হতে থাকে। হারুণুর রশীদের ‘রশীদ’ এমনিতেই উড়ে যায়। হারুণুরও খুব শ্রুতিমধুর না, তাই এটাও সংক্ষিপ্ত হয়ে হারুণে টিকে সবার ক্ষেত্রেই প্রায়। হারুদার তাও টেকেনি, ‘ণ’ টাও উড়ে গিয়ে হারু হয়েই সবার মাঝে জুড়ে গিয়েছিলেন। নিঈজের জীবনেও, একটা নাম যে মানুষের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার সবচেয়ে ভালো উদাহারণ হারুদা।
কারো হারুদা, কারো হারু ভাই, হারু মামা, হারু কাকা। মুরুব্বিদের কাছে হারু মিয়া। হারু মিয়া হোক আর যাই হোক, পাড়ার টং দোকানে বসা বুড়োদের কাছে হারুদার অন্যরকম কদর ছিল। রাজনৈতিক আলোচনায় হারুদার তুলনা মেলা ভার। যে কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা হারুদার কাছে মিলতো।
উদ্ভট টাইপের সব ব্যাখ্যা। হারুদার সবচেয়ে ফেমাস ডায়ালগ ছিল, ‘জন গণ হলো এরশাদ!’ কথাটা তখন বুঝিনি, এখন বুঝি। লীগ-বিএনপি দুদলের কাছেই পাঁচ বছর পর পর জনগণ আর এরশাদের প্রয়োজন হয়। দুজনের কাছেই দো'আ-সমর্থন চায়, প্রতিশ্রুতিও দেয়, নির্বাচনের পর এরশানও কোন পদ পায়না, জনগণের অবস্থারও কোন পদন্নতি হয়না।
তখন ব্যাপারটা না বুঝলেও আমাদের কাছে প্রিয় ডায়ালগ ছিল এটাই।
যেখানে সেখানে কারণ অকারণে হেড়ে গলায় ঝেড়ে দিতাম কথাটা ‘জনগণ হলো এরশাদ! ’
বাসে আমার পাশের সিটটা খালিই ছিল, এখন লম্বা করে এক মধ্যবয়সী মহিলা বসলেন। ভদ্রমহিলা স্বাভাবিক বাঙ্গালী নারীদের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা! তবে বেশ সুন্দরী ছিলেন অল্পবয়সে, তা এখনো বোঝা যায়। কিছু কিছু মুখ থাকে যা একবার দেখলেই অনেকদিন মনে থাকে, তেমন একটি মুখ ভদ্রমহিলার। আমার পাশের সিটে বসে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে লাগলেন। আমি আবার ভাবনায় ডুবে গেলাম।
ডায়ালগটার মত আমাদের কাছে হারুদাও খুব প্রিয় মানুষ ছিল। শুধু বিকেলে পুরীর দোকানে প্রায়ই খাওয়াতেন বলে না, আমাদের সব কাজে-অকাজে হারুদাকে পাওয়া যেত। কারো প্রয়োজন পড়া প্রেমে, আছে হারুদা, কারো প্রেমে জ্যাম লেগে গেলেও হারুদা ছাড়া গতি নেই। হারুদার নিজের কোন প্রেমিকা ছিল না যদিও, তবে কলেজের সব মেয়েই হারুদার ফ্যান। হারুদা যেদিন কলেজে যেত, সেদিন ক্লাসরুম ফাঁকা হয়ে যেত।
সব মেয়ে হারুদার পেছন পেছন ঘুরতো, আর হারুদাও এক-একটা কথা বলে মেয়েদের হাসিয়ে হাসিয়ে কাশিয়ে মারছেন। আমরা যারা তখনো প্রেম করতে পারিনি, তারা কিছুটা হেলাস ফিল করতাম জেলাস হয়ে হারুদার প্রতি। ব্যাপারটার ইতি টেনে দিতে হারুদাকে প্রেমে বাঁধনে বাঁধা ছাড়া বিকল্প চিন্তা আমাদের অল্প ঘিলুর মাথায় আসেনি। তাকে বললাম, ‘মাইয়াগুলারে আর কত দিবেন আশা, এবার একটারে দেন ভালোবাসা! ’ হারুদার তাৎক্ষণিক উত্তর, মুখে হাসি, ‘আমি ওগো সবাইরে ভালোবাসি! ’
আমরা হেল্পলেস মানে সাহায্যহীন হয়ে হারুদাকে বোঝাতে গেলাম যদি এত মেয়ের সাথে ঘোরেন, তবে তো চরিত্রহীন বলবে এরশাদ মানে জন গণ! আমরা কখনোই হারুদার চাপার চাপে টিকতে পারিনি, এমন হয়নি কখনো আমরা হারিনি। হারুদা আমাদের আদালতে আত্মপক্ষ এমন ভাবে সমর্থন করা শুরু করলেন যাতে আমরা বুঝলাম, এরশাদ শিকদারের মত কুখ্যাত সন্ত্রাসীকেও নিষ্পাপ প্রমাণ করা সম্ভব যদি হারুদা থাকে ল-ইয়ার হিসেবে।
হারুদা বোঝানো শুরু করলেন আমাদের,
”যে সব প্রাণীকে ভালোবাসে, সে হলো মহান জীবপ্রেমি, গৌতম বুদ্ধের মত! রাইট? ”
রং বলার কোন কারণ নেই, বললাম রাইট। এরপর থেকে আমরা শুধু রাইট বলে গেলাম একটার পর একটা কথায়! হারুদা বলতে লাগলেন,
“যে সব মানুষকে ভালোবাসে, সে মহান মানবতা প্রেমি, মাদার তেরেসার মত।
যে সব নারীকে ভালোবাসে, সে মহান নারীবাদী, বেগম রোকেয়ার মত!
