লেখাটির শিরোনাম ভেবেছিলাম “জামায়াতের অনলে পুড়ছে জিয়ার বিএনপি”। কিন্তু সবশেষ ২৬ অক্টোবর, শনিবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রথম ফোন করা, ২৮ অক্টোবর গণভবনে রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ এবং তৎপরবর্তী পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়েছে, লেখার শিরোনামটি যদি হয় “আত্মহননে জিয়ার বিএনপি” তাহলেই বোধকরি যথার্থ হবে।
গেল ২৫ অক্টোবর, শুক্রবার দেশবাসীর যাবতীয় ভয়, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা পেছনে ফেলে শেষতক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্ধারণ করে দেওয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। দাবি একটাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে আসছে সাধারণ নির্বাচন হতে হবে।
যে দাবির পক্ষে বছরাধিক কাল ধরে করে আসা আন্দোলন শেষে ২১ অক্টোবর, সোমবার বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন একটি ‘রূপরেখা’।
যাতে তিনি জানান, ১৯৯৬ আর ২০০১ সালের তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে পাঁচজন করে নিয়ে একটি নির্বাচন সময়ের সরকার গঠন করতে হবে। যে দশজন একমত হয়ে দেশের সম্মানিত একজন ব্যক্তিকে সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন।
তবে খালেদা জিয়ার এই রূপরেখার যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা আদৌ আছে কি না তা নিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যথেষ্ট সন্দেহ আর সমালোচনা। যার প্রেক্ষিতে ২২ অক্টোবর জাতীয় সংসদে গিয়ে খালেদা জিয়া উপস্থাপন করেন কিছুটা সংশোধিত আরেকটি রূপরেখা। যেটি উপস্থাপন করার পর সরকারি দলের কোনো প্রতিক্রিয়া না শুনেই অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা।
তবে বিরোধী দলের এসব রূপরেখা উপস্থাপনের গোটা প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয় নির্বাচন সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘সর্বদলীয় সরকার’ গঠন সম্পর্কিত প্রস্তাবনার উপস্থাপনের পরই। যা তিনি উপস্থাপন করেন ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে।
যে ভাষণে দেশে যে এক ধরনের রাজনৈতিক সংকট চলছে তা স্বীকার করেন সরকার প্রধান। সংকট সমাধানে বিরোধী দলকে আহ্বান করেন ‘সমঝোতা’ করতে। সহিংসতার পথ ছেড়ে দেশ ও দেশের মানুষকে ‘শান্তি’ দিতে।
‘অনুরোধ’ করেন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে। সংকট সমাধানে সরকারের ‘সদিচ্ছা’র কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। আর এসব করতে বিরোধী দলের সঙ্গেও ‘পরামর্শ’ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বলা ‘সমঝোতা’, ‘সদিচ্ছা’ ‘অনুরোধ’ আর ‘পরামর্শ’ এমন সব শব্দকে প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি নেত্রী আগে থেকে নির্ধারিত ২৫ অক্টোবর তারিখেই সমাবেশ করার অঙ্গীকার করেন জনগণের কাছে।
তবে কি না সংসদীয় রাজনীতির গণতন্ত্র আর সেই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে কতগুলো বৈশিষ্ট বা অনুষঙ্গ অপরিহার্য।
যেগুলো হচ্ছে: সরকারি দল, বিরোধী দল, ছায়া সরকার, আলোচনা, সমঝোতা, জনস্বার্থে সরকারের নেওয়া কার্যক্রমের গঠনমূলক ও বাস্তবভিত্তিক বিরোধিতা, ওয়াকআউট আবার ফিরে আসা ইত্যাদি।
নব্বই দশকের শুরুতে নগরভিত্তিক জনআন্দোলনে উৎখাত হয় দীর্ঘ নয় বছরের এরশাদীয় স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তবে সেই উৎখাত পরবর্তী পরিস্থিতিকে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে খোদ এরশাদের সঙ্গে করতে হয় ‘সমঝোতা’। রাতের অন্ধকারে জনগণকে রাজপথে রেখে সেই ‘সমঝোতা’ কীভাবে হয়েছিল তা দেশবাসী জানেন। যাকে আমার অগ্রজ এক সাংবাদিক উল্লেখ করেছিলেন, অসাংবিধানিক আন্দোলনের ‘সাংবিধানিক গর্ভপাত’ বলে!
