আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহিনের ঘোড়াগুলি ও মানবিক প্রেরণাঃ এত মানুষ রয়েছে পৃথিবীর তবু দানবের কেন জয়

দুই পায়ে হাঁটি আর চার চোখে স্বপ্ন দেখি। মানুষের জন্য ভালবাসা, মানুষের জন্য! উৎসর্গ – গৌতম চ্যাটার্জি ও আজম খান (দুই বাংলার দুই পথিকৃত,গানের নতন যুগের, যারা কেউ আজ এই পৃথিবীতে নেই) একটি দৃশ্যঃ কয়েকমাস আগে ধানমন্ডি ৩২ এর দিকে যাচ্ছিলাম। আমি আর আমার বন্ধু জয়। গুনগুন করতে করতে আমরা হাঁটছিলাম দুপুরের রোদে। রাস্তায় অনেক জ্যাম্‌।

হঠাৎ দেখলাম একটা রিক্সা একটু সামনে এগিয়ে যাবার চেস্টা করছে, আর ওমনি উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বড় (হয়তো অনেক দামীও!) গাড়ি থেকে, অনেক সুন্দর পোশাক পরিহিত এক লোক চিৎকার করতে করতে নেমে এলেন- “ইউ সান অফ অ্যা বীচ্‌, ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা…..” গালাগালি করতে করতেই লোকটা রিক্সাতে লাথি হাঁকলো। রিকশাওয়ালা তো থ!! তার কোনই দোষ ছিলনা। রিক্সায় বসে ছিল একটা ৯/১০ বছরের মেয়ে ও তার মা (অনুমান করে বললাম)। রিক্সাটা কেঁপে উঠলো। বাচ্চাটা প্রচন্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেল।

আমরা মোটামোটি দূর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম, আর রাস্তায় জ্যাম্‌ ছিল। ওদিকে যেতে যেতেই ঘটনা শেষ। দামী গাড়ি-চড়া -তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত-টাকা ওয়ালা লোকটির সাথে আর দেখা হল না। লোকটি তার গাড়িতে চড়ে জানালার কালো কাঁচ উঠিয়ে দিল। ছোট্ট মেয়েটি মুখে স্পষ্ট ভয় আর ঘৃনা দেখতে পেলাম।

লজ্জার আর রিকশাচালক ভাইটির মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। আমাদের বুকে ভর করলো তীব্র অপরাধবোধ আর লজ্জা বোধ। অনেক মানুষ (!!) তাকিয়ে দৃশ্যটি দেখছিল। কেই কিছু বলেনি! অনেকেই মজা পাচ্ছিল, হাসছিল (কেউ কেউ হয়তো তীব্র কষ্টও পাচ্ছিল)। আমারা যেতে যেতেই অই লোক নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।

এর বছর খানেক আগে আমরা এরকম একটি ঘটনার কাছাকাছি ছিলাম বিধায় তীব্র প্রতিবাদ করতে পেরেছিলাম। এবারের ঘটনাটা অনেক অনেক কষ্ট দিল। রিক্সা চালক আর ওই শিশুর কথা মনে হলে আজও তীব্র কষ্ট হয়। মনে হয় “এতো মানুষ রয়েছে পৃথিবীর, তবু দানবের কেন জয়?” এবার আসি মূল প্রসংগে। আপনারা অনেকেই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গান শুনেছেন।

অনেকেরই প্রিয় গানের দল মহীনের ঘোড়াগুলি। আমারও। মহিনের ঘোড়াগুলি যে অল্প কয়েকটা গান করেছিল, সবগুলিই ছিল ভিন্ন স্বাদের, সুরে কথায়, শিল্পে। বাংলার বাঊল গান থেকে শুরু করে প্রাশ্চাত্য, কোন ধারা নিয়েই তারা এক্সপেরিমেন্ট করতে বাদ রাখেনি। তাদের নিজস্ব একটা স্টাইল গড়ে উঠেছিল।

আপনারা জানেন যে, ব্যান্ডটির নাম নেয়া হয়েছে জীবনানন্দের একটি কবিতার (ঘোড়া) লাইন থেকে। জীবনানন্দের মতোই এই ব্যান্ড জীবদ্দশায় নাম করেনি (ব্যান্ডটি এখন বিলুপ্ত, কিন্তু গানগুলি অমর!, আপনারা সবাই মহিনের ঘোড়া গুলি সম্পর্কে জানেন, তাই নতুন করে বলছিনা)। মহীনের ঘোড়াগুলির প্রায় গানই মানুষের, মানবিকতার। এবার কয়েকটি গান নিয়ে কথা বলব যেগুলোতে মানুষের কথা উঠে এসেছে স্পষ্টভাবে। সময় সময়, কোন সময়? হায় সময় সময় গুনছিলাম।