যে শুধু একটা মেয়েকে ভালোবাসে, সে মহান প্রেমিক, রোমিওর মত!
এখন আমি যদি কয়েকটা মেয়েকে ভালোবাসি, তাহলে আমিও মহান কিছু একটা না হয়ে চরিত্রহীন হবো কেন ? ”
অকাট্য যুক্তি। আমাদের শক্তি সামর্থ নেই যুক্তি খন্ডাবার, ভাঙবার।
‘বাসটা এত জোরে চালাচ্ছে কেন ?’ পাশে বসা ভদ্রমহিলার কথায় আমার ধ্যান ভাঙলো।
ভদ্রমহিলা প্রায় আমার বয়সীই, কিন্তু কথা বলছেন বাচ্চাদের মত। বাস কেন জোরে চালাচ্ছে সেটা ড্রাইভার জানে, আমি তো আর বাস চালাচ্ছি না। কিছু না বলে একটু হেসে কাঁধ ঝাকালাম। তারপর আবার শরীর এলিয়ে দিলাম সিটে।
হারুদা চাপা যাই মারুক, আমরা হাল ছাড়লাম না।
আমাদের ক্রমাগত চাপের ফলে হারুদা রাজি হলেন একজনকে প্রপোজ করতে। যেহেতু সবাই হারুদার পছন্দের, তাই লটারি করে বেঁছে নেয়া হলো একজনকে, মনোয়ারা নামের একজনের নাম উঠলো।
তখন হারুদার আইনস্টাইনের প্রতি দারুণ ইন্টারেস্ট। উঠতে বসতে আইনস্টাইন কপচান। আসলে হয়েছে কি, কলেজে সায়েন্স ফেয়ারে আমাদের স্টলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হারুদা।
আমরা ব্যানারে হারুদার নাম লিখেছিলাম হারুস্টাইন। তারপর থেকেই তার আইনস্টাইন রোগ। প্রপোজেও পড়লো তার ছাপ। আইনস্টাইনের একটা গল্প বলে অন্যরকমভাবে প্রপোজ করলেন হারুদা,
“মনোয়ারা, তুমি মেরিলিন মনরোর নাম শুনেছো ? হলিউডের ফেমাস আ্যাক্ট্রেস ছিলেন। উনি একবার আইনস্টাইনকে বলেছিলেন, 'চলুন আমরা বিয়ে করে ফেলি, আমাদের যে সন্তান হবে, সে হবে আমার মত সুন্দর আর আপনার মত বুদ্ধিমান! ’ আইনস্টাইন হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘যদি উল্টোটা হয়! ’
এখন হারুস্টাইনের সাথে আইনস্টাইনের মিল, মনরোর সাথে তোমার নাম মনোয়ারার মিল।
ওরা দুজন বিয়ে না করলেও আমরা করতে পারি ?’
মনোয়ারা ভেবেছিল হারুদা সবসময়ের মত ফান করছে। জোকারদের এই সমস্যা, তাদেরও ইমোশন বলে কিছু আছে, এটা কেউ ভাবতেই চায় না। মনোয়ারাও ইমোশনের তোয়াক্কা না করে ফান করে উত্তর দিলো, “হুম, সন্তান আপনার মত দেখতে হলে তাকে চিড়িয়াখানার বানরের খাঁচায় রাখা যাবে, আর আপনার মত বুদ্ধিমান হলে তাকে গাধার খাঁচায় রাখতে হবে। ”
ব্যাপারটা হারুদার ইগোতে লাগলো খুব। রেগে গিয়ে ঘোষণা দিলেন মনোয়ারার প্রেম হবে এলাকার সবচেয়ে বদখত দেখতে ছেলেটার সাথে।
সত্যিই তাই হলো, বদরুল নামে বিচ্ছিরি দেখতে এক ছেলের সাথে। শুধু তাই না, ওরা বিয়েও করেছিল, এখন তাদের সুখের সংসার। আর হারুদা আজ ………… !