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সমঝোতা ও সম্মতিতে দেশে প্রথমবারের অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় তত্বাবধায়ক সরকার নামের নির্বাচন ‘করিয়ে’ একটি স্বল্পমেয়াদের সরকার ব্যবস্থা।
যা পাকিস্তানের মতো দীর্ঘদিন সামরিক স্বৈরাচারের শাসনে থাকা দেশটিতেও ব্যবহার করা হয়েছে জনআস্থা অর্জনে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের দেশেও সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেবার মতো দুটি দলের (জনগণের আকাঙ্ক্ষামতো না হলেও নিজেদের শ্রেণিগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ) প্রতিই জনঅনাস্থা (অন্তত নির্বাচন অনুষ্ঠান) থেকেই অপরিহার্য হয়ে ওঠে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
যে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠান হয় উনিশশ’ একানব্বই সালে। আর সেই নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি। নিজেদের আন্দোলন ও সমঝোতার ফসল সেই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণের দেওয়া রায় আপাতত মেনে নেয় সে সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ।
কিন্তু মাস কয়েক যেতে না যেতেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের সংসদ বর্জন ও সরকার হটানোর আন্দোলন। দৃশ্যমান থাকে না সংসদীয় রাজনীতির কোনো বৈশিষ্ট্যই। এমনি পরিস্থিতিতে ৯৬’র নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যে নির্বাচনকে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ অভিধায় অভিহিত করে পরাজিত দল বিএনপি। পা রাখে আগের সরকারের বিরোধী দল আওয়ামী লীগের পথেই।
শুরু হয় সরকার প্রত্যাখ্যান আর সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি।
২০০১ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট। আবারও বিরোধী দল হিসেবে অ-সংদসীয় রাজনৈতিক চর্চার ভূমিকায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপির এই (২০০১-২০০৬) মেয়াদ শেষের নির্বাচন নিয়ে আমরা দেখি ভিন্ন এক সংস্কৃতি।
ক্ষমতা ধরে রাখতে যারপরনাই কলঙ্কিত করা হতে থাকে তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রক্রিয়া।
যা কি না আগের সরকারগুলোর সময়েই শুরু হয়েছিল। আর তা কখনও প্রধান উপদেষ্টাকে নিজের পক্ষে রাখতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নির্বাচন আর তাতে বিরোধী দলের আপত্তি। কখনও-বা প্রশাসনিক পুর্নবিন্যাসের মাধ্যমে।
২০০১-২০০৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগের সংসদ বর্জন আর সরকার হটানোর আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নিজের পক্ষের একটি তত্বাবধায়ক সরকার গঠনে মরিয়া হয়ে ওঠে বিএনপি। সরকারের মরিয়া মনোভাব আর তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কঠোর ও সহিংস অবস্থানে দেশে তৈরি হয় অসহনীয় এক অধ্যায়।
ফলশ্রুতিতে জাতিকে সইতে হয় দু’বছরের বেশি সময়ের একটি অনির্বাচিত শাসন।
অনেকটাই প্রত্যক্ষ সেনাসমর্থিত সেই তত্বাবধায়ক (?) সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন মহাজোট সরকার। যে সরকারকে প্রথম দিন থেকেই প্রত্যাখ্যান করে বিরোধী দলে থাকা বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
যদিও সরকার পতনের এই আন্দোলন কার্যকর কোনো পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারেনি বিএনপি-জামায়াত।
তবে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে সহিংসতায় মত্ত হয়েছে বিএনপির অন্যমত শরীক দল জামায়াতে ইসলামী। যার শিকার হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। ক্ষতিতে পড়েছে দেশের অর্থনীতি।
এমনি এক অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাবদলের আরেকটি অধ্যায় দেশের সামনে এখন অপরিহার্য। আগেই লিখেছি, যার দাবিতে বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত সোচ্চার হয়েছিল মহাজোট সরকার গঠনের অব্যবহিত পর থেকেই।
কিন্তু এরই মাঝে, দেশকে আর কখনও অসাংবিধানিক কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি না করার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে মহাজোট সরকার। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়ে যায় তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত সাংবিধানিক এখতিয়ার। যার পক্ষে সংশোধিত হয় সংবিধান। প্রবর্তন করা হয় দলীয় সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধি-বিধান।
মহাজোট সরকারের এই বিধি-বিধানমতো পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের প্রবল আপত্তির মুখে সরকার বদলের অপরিহার্যতার সময়টাও এখন ফুরিয়ে যাওয়ার শেষপ্রান্তে।
তাই তো জনমানুষের উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক অবসানের দাবিও সোচ্চার হচ্ছে ক্রমশ। আর জনগণের সেই দাবির পক্ষে ১৮ অক্টোবর, শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, তাতে বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া এবং সবশেষ ২৬ অক্টোবর বিরোধী দলীয় নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন করা। এসবই গোটা জাতিকে উপস্থিত করেছে আরেক নতুন বাস্তবতার সামনে।
২৫ অক্টোবর, শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে ‘নির্দলীয়’ সরকারের অধীনে আসছে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ তৈরি করতে আলোচনা বা সংলাপের ‘সূচনা’ (initiate) করার দাবি জানান বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। আর সেজন্য সময়ে বেঁধে দেন ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত।
অর্থাৎ একদিনের মধ্যে আলোচনার ‘সূচনা’ করার দাবি জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রতি।