পথে, কোন পথে? ঐ পথে কোথাও চলছিলাম হল সময় গুনার কাজ শেষ বাকি রইলো কেন পথ? শব্দ, কোন শব্দ? ঐ শব্দ শব্দ শুনছিলাম। দৃশ্য, কোন দৃশ্য? ঐ দৃশ্য দৃশ্য দেখছিলাম। কেন কঠিন ছবির সংকেতে তীর বিদ্ধ হল প্রান? দানব, কোন দানব? ঐ দানব দানব চিনছিলাম। গানে, কোন গানে? আহা গানে মানুষ ভাবছিলাম। এতো মানুষ রয়েছে পৃথিবীর তবু দানবকে কেন ভয়? এতো মানুষ রয়েছে পৃথিবীর তবু দানবের কেন জয়? এতো মানুষ রয়েছে পৃথিবীর তবু দানবকে কেন ভয়? এতো মানুষ রয়েছে পৃথিবীর তবু দানবের কেন জয়? এতো মানুষ রয়েছে পৃথিবীর... এই গানটার কথা কি আমার বর্ণিত ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় না? কে জানে “হয়তো এই রকম একটি কঠিন ছবির সংকেতেই তাদের প্রাণ তীরবিদ্ধ হয়েছিল!” গানটি শোনা থাকলে, সবকিছু বুঝেছেন।

শধুমাত্র অ্যাকুয়েস্টিক গীটার বাজিয়ে তারা রেখে গেছে অসাধারন একটি গান!! আরেকটি গান, আপনাদের সবারই হয়তো শোনা। ভালবাসি জোছনায় কাশবনে ছুটতে ছায়াঘেরা মেঠোপথে ভালবাসি হাঁটতে দূর পাহাড়ের গায়ে গোধূলির আলো মেখে কাছে ডাকে ধানখেত সবুজ দিগন্তে। তবুও কিছুই যেন ভাল যে লাগেনা কেন উদাসী পথের মাঝে মন পরে থাকে যেন কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও। ভালবাসি ডিঙি নৌকায় চড়ে ভাসতে প্রজাপতি বুনোহাঁস ভাললাগে দেখতে জান্‌লার কোনে বসে উদাসী বিকেল দেখে ভালবাসি একমনে কবিতা পড়তে। তবুও কিছুই যেন ভাল যে লাগেনা কেন উদাসী পথের মাঝে মন পরে থাকে যেন কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও।

যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে শুধু ফসল ফলায় ঘাম ঝরায় মাঠে প্রান্তরে। তখন ভালো লাগেনা, ভালো লাগেনা কোন কিছুই। সেদিন * কাছে এসো ভালোবাসি একসাথে সবকিছুই। *দ্বিতীয় বার রেকর্ডিং এর সময় শব্দটা “সুদিন”। এই গানটার আরো কিছু অংশ আছে, এখানে দিলাম না।

অতি মানবিক এই গান, আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেই ২০০৩ সাল থেকে। খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভেবে করা তাদের গানটি আজও অসম্ভব প্রিয় একটি গান, গান প্রেমীদের কাছে। ফুলের দলেরা কোথায় এই গানটি, আমার মতে, পতিতাদের নিয়ে লেখা সবথেকে চমৎকার শিল্প। পতিতাদের নিয়ে এতো চমৎকার ভাবে খুব কম “শিল্প”-ই কথা বলেছে। “পাপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল ” এই লাইনটার মাধ্যমে যে তাদের কতটা চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে!! পতিতাদের ফুল বলে, মানুষ হিসেবে তাদের যে সম্মান, তা একটুও ক্ষুন্ন করেনি মহীনের ঘোড়াগুলি।

গানটিতে একবারও পতিতা বা বেশ্যা শব্দ উচ্চারিত হয়নি। আসলে সমাজ যেভাবে পতিতার অসম্মান করে, তার বিরুদ্ধে এটা ছিল মহীনের ঘোড়াগুলির একটি প্রতিবাদ। পতিতারা মানুষ, আপনার আমার মতোই মানুষ, তারা “ফুলের দল”। যাক এতো বিশ্লেষনে যাবোনা। গানটির কিছু অংশঃ রাবেয়া কি রোকশানা ঠিকতো মনে পরেনা আস্থির এ ভাবনা শুধু করে আনাগোনা ফেলে আসা দিন তার মিছে মনে হয়।

নামে কি বা আসে যায়? সোহাগে আদরে জানি রেখেছিল কেউ এই নাম। আব্বা না আপা নাকি কারো মনে পরে তাকি! তোমরা তা জানো নাকি? সময় দিয়েছে ফাঁকি। অভিমানে সে মেয়েটি গেছে হারিয়ে, বুকে ভরসা নিয়ে, সীমান্ত পেরিয়ে সে এসেছিল ছেড়ে তার গ্রাম। জানি সে কোথায়, এই শহরের কোন বাগানে সে হয়ে আছে ফুল। প্রতি সন্ধ্যায়, পাপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল।