পাশের ভদ্রমহিলা একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। আমি যে বিরক্ত হচ্ছি তা চেহারায় ফুটিয়ে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, কিন্তু ভদ্রমহিলার কোন খেয়ালই নেই। আমার গন্তব্যস্থান কোথায় শুনে বললেন ওই এলাকার একজনকে চিনতেন নাকি! যেহেতু আমার ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে ওই এলাকায়, তাই একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করি কাকে চিনতেন।
কিন্তু এতে ভদ্রমহিলা আরো উত্সাহ পেয়ে যাবেন বেশি কথা বলার, তাই আর বললাম না। ফেবুটা চেক করার জন্য মোবাইলটা বের করলাম।
হারুদা ফেসবুকেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। স্ট্যাটাস দিলেই মেয়েদের লাইক-কমেন্টে ভরে যেত। অনলাইন হলে তো কথাই নেই, একটার পর একটা নক আসতেই থাকতো চ্যাটে।
হারুদার সবাইকে রিপ্লাই দিতে একটু দেরী হয়ে যেত, আর এটা নিয়ে মেয়েরা মাইন্ডও করতো। এ নিয়ে হারুদা আক্ষেপ করে আমাদের কাছে প্রায়ই বলতেন, “মেয়েদের প্রিয় গায়ক আরফিন রুমি, অথচ দেখ, আরফিন রুমি বউদের মত মুক্তমনা তো দূরের কথা, একজন আরেকজনের সাথে হিংসায় পুড়ে যায়, আজিব! ” আর আমরা তখন একটার পর একটা Hi ছুড়ে যাই অনলাইনে থাকা সবগুলো মেয়েকেই আমাদের আইডি থেকে। মাঝে মাঝে দু-একজন দয়াপরবশ হয়ে রিপ্লাই দিলেই সপ্ন দেখা শুরু করি এই বুঝি হয়ে গেল প্রেম, এর সাথেই। কারো কারো হয়েও যায়, শুধু হারুদা বাদে। হারুদা
জনপ্রিয় থাকে, আমরা প্রিয় হয়ে যাই।
“এটা কোন জায়গা ?” পাশের ভদ্রমহিলার দিকে এবার বেশ বিরক্তি নিয়েই তাকালাম। “আপনি যেমন অন্ধকার দেখছেন, আমিও তেমন ই দেখছি !” আমার গলায় বেশ ঝাঝালো ভাব ছিল এবার। বুঝতে পেরে চুপসে গেলেন ভদ্রমহিলা। আর কিছু বললেন না।
একবার হারুদার বাসায়, হারুদা পিসিতে চ্যাট করছে, আমি পাশে বসে আছি, হঠাত একটা মেয়ের কাছে থেকে মেসেজ আসলো,
“আমার ভালো লাগছে না জানু !”
আমরা দুজনই তো অবাক।
এই মেয়ে তো হারুদার ফ্যান-এসি না, একবারে ফ্রেন্ডের উপরে গার্লফ্রেন্ড হওয়ার পর্যায়ে আছে। আমি তখন একটু একটু কবিতা লেখার চেষ্টা করি। আমার কাব্যঝুলি থেকে চমত্কার একখানা কবিতা হারুদার হবু প্রেমিকাকে উত্সর্গ করলাম মানে হারুদার হয়ে মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম আর কি!
“ভালোবাসো বলতে এতদিন লাগে নাকি সোনা,
ভালো কেন লাগছে না,
জানটুস বেইবি ছাগল ছানা !”
এহেন উতকৃষ্ট টাইপে কবিতা পেয়ে মেয়ে কী পরিমাণ আবেগে আপ্লুত হবে, তা ভেবে আমি আর হারুদা যখন হাবুডুবু খাচ্ছি ভাবনার জলে, তখন অথৈ জলে ফেলে দিলো মেয়ের কাছে থেকে আসা মেসেজ, “WTF…… Thats just a speeling mistake! wanna say, 'জানো', not 'জানু' !!! ইডিয়ট!!!
আক্কেলগুড়ুম আমাদের। মেসেজটা তাহলে ছিল, ”আমার ভালো লাগছে না জানো!”
আমি তখন নতুন কবিতা সাজাচ্ছি মাথার ভেতর,
“”ভুলগুলো যদি ফুল হয়ে ফোটে,
বিশুদ্ধতায় কি এসে যায়,
ভুল খুশিতে যদি মুখে হাসি ছোটে
কি প্রয়োজন শেষে বাস্তবতায় ?