প্রধানমন্ত্রীও সেই মতো ২৬ অক্টোবর, শনিবার দুপুরে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে ফোন করেন। বিরোধী দলীয় নেত্রীর ‘লাল ফোন’টি বারবার বন্ধ পান বলে জাতিকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরও হাল ছাড়েননি আওয়ামী লীগ নেত্রী। পরে ঠিক হয়, সন্ধ্যা ছয়টায় ফোনে বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী।
সে মতো কথাও হয় প্রায় ৩৭ মিনিট। যাতে প্রধানমন্ত্রী দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। আর সে নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলীয় নেত্রীকে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানান গণভবনে। একই সঙ্গে আহ্বান রাখেন তিনদিনের টানা হরতাল প্রত্যাহার করতে। সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর এই এগিয়ে আসায় তাৎক্ষণিক অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন দেশের মানুষ।
কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে উবে যায় দেশের মানুষের সেই স্বস্তি পাবার অভিপ্রায়। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণের জবাব দিতে সংবাদ ব্রিফিং করেন বিরোধী দলীয় নেত্রী। যাতে তার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তারই প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। যা আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করারই সামিল। কেননা মারুফ কামাল খান বিএনপি নামের দলটির রাজনৈতিক কোনো পোর্টফোলিও ধারণ করেন না, তিনি নিছকই নেত্রীর একজন দাপ্তরিক কর্মচারি মাত্র।
অথচ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর সংবাদ সম্মেলনে তার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তারই দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রীর ফোন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দলীয় নেতার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে নির্দলীয় সরকারের দাবি নীতিগতভাবে মানার ঘোষণা দেওয়া হলেই সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হবে। হরতাল তুলে নিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের জবাবে বিরোধী দলীয় নেত্রী পরিষ্কার জানিয়ে দেন, এটা ১৮ দলীয় জোটের কর্মসূচি বলে তা তার একার পক্ষে তুলে নেওয়া সম্ভব নয়।
আর এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কোনো পর্যবেক্ষক নয়, বরং সাধারণ একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, ১৮ দলের অন্য কোনো শরীক দল ‘ফ্যাক্টর’ নয়। সব থেকে বড় ‘ফ্যাক্টর’ হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।
এই ‘জামায়াত-নির্ভরতা’ সব থেকে বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপিকে আরও বেশি নির্ভরশীল করেছে ধর্মকে ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ হাসিল করা শক্তিগুলোর ওপর। যা বিএনপির জন্য নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা করার সামিল বৈ আর কিছুই নয়।
তবে বিএনপির এই ধরনের আত্মঘাতী অবস্থানের কার্যকারণ জানতে আমাদের চোখ রাখতে হবে ৭৫ পরবর্তী ইতিহাসের পাতাগুলোতে। ৭৫ এর পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু তথা বাংলাদেশের অনন্য এক রাজনৈতিক উচ্চতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসে একাত্তরের মুক্তিযযুদ্ধবিরুদ্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি। যার ধারাবাহিকতায় প্রথমে সামরিক ,পরে ‘হ্যাঁ’ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হয়ে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চিন্তা-চেতনা পরিপন্থী শক্তির অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন জিয়াউর রহমান।
যিনি নিজেই একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখে সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেন। বীর এই সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্ব দেন ‘জেড ফোর্স’ নামের একটি বিশাল যোদ্ধাদলের। যার স্বীকৃতি দিতে এতটুকু পিছপা হননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেনাবাহিনীতে সম্পূর্ণ একটি নতুন পদ সৃষ্টি করে জিয়াউর রহমানকে তিনি অধিষ্ঠিত করেন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান পদে।
দেশের শাসনক্ষমতায় নিজেকে অপরিহার্য করতে জিয়াউর রহমান ৭৫ পরবর্তীতে বহুদলীয় গণতন্ত্র (?) প্রবর্তনের পাশাপাশি বহু দলের, বহু মত-পথের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন নিজের দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি।
যেখানে ঠাঁই করে নেন মুজিব তথা আওয়ামী লীগবিরোধী ‘বাম’ ও অনেকাংশে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা, জায়গা নেন মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানপন্থী ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা। যাদের অবস্থান সবসময়েই ছিল মানুষের স্বাধীনতা, মুক্তি, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধি ও সংস্কৃতিচর্চার বিরুদ্ধে।
জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশি জাতীতাবাদ’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রত্যয়ী বিএনপিতে আজও সেই তিনটি ধারা বিদ্যমান। তবে গেল ৩৭ বছরের ধারাবাহিকতায় আজকের বিএনপিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের ধারাটি অনেকটাই ম্রিয়মান। বলা যায় দলটিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়ের শক্তিটি পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে।
এমনি পরিস্থিতিতে যারপরনাই সংহত জায়গা করে নিয়েছে মানবতাবিরুদ্ধ, ধর্মাশ্রয়ী জামায়াতে ইসলামী। আর তাতে সহযোদ্ধা হিসেবে শক্তি যোগাচ্ছে সাবেক মুসলিম লীগপন্থীরা। হায়রে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় বহু মত-পথের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দলটির আজকের পরিণতি!