...... লক্ষী রোকশানারা আরো যত ঘর ছাড়া ত্রস্ত দিশেহারা তখনি যাদুকরেরা নিমেষে বানিয়ে দেয় বাগানের ফুল, ঠিক নির্ভুল। এভাবে মেয়েরা সব একে একে ফুল হয়ে যায়। নতুন বাগানে এসে নিজেকে না ভালবেসে ফুলের দলেরা শেষে কথা বলে হেসে হেসে….. …… পোড়ার মুখীরা তোরা ফুল হয়ে রয়ে গেলি হায়!! এই গানে মানুষের জন্য মহীনের ঘোড়াগুলির ভালবাসা যে কোন শিল্পকে হার মানিয়ে দেয়। এই গান শিল্পোত্তীর্ন। আরেকটি গান দিয়ে আজকের পোস্ট শেষ করব।

গানটি অসাধারন। আসলে গানের লিরিক নিয়ে কাটাকুটি করার কিছু নেই। আপনারা শোনা মাত্রই বুঝে গিয়েছেন/যাবেন গানটি কতোটা সময়োপযোগী। এই মূহুর্তে এই মূহুর্তে, মৃত মানুষের ভীড়ে বাসভূমি অস্থির, এই মূহুর্তে কাঁটাতার পেরিয়ে, প্রহরা এড়িয়ে, এই মূহুর্তে দলে দলে হেটে যায় বিদেশের সীমানায় এই মূহুর্তে নতুন ঠিকানা চাই যেখানে সবার ঠাঁই এই মূহুর্তে এই মূহুর্তে কোন অলিখিত শর্তে, গোপনে গোপনে চলে লেনদেন বিকিকিনি যতো মারনাস্ত্র এই মূহুর্তে কোন ভাঙ্গাদেশ জুড়তে, দুঃখী মানুষের শোকে কন্‌সার্টে গান গায় কতো মায়’স্ত্র। পারিনা পারিনা কেন বুঝতে একি প্রপঞ্চ মায়া।

এই বিশ্বরূপ দেখে, চুপ করে থাকি যদি, আমি নেহা’তি বেহায়া। এই মূহুর্তে তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে মন্বন্তর বাড়ে এই মূহুর্তে ক্ষরা আর বন্যা শিশুদের কান্না এই মূহুর্তে………………. (বাকিটুকু আর দিলাম না!) এছাড়াও এদের অনেক গানে উঠে এসেছে মানুষের কথা, মানবিকতার কথা। সেগুলি নিয়ে পড়ে কোন একসময় কথা হবে আপনাদের সাথে। গানগুলি অনেক আগের হলেও, সবসময়ের। প্রতিদিন মানুষের প্রতি অবিচার হচ্ছে, শিশু, নারী নির্যাতিত হচ্ছে, অনেক মানুষ চুপ করে না থেকে তাদের অবস্থান থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন, মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন মানুষের বিপদে।

মহিনের ঘোড়াগুলি এরকম একটা দল, যারা হয়তো ভাবেনি, তাদের গান মানুষ শুনবে কিনা? পছন্দ করবে কি না! অনেক বছর ধরে চলে আসা “নির্দিষ্ট” ধারার বাইরে তাদের গানগুলি কিভাবে নিবে মানুষ? ভাবেনি বলেই তারা নিজেদের মতো করে কাজ করে যেতে পেরেছে। হয়ে গেছে ইতিহাস, হয়ে আছে বাংলা গানের জগতে উজ্জ্বল নাম। আমাদের দেশের মহান শিল্পি পপ সম্রাট, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খান যেমন গানের নতুন ধারা শুরু করেছিলেন, তেমনি মহিনের ঘোড়া গুলিও কলকাতায়। সত্যি বলতে কি, শুধু যে একটি গীটার দিয়ে গান করা যায়, তা এই উপমহাদেশের মানুষকে দেখিয়ে গেছেন গৌতম চ্যাটার্জি। আর তারপরের সব ঘটনাতো আপনাদের জানাই আছে।

মহিনের ঘোড়াগুলি সুরের দল। শব্দের দল, ভালবাসার দল, প্রেরনার দল, মানুষের দল। মহিনের ঘোড়াগুলির সকল সদস্যদের প্রতি রইল আমার শ্রদ্ধা ও অন্তহীন ভালবাসা। # আপনাদের কারো যদি উল্লেখিত গানগুলি প্রয়োজন হয় তাহলে আপনার ইমেইল আড্রেস জানাবেন, পাঠিয়ে দেব (কপিরাইট ওয়ায়ালারা খেয়ে ফেললেও ফেলতে পারে)। নাহলে কোন ভালো গানের দোকানে পেয়ে যাবেন (বেশির ভাগই পাইরেটেড!)।

আবার মহিনের ঘোড়াগুলি নিয়ে কথা হবে। অন্য কোন দিন। ভালো থাকবেন সবাই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।