ও আমার জানটুস বেইবি ছাগল ছানা,
বুঝলে না, তুমি বুঝলে না। ”
কিন্তু হারুদা তখন বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন বলে লুকিয়ে গেলাম কবিতাটা।
হঠাত খেয়াল করলাম পাশের ভদ্রমহিলা কখন যেন নেমে গেছেন। মিসবিহেভ করায় একটু খারাপ লাগলো। আসলে মহিলা একটু বোকা-সোকা টাইপের, এতটা রাফভাবে কথা না বললেও হতো। যাক, আমি ব্যাগ থেকে হেডফোন বের করে আইপডে গান শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করলাম।
একবার আমাদের এলাকায় হারুদার এক গায়িকা আত্মিয় আসলেন, টিভি তালিকাভুক্ত শীল্পি নাকি।
তার গান শুনে আমাদের মোটামুটি ইভা রহমান হবার দশা। ঈদের আগের দিন, মানে চাঁদরাতের সন্ধায় বেশকিছু ছেলে-মেয়ে আমরা হারুদা আর সেই গায়িকাকে ঘিরে বসে আছি। আমরা অনেক অনুরোধ করেও হারুদাকে গান গাওয়াতে পারলাম না। গায়িকা ভদ্রমহিলাও যখন বারবার বলছিলেন, তখন হারুদা শুরু করলেন, গান না, গল্প,
“ছোটবেলা থেকেই আমি ভালো গান গাই। গান গাওয়া ছোটবেলা থেকেই আমার প্যাশন, আর গান না গাওয়া প্রফেশন।
ব্যাপারটা বুঝিয়েই বলি, ছোটবেলায় সকালে একবার ওয়াশ রুমে গিয়ে গলা খুলে গান গাওয়া শুরু করতেই বেসিনের কাঁচ চিড় ধরে ভেঙ্গে গেল। তারপর থেকে বাবা গান না গাওয়ার জন্য প্রতিদিন ২ টাকা করে মাসে ৬০ টাকা দেন।
সেই বয়সে ৬০ টাকা অনেক টাকা আমার কাছে। আর সেটাই ছিল শুরু। ক্রিকেট খেলার সময় মাঠের পাশে বাড়িটার জানালার কাছে ফিল্ডিং এ দাড়িয়ে গান গাওয়া শুরু করতেই বাসার মালিক এসে কিছু টাকা দেয়ার আশ্বাস দিল যাতে আমি আর গান না গাই।
ক্লাসরুমে যাতে গান না গাই তার জন্য মাসিক বৃত্তি দেয়ার ব্যাবস্থা করলেন প্রিন্সিপাল। মেসে উঠলাম যখন, তখন মেসের মালিক তার সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার থাই গ্লাস বাঁচাতে মাসে ২০০০ টাকা দেয়া শুরু করলেন। ভাবছেন, তারা আমাকে কেন টাকা দিচ্ছে ? কারণ এছাড়া তাদের কোন উপায় নেই। গান গেয়ে গ্লাস ভাঙ্গার বিরূদ্ধে কোন আইন নেই এখন পর্যন্ত।
যাই হোক, এভাবে আমার মোট ইনকাম দাড়ালো ৬০০০ টাকা।
এই বাজারে ৬০০০ টাকা হাত খরচ নেহায়েত কম নয়।
অঘটনটা ঘটলো সেদিন, যেদিন আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে গান গাইতে বললো ফোনে। আমি গান শুরু করে এক কলি গাইতে না গাইতেই 'খটাশ' করে গুলিতে খুলি ফেটে যাওয়া সাউন্ড হলো ওপাশ থেকে। পরে জানতে পারলাম খুলি নয়, গার্লফ্রেন্ডের দেড় লক্ষ টাকা দামের আইফোনের ডিসপ্লে আড়াইখানা চিড় ধরেছে। ও আপসেট হলেও আমি তখন হিশেব করছি, সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার গ্লাস বাঁচাতে দুই হাজার টাকা দিলে দেড় লক্ষ টাকার আইফোন বাঁচাতে কত বৃত্তি পাচ্ছি।
কিন্তু ব-তে বাংলাদেশের সবজায়গাতেই ব-তে বৈষম্য। এবার আমার ব-তে বৃত্তির বদলে ব-তে ব্রেক-আপ জুটলো।
তারপর থেকেই আমার ব-তে বিষণ্ণ দিন কাটছে কিন্তু ব-তে বিরহের গান গাইতে পারছি না, পাছে আবার………… "
আমরা তো হারুদার গল্প শুনে এতই অবাক হয়েছি যে তখন মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে নিয়ে দাড় করিয়ে দিলেও কারো আর ধরার সাধ্য নেই আমরা সবাক নাকি নির্বাক প্রাণী, ঠিক এতটাই অবাক ছিলেন সেই গায়িকা আত্মীয়ও। তিনি তার স্যামসাং গ্যালাক্সি বাঁচাতেই আর গান শুনতে না চেয়ে আকাশপানে উদাশ হয়ে তাকিয়ে রইলেন গ্যালাক্সি মানে ছায়াপথের পথে।
আমার গন্তব্য এসে গেছে, এবার নামতে হবে।
কতদিন পর যে এলাম, পুরো এলাকা জুড়ে ছেলেবেলার গন্ধ যেন উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আহ!
