এক সময়ে বাংলাদেশের খেলা বলতে মূলত ফুটবলকেই বোঝাত। আহামরি মান না থাকলেও এ খেলার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। এখন আর সেই দিন নেই, ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়নের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বলতে পাগল। অবশ্য না হয়ে উপায়ও নেই, ক্রিকেটে যে সাফল্য এনে দিয়েছে তা অন্য খেলার সম্ভব হয়নি। শুধু কি তাই বিশ্ববিখ্যাত ক্রিকেটারদের টপকিয়ে সাকিব আল হাসান বেশ ক'বার ওয়ানডে ও টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে সেরা অল রাউন্ডার হয়েছেন।
এটা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য গৌরবের। যাক ক্রিকেটের জোয়ারের মধ্যেও আরেক খেলা আজ দেশের ক্রীড়ামোদীদের মাঝে ঠাঁই পেতে চলেছে। বলা যায়, শতকরা ৯০ ভাগ লোকেরই এ খেলা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। অথচ এ গলফই এখন দেশের সুনাম বয়ে আনছে। পত্রিকায় বড় বড় শিরোনাম দিয়ে গলফের খবরও প্রকাশিত হচ্ছে।
অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও এ খেলার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আর এসব কিছু সিদ্দিকুর রহমানকে ঘিরেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের গলফাররা যে সাফল্যের পতাকা ওড়াবে তা ছিল স্বপ্ন।
সেই সিদ্দিকুরই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছেন। ২০১০ সালে ব্রুনাই ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই।
এবার তো দিলি্ল ওপেন জিতে তিনি শুধু দেশ নয় বিশ্বকেও নাড়িয়ে দিয়েছেন। টুর্নামেন্টে প্রাইজমানি ছিল পৌনে ২ কোটি টাকার উপরে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কোনো ক্রীড়াবিদ এত টাকার পুরস্কার পাবেন তা অবশ্যই আলোচনার বিষয়। কিন্তু অর্থের চেয়ে এখানে পজিশনটাই গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বিখ্যাত বিখ্যাত গলফারদের পেছনে ফেলে সিদ্দিকুর যেভাবে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে পাওয়া লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন তা কখনো ভোলার নয়।
ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডকে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইটওয়াশ করে পুরো জাতি যখন মুশফিকদের গুণকীর্তনে ব্যস্ত ছিল তখন সিদ্দিকুরই প্রমাণ দিলেন শুধু ক্রিকেট নয় গলফও জাতিকে সাফল্য এনে দিতে পারে। ব্রুনাই ওপেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গলফে বাংলাদেশের প্রথম ট্রফি হলেও দিলি্ল জয় করে সিদ্দিকুরের নাম আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে। এর পেছনে বড় কারণ ছিল বিশ্বকাপ। বৃহস্পতিবার থেকে মেলবোর্নে শুরু হচ্ছে চার দিনব্যাপী গলফের বিশ্বকাপ। গলফ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কেউ থাকবে ভুলেও কেউ কল্পনা করেননি।
আর সেটাও পূরণ হতে যাচ্ছে সিদ্দিকুরের মাধ্যমে। কাঁপানো গলফারদের সঙ্গী হচ্ছেন সিদ্দিকুর। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক খেলাতেই বাংলাদেশ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে বা নিচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কেউ আলোচনার প্রয়োজন মনে করেননি। কারণ লাভ কি, জানেই তো কি ফল ঘটবে।
কিন্তু বিশ্বকাপের আগে দিলি্ল জয় করে সিদ্দিকুর আশা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা ঠিক বিশ্বকাপে তার শীর্ষ দশে থাকা আশা করা যায় না। কিন্তু দিলি্ল জয় করে সিদ্দিকুর তো আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপের। যে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলবে তা কেউ ভাবতে পারেনি, সেখানে প্রথমবারের মতো অংশ নিতে গিয়ে সিদ্দিকুর যে দেশবাসীকে অপেক্ষায় রাখছেন সেটাই বা কম কিসের।
দেখুন এক সিদ্দিকুরই বাংলাদেশকে জাগিয়ে তুলেছেন।