বিএনপির কাঁধে ভর করে জামায়াতে ইসলামীর শক্তিমত্তা অর্জনের প্রক্রিয়ার শুরুটা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে হলেও, তা যথার্থ হয়ে ওঠে ২০০১ সালে সরকারের অংশীদার হবার মধ্য দিয়ে। সেই থেকেই বিএনপির নীতিনির্ধারণে জামায়াতের সদম্ভ খবরদারি, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের আধিপত্য ও উপস্থিতি বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোকে ছাপিয়ে যাওয়া, হেফাজতের ওপর ভর করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার তৎপরতা বিএনপির জামায়াত-নির্ভরতারই প্রমাণ রাখে।
পাঠকের সুবিধার্থে যেগুলোর কিছুটা বিস্তারিত করছি।
আমার রাজনৈতিক উপলব্ধিমতো বিএনপির এই জামায়াত-নির্ভরতার শুরু চারদলীয় জোট সরকারে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের শেষ সময়ে জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সম্মেলনকেন্দ্রিক সমাবেশ মঞ্চে আসন নেন বিএনপি নেতা তারেক জিয়া ও ড. খন্দকার মোশাররফসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা।
তারেক জিয়ার এভাবে ‘একাত্ম’ হবার পর থেকেই ‘জাতীয়তাবাদী’ এই দলটিকে নানাভাবে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহারের সিদ্ধ হয়ে ওঠে জামায়াত। যা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার-বিরোধিতায় জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিএনপির এক ধরনের ‘প্রচ্ছন্ন’ সমর্থনে। যে সমর্থনের সুযোগে জোটবদ্ধ কর্মসূচিগুলোতে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর আধিপত্য থাকবার কথা থাকলেও, তাতে মূখ্য শক্তি হয়ে উঠছে জামায়াত ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।
যার প্রমাণ আমরা পাই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএনপি সমর্থিত) নির্বাচনে ‘জামায়াতপন্থী’দের বিতর্কিত বিজয় এবং তার প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক নেতাদের পাল্টা জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ গঠন ও তাতে বিএফইউজের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা।
সিলেটে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে আধিপত্য নিয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শিবিরের ‘মৃদু’ সংঘর্ষ এবং তারপরও শিবিরকে সমাবেশের সামনে জায়গা দিতে খালেদা জিয়ার নির্দেশ।
যখন আমরা দেখি সম্প্রতি রাজধানীতে হয়ে যাওয়া সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের কনভেনশনে খালেদা জিয়ার ‘আপোসহীন’ যোগ দেওয়া এবং তাতে হালের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তনের ধারক কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মযহারের রাজপথ না ছাড়তে খালেদা জিয়ার প্রতি জোরালো আহ্বান!
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরকারের বেঁধে দেওয়া জায়গায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মুক্তির দাবিসম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে জামায়াতের সদম্ভ অবস্থান। সবশেষ চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ‘সূত্রপাত’ (খালেদা জিয়ার দাবিমতো) করতে বিরোধী দলীয় নেতাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত বিএনপির অবস্থান।
শুধু জামায়াতের সাংগঠনিক আধিপত্যই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে না আজকের বিএনপি।
একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ (?)’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকে সরে এসে জামায়াতের চাওয়ামতো ‘ইসলামি জাতীয়তাবাদ (?)’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত দেশের অন্যতম প্রধান এই দলটি।
যে ‘সংগ্রামই’ দেশকে উপহার দিচ্ছে সংঘাত, সহিংসতা,ধর্মীয় জঙ্গিবাদ; আর বিএনপিকে ঠেলে দিয়েছে আত্মহননের পথে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।