এই বাসস্ট্যান্ডেই একদিন হারুদা ডিম কিনতে এসেছিলেন আমাকে সাথে নিয়ে। হারুদার অতিসাধারণ বেশভুষা দেখেই কিনা জানিনা, দোকানদার বললো, ‘‘ভালো ডিম ৩০ টাকা আর ভাঙ্গা ডিম ১৫ টাকা, কোনডা লইবেন ? ”
হারুদা জবাবটা ছিল দারুণ, “তাইলে ভালো ডিম ভাইঙ্গা দেউ! ”
যদিও কথাটা ফান করেই বলেছিল, যেভাবে সবসময় বলে। কিন্তু সেই প্রথম আমি খেয়াল করেছিলাম হারুদার মুখে ঘোর অপমানিত ছায়া, মায়া হয়েছিল খুব।
বাসস্ট্যান্ডে নেমে ভ্যান গাড়িতে উঠলাম। এই অন্চ্ঞলে রিকশা চলে না।
সারারাত নির্ঘুম কেটেছে। এক কাপ চা পেলে বেশ হতো কিন্তু এখনো কোন দোকান খোলেনি। ভ্যানটা যে পেয়েছি এতো ভোরে, তাই ভাগ্য।
এই বাসস্ট্যান্ডেই শেষবার কথা হয়েছিল হারুদার সাথে। অনেক বিষাদ মাখা, কষ্টে খা খা করা একটা মানুষকে দেখেছিলাম সেদিন হারুদার মাঝে।
যে মানুষটা সবসময় মানুষকে হাসায়, তার ভেতরে যে কষ্ট জমা, তা আমি সেই প্রথমবারের মত দেখলাম। নিঃসঙ্গ জীবনের চেয়ে বেশি কষ্টের জীবন হতে পারে না। হারুদার সঙ্গের অভাব হয়তো ছিল না, সহানুভূতির একটা মুখের খুব অভাব, আমি সেদিনই বুঝতে পারি। হারুদার হয়তো জ্বর হয়েছে, চোখ-মুখ লাল করে বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে হারুদারও ইচ্ছে করতো, কেউ জল ছলছল চোখে কপালে হাত রাখুক, একটু দুঃখ দুঃখ মুখে পাশে বসে থাকুক। কেউ করেনি, হারুদার জ্বর চোখ কখনো জল ছলছল বালিকাকে দেখেনি, দেখেছে খলবল করে হেসে হেসে বলতে বরং, ‘হারু দ্য হট গাই! ’
"আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাত পাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কিনা,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।
আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন?’”
আমার কেবলই মনে হয় নির্মলেন্দু গুণ এই কবিতা হারুদার জন্যই লিখেছে। খুব নীচু গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কখনো ভালোবাসোনি কাউকে, হারুদা ?”
হারুদা জবাব দিয়েছিল, “আমি অবাক করতে পারি কাজে, কথায় মুগ্ধ করতে পারি। কিন্তু মেয়েরা তো মুগ্ধতা খোঁজে সাময়িক সময়ে, চিরদিনের জন্য যার হাত ধরে, তার চোখে মুগ্ধতা নয়, নির্ভরতা খোঁজে, আমি তাকে নির্ভরতা দিতে পারিনি! ”
হারুদা মানুষকে অবাক করতে ভালোবাসে।
হাসিয়ে ফাঁসিয়ে কিংবা কাশিয়ে অবাক করেছে অসংখ্যবার। তবে আমি সেদিন এসব শুনতে চাইনি একটুও। কিন্তু আমার সেদিন অবাক হওয়ার দিন। হারুদা বলে চললো,
“জানিস মারুফ, কার্ডের প্যাকেটে ৪ টা কার্ড থাকে অপ্রয়োজনে, জোকার। কোন খেলায়ই তাদের কাজে লাগে না।
হার্ট, ডায়মন্ড, ক্লাব এদের কোন একটা কার্ড হারিয়ে গেলেই শুধু কাজে লাগে। হারানো কার্ডটা খুঁজে পেলে কিংবা নিউ প্যাক কেনার সাথে সাথে জোকার আবার অপ্রয়োজনীয় তালিকায়। আমি সেই জোকার রে মারুফ, সেই জোকার! যখন রিক্রিয়েশন প্রয়োজন, তখনই এই হারু দ্য জোকার ইউজ হয়। তারপর সবাই ডাস্টবিনেই ছুঁড়ে ফেলে প্রয়োজন ফুরোলেই। হারু তাই সবার কাছে শুধু হেরেই গেছে, হারু দ্য গ্রেটেস্ট হারুপার্টি, লুজার! ”
আমার কিছু বলার ছিল না।
সত্যিই প্রয়োজন ফুরোলে সবাই হারিয়ে গেছে। আমাকে হারুদা সবসময় অন্যচোখে দেখতো। এই আমিই এত বছরে একবার খোঁজ নেইনি, সেই যে ঢাকায় শিফ্ট করলাম। ব্যাস্ততা শুধুই অজুহাত, সত্যিই তো হারুদাকে আমার আর কি প্রয়োজন, অপ্রয়োজনে আমরা কর্পোরেট মানুষেরা একটা শ্বাসও ছাড়ি না। হারুদা মৃত্যুপথযাত্রী, এই খবর না পেলে হয়তো আর আসাই হতো না।
এত অল্পবয়সে লিভার পচিয়ে সবখানে হেরে যাওয়া হারু এবার জীবনের কাছেও হারতে বসেছে। শুরুতেই বলেছিলাম, নাম যে মানুষের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলে তার শ্রেষ্ঠ উদাহারণ হারুদা। হারুদা অলোয়েজ হারুপার্টি!