অথচ সরকারি উদ্যোগে এ খেলার তেমন পরিচর্যা নেই। বাংলাদেশে যেটুকু গলফ খেলা হয়ে থাকে, তা মূলত সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধানেই। চট্টগ্রামে নৌ ও বিমান বাহিনীর একটি করে গলফ কোর্স আছে। তাছাড়া সেনাবাহিনী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, বগুড়া, রংপুর, ঘাটাইল ও সাভারসহ প্রায় ১২/১৩টি গলফ কোর্স রয়েছে। ঢাকা সেনানিবাসে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশনও পরিচালিত হয়।
দাবা, হা-ডু-ডু, কারাতে, হকি, ফুটবলসহ অন্যান্য ফেডারেশনের মতো গলফ ফেডারেশনও সরকার যথা ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও অলিম্পিক সংস্থার কাছে অন্তত একাধিক ভালো কোর্স ও আলাদা অফিসের দাবিদার হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে গলফে আরও সিদ্দিকুর দেখা যাবে কিনা? বিস্ময় হলেও সত্য যে, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রায় চার/পাঁচ হাজার গলফ খেলোয়াড় আছেন। তাদের মাঝে অনেক মহিলা গলফারও আছেন। আমাদের প্রতিটি ক্লাবই প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। পাশাপাশি প্রতিবছর একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়।
ব্যাংক-বীমা কোম্পানিসহ বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসব প্রতিযোগিতা আয়োজনে সহযোগিতা করে থাকে। সাধারণত সাভার, চট্টগ্রাম, কুর্মিটোলা ও আর্মি গলফ ক্লাবে প্রতিবছর ১০ থেকে ২০টি করে বড় আকারের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যথাযথভাবে উপস্থাপনের অভাবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল/মে পর্যন্ত দেশব্যাপী গলফ খেলার এই বিশাল কর্মযজ্ঞ মানুষের অগোচরে থেকে যায়। পাশাপাশি আমাদের অ্যামেচার গলফারদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং বিশেষ করে সার্ক দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তাদের ফলাফল খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। আমাদের প্রতিযোগীরা নিয়মিতভাবে নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছেন ।
ঢাকা সেনানিবাসের পাশর্্ববর্তী দামালকোট ও ভাষানটেকের বস্তির ঘরগুলোতে (যেখানে আমাদের কেডি-বলবয়রা বসবাস করে) এ ধরনের অনেক আন্তর্জাতিক ট্রফি শোভা পাচ্ছে। বাংলাদেশের জামাল, দুলাল ও জাকির ঢাকায় অনুষ্ঠিত গত সাউথ এশিয়ান গেমসের গলফের সব ক'টি পদকই জিতে নিয়েছিল। ক্রিকেট ছাড়া সম্প্রতি আর কোনো খেলায় গলফের মতো সাফল্য আমাদের নেই। তারপরেও গলফের ওপর আমরা তেমন কোনো সংবাদ দেখতে পাই না।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় ব্যাপক জনগোষ্ঠী গলফ খেলবে তা হয়তো সম্ভব নয়।
তবে গলফ একটি একক (ব্যক্তিগত) খেলা। দু'চারজন সিদ্দিকুরই যথেষ্ট যারা গলফের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে গৌরবের সঙ্গে উপস্থাপন করতে পারেন। অ্যামেচার গলফের বিস্তৃতির পাশাপাশি সিদ্দিকুরের মতো প্রতিভাধর কিছু পেশাদার গলফার তৈরি করা ষোল কোটি মানুষের দেশের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব। সে লক্ষ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আলোকে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া কোর্সগুলো চালু এবং প্রয়োজনীয় স্থানে বিশেষ করে কঙ্বাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সব পর্যটন কেন্দ্রের কাছে কিছু নতুন কোর্স তৈরি করতে হবে।
সাভার ও বগুড়াসহ বিকেএসপির সব প্রতিষ্ঠানেও গলফ শাখা চালু করা প্রয়োজন। এই সামান্য কাজটুকু করতে পারলে অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের দেশের গলফ দেশ ও বিদেশে একটা টেকসই সম্মানজনক অবস্থানে পেঁৗছে যাবে। এ জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। গলফ ফেডারেশনের পাশাপাশি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, অলিম্পিক এসোসিয়েশন, চা বোর্ড, পর্যটন কর্পোরেশন, বসুন্ধরার মতো বড় বড় কর্পোরেট হাউসকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : গলফ খেলোয়াড়
e-mail: quamrul_gm@yahoo.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।