হারুদার বাড়ির সামনে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ঘুরতেই হারুদার বড় ভাইকে দেখলাম। মুখ দেখেই বুঝে গেলাম, অবস্থা খারাপ, হারুদা আছে না নেই সেই প্রশ্ন মনে দোলাচল খেতে শুরু করতেই বড় ভাই ভাঙ্গা গলায় বলতে শুরু করলো, “কাল রাত থেকে শুধু তোমারেই খুঁজতাছে, সময় আর বেশি নাই রে ভাই, নাই! ” ভিজে আসছিল ভাইয়ার গলা। আমি আর সুযোগ না দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
হারুদার কাছে বসে একটু ডাকতেই সাড়া মিললো, মুখে হাসির আভা দেখা গেল। কি যেন বলতে চাইছে, ঠোঁট দুটো কাঁপছে। কানটাকে খুব কাছে নিয়ে মুখের তিনটা শব্দ শুনলাম, ‘ড্রয়ার’, ‘ছবি’, ‘খবর’!!!
তারপরই কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল। আমি পাশে বসা ডাক্তারের দিকে তাকালাম, পাল্স, বিট চেক করে মাথা নেড়ে বললো, ‘নেই’ !!
কী সহজ শব্দ, নেই, হারুদা নেই, এই এখনো আমার হাত চেপে ধরে আছে, চোখের কোণের জলটুকু ঝুলে রয়েছে অথচ কি সহজে বলে দিল নেই। আর কোথাও নেই হারুদা, কোথাও নেই এই স্বার্থপর পৃথিবীর।
আর কখনো গম্ভীর গলায় রসিকতা করে হাসিয়ে আমাদের গম্ভীরতা ভেঙ্গে দেবে না। এই তো হারুদা, এই তো, এই ছুঁয়ে আছি, তবু কোথাও নেই হারুদা। হেরে যাওয়া হারু হারতে হারতে এবার হারিয়েই গেলো না হারানো এক বুক কষ্ট নিয়ে।
হারুদা সম্ভবত ড্রয়ারে কারো ছবি খুঁজতে বলেছিল, তাকে খবর দিতে বলেছিল। আমি হারুদার ড্রয়ার খুঁজতে লাগলাম।
একটা অনেক পুরোণো খামের ভেতর একটা সাদাকালো ছবি আর একটা ভাঁজ করা কাগজ। ছবিটা দেখেই আত্মার মধ্যে ধক করে উঠলো। দশ সেকেন্ডের মধ্যে আমি চিনতে পারলাম, ছবিটা বাসে আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রমহিলার অল্পবয়সের। ইনিই কি তাহলে সেই মেয়ে যে হারুদার কাছে মুগ্ধতা নয়, নির্ভরতা খুঁজেছিল। ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছিল, এই এলাকায় তার কে একজন পরিচিত আছে, একজনটা তাহলে হারুদা! সব মিলে যাচ্ছে।
ইশ, কেন যে তখন কথা বললাম না, তাহলে হয়তো জানতে পারতাম। তাকে এখানে নিয়ে আসলে হারুদা অন্তত মৃত্যুর পূর্বে আরেকবার প্রিয় মানুষটার অবাক দৃষ্টিটা দেখে যেতে পারতো। নাহ, হারুদা তুমি এবারও হেরে গেলে। হারুপার্টি হারুদা।
চিঠিটা খুলে পড়তে যাবো, এমন সময় বাইরে থেকে ডাক পড়লো।
চিঠিটা পকেটে রেখে বেরুতে বেরুতে ভাবলাম, ঠিকানা পেলে হয়তো ভদ্রমহিলাকে একটা খবর দেয়া যেত। কোথায় যে নেমেছে তাও তো খেয়াল করিনি। তাহলে শেষ দেখাটা হয়তো দেখে যেতে পারতেন।
হারুদার দাফনের কাজ শেষ করে রাত হয়ে গেছে বেশ। সকালের আগে বাস নেই, কিন্তু আমার তো ঢাকায় রাতেই ফিরতে হবে।
রেন্ট কার থেকে অনেক ঝামেলায় একটা কার যোগাড় করে ফিরছি।
হারুদা আর কোথাও নেই। কবর দেয়াটা কেমন একটা ব্যাপার। যেন চিত্কার আমি হারুদার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে ফিরলাম। কোথাও নেই হারুদা, কোথাও নেই।
হেরে যাওয়া হারু হারিয়ে গেছে চিরতরে। এই প্রথম আমার চোখে জল বেরিয়ে এলো। কেউ দেখলো না সে জল, কেউ জানেনা শুধু রাতের বাতাসে ছুঁয়ে গেল, অন্ধকারে সময় বয়ে গেলো। সময় মুছিয়ে দেবে আমার মন থেকেও হারুদাকে। কোথাও থাকবে না হারু, কোথাও না।
চিঠিটার কথা মনে পড়লো। পকেট থেকে বের করলাম। চিঠির নীচে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। নাহ, চিঠিতেই তো ঠিকানা দেয়া ছিল হারুদার প্রেমিকার মানে সেই ভদ্রমহিলার। আগে দেখলে খবর দেয়া যেত।
চিঠি পড়তে শুরু করলাম,
“তুমি,
………জানো, তাসের প্যাকেটে ৫২টা তাস থাকে, এর মধ্যে ৪টা কার্ড থাকে যারা এম্নেই থাকে, জোকার।
আমিও না এরকম,জানো। একবার পড়ে গিয়ে ডান হাতের কব্জি মচকে গেলো। পরেরদিন আমার ধর্ম পরীক্ষা। মা আমার হাতে বরফ লাগাচ্ছে, তার তো চিন্তার শেষ নাই।
হাতের চিন্তা তো আছেই, তার চেয়েও বড় চিন্তা পরেরদিন পরীক্ষা দেবো কি করে ? আমি তখন নিজের মনেই আছি, আমার কোন ভাবনা-চিন্তা নেই। নিজের মত বা’হাতে ফোন টিপছি, টিভি দেখছি। এদিকে মা বরফ লাগাচ্ছে, স্যারদের ফোন দিচ্ছে, কি করা যায়। আমি তখন চিন্তা করে মা কে বলছি,“মা চিন্তা কর, তুমি না খাইয়ে দিলে আমি আজকে বা’হাতে খেতাম। ভাবো একবার, আমি বা’হাতে হাপুস-হুপুস করে ডাল দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছি! হাহাহাহ! ” মা চোখ গরম করে এমনভাবে তাকালো যে আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে গেলাম, মায়ের পেট থেকে এটা কি বের হয়েছে, মানুষ নাকি এলিয়েন।
খারাপ পাড়ার একটা মেয়েকে বলেছিলাম, “পতিতালয়ের মেয়ের এমন আ্যানজেলের মত চেহারা হওয়াটা ঠিক না। ” মেয়েটার দুঃখ পাওয়া উচিত ছিল, পায়নি। ওর হিউমার অনেক হাই। এবার হসপিটালে যে নার্সটা আমাকে চেক করে দিত, সে রাতে একবার আসলো, এসে জিজ্ঞেস করলো, “কি অবস্থা এখন ?” তখন আমি বমি-পেট ব্যাথায় শেষ। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না, তবু চিঁহি সাউন্ড করতে করতে বললাম, “হুম, ঠিকই আছে, তবে আপনার চেহারার সাথে সাদা খুব একটা যাচ্ছে না, ব্ল্যাক অর ডিপ ব্লু পড়বেন আপনি।
” হয়তো ওনারও হিউমার হাই কিংবা ভেবেছেন জ্বরের ঘোরে আবোল-তাবোল বকছি। তাই চুপচাপ চলে গেছেন। তুমি যখন আমাকে বললে, আমি আমার অসুস্থতা নিয়ে ফান করলাম স্বাভাবিকভাবেই। তুমি রেগে গেলে সিরিয়াসনেস না থাকায়। সিরিয়াস কিভাবে হতে হয় আমার জানা নেই।
কখনো হবো বলে মনেও হয় না। আমার প্রায়ই মনে হয় মৃত্যুর পর বিচার শেষে যখন আমাকে নরকে পাঠানো হবে, তখন আমি নরকের দরজার সামনে দাড়িয়ে নরকের আগুন দেখতে দেখতে প্রহরীকে হয়তো জিজ্ঞেস করবো, “ভেতরে কি জুতা খুলে যাবো, আমি আসলে জুতোর ফিতে বাঁধতে পারিনা, আম্মু বেঁধে দেয়, আম্মু তো স্বর্গে, আপনি কি আমার জুতোর ফিতে বেঁধে দেবেন পরে? ! ” প্রহরী মুখের এক্সপ্রেশান কি হবে, এটা দেখার জন্য হলেও আমি একবার নরকে যেতে চাই। আমি ঠিক এতটাই জোকার, সিরিয়াস কি করে হই?!
কেন এমন করি ?
বলা কঠিন তবে প্রথমে তোমায় বললাম না, কার্ডের কথা, জোকার, এই কার্ডটা কোন খেলায় ব্যবহার হয়না, বড়জোর অন্য কোন কার্ড মিসিং থাকলে নেয়া হয়, আবার হারানো কার্ডটা ফিরে এলেই ওকে ব্যাক করতে হয় নিজের জায়গায়। এই কার্ডটার জন্য আমার খুব মায়া লাগে, আমিও তেমনি, কারো কোন কাজে লাগি না, একদম অপ্রয়োজনীয় সব জায়গায়। যদিও বা কারো কোন ছোট্ট কাজে লেগে যাই, সেই গর্ব বুকে করে ফিরে যাই নিজের জায়গায়, ডাস্টবিনে।
যেতে না চাইলেও ছুঁড়ে ফেলা হয়।
একদিকে থেকে লাভ কি ?! আমি জোকারের দুটো অর্থই নিজের ভেতর পুষি, আমি এমনই।
এমন একটা অপদার্থের ওপর রাগ করে থাকাও কি একরকম বোকামি না ?
আমি জানি, তুমি বোকা না।
ইতি,
আমি। "
জানা কথাগুলোই আবার পড়লাম যদিও তবু আমি ঘোরে আটকে গেলাম।
এই অক্ষরগুলো জুড়ে থাকা আবেগ-আক্ষেপগুলোয় এমন একজন মানুষের অস্তিত্বের ছোঁয়া লেগে আছে যে এক বুক আক্ষেপ নিয়ে অস্তিত্ব হীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
ভদ্রমহিলার যে ঠিকানা দেয়া আছে, তা আমার যাবার পথেই পড়বে। হারুদার না দিতে পারা চিঠিটা কি দিয়ে যাবো আমি ভদ্রমহিলাকে ? হারুদার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পুর্ণ করবো ?
ঠিকানাটা পেরুনোর সময় গাড়ি থামাতে বলতে গিয়েও বললাম না ড্রাইভারকে। চিঠিটা পেলে ভদ্রমহিলা কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না, অপরাধবোধে ভুগে কষ্ট পাবেন মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত।
হারুদা বেঁচে থাকতে কখনো কাউকে কষ্ট দেয়নি, মৃত্যুর পরও তাই তাকে কারো কষ্টের কারণ করতে পারিনা।
হারুদাকে তাই আবার হারিয়ে দিলাম। হারুপার্টির হারু মৃত্যুর পরও হেরে যাচ্ছে। সুখী পৃথিবী সুখে থাকো, নাইবা জানলে একজন হারুর গোপন কষ্ট, নাইবা জানলে কতখানি দিয়ে গেলো তোমাদের।
এমনই হয়। যারা সবসময় মানুষকে হাসিয়ে তাদের কষ্ট কমায়, সেই জোকারদের কষ্টগুলো চাপা পড়ে থাকে বুকের নির্জনতম কোঠায়।
ক্যাম্পাসের হাস্যজ্জল ছেলেটাকে আড্ডার শিরোমণি হতে দেখি আমরা, কেউ জানে না, সেই ছেলেটা মাঝরাতে বালিশ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠে থেমে যায়, পাছে কেউ শুনে ফেলে। কষ্টগুলো এভাবে ক্রমাগত লুকোতে লুকোতে এভারেষ্ট সমান কষ্ট নিয়ে একদিন পৃথিবী ছাড়ে। সত্যি তাদের কান্না কেউ দেখে না। কেউ জানে না রাত ৪ টার সময় তাদের খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে। ভোরের আলোয় কেউ যদি দেখে ফেলে জোকারের চোখে জল, সে যে আরো বড় হাস্যকর জোকস হয়ে যাবে।
তাই চার্লি চ্যাপলিনের মত কমেডিয়ানকেও কান্না লুকিয়ে বলতে হয়, “I am walking in the Rain,
and no one can see I’m crying!”
কিংবা ব্রিটিশ কমেডিয়ান টনি হ্যানকককে তার সুইসাইড নোটসে লিখতে হয়, ”Things went wrong so many times.” মিডিয়াতে সবচেয়ে বেশি সুইসাইড করে কমেডিয়ানরাই। ফেবুতে যে ছেলেটা সারাদিন সারারাত ফানি স্ট্যাটাস-কনেন্ট লিখে বেড়ায়, সেই ছেলেটার গোপন দীর্ঘশ্বাস ভার্চুয়ালের এই ছায়াহীন জগতের কোথাও বিন্দুমাত্র ছায়া ফেলে না।
তবু ভালো থেকো হারুদা। হারতে হারতেই না হয় ভালো থেকো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।