দীর্ঘ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও রাজধানীর পশ্চিম যাত্রাবাড়ির আহমদিয়া রেস্ট্রুরেন্টের বয় মো. হাসানের (১২) মৃত্যু-রহস্যের জট খোলেনি এখনও। ২০০৯ সালের ২১শে অক্টোবর সন্ধ্যায় হাসানের হাত ফসকে গ্লাস ভেঙ্গে যাওয়ায় রেস্ট্রুরেন্ট মালিক ও তাঁর লোকজনের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয় শিশু হাসান। গুরুতর আহত অবস্থায় অন্ধকার ঘরে দুইদিন মৃত্যু যন্ত্রণায় ভুগে ২৩শে অক্টোবর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় তার। অতঃপর অজ্ঞাত লাশের পরিচয়ে নিহত হাসানের জায়গা হয় আন্জুমান মফিদুল ইসলামে। শুরু থেকেই হাসানের মৃত্যুকে হত্যাকান্ড বলে দাবি করে আসছিল স্থানীয় লোকজন, হোটেলের অন্যান্য কর্মচারী এবং রেস্ট্রুরেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের বিভিন্ন সংঘঠন।
আলোচিত এই ঘটনায় থানা পুলিশ মামলা না নেওয়ায় বিক্ষোভে ফেটে পরেছিল তারা। অতঃপর একটি মানবাধিকার সংস্থার হস্তক্ষেপে বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। কিন্তু দীর্ঘ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও হাসানের মৃত্যু-রহস্যের কুলকিনারা করতে পারেনি সিআইডি।
এদিকে, ৭জানুয়ারি সোমবার সকালে দীর্ঘ সময়েও মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় সিআইডির ওই তদন্ত কর্মকর্তাকে আগামী ২০ ফেব্রুয়ারী শ্বশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
হোটেল বয় হাসানের মৃত্যুরহস্যের সুষ্ঠ সুরাহা না হওয়ায় আক্ষেপের সুরে গতকাল আদালত চত্বরে কথাগুলো বলছিলেন মামলাটির বাদী হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশনের মহা-সচিব মো. আলমগীর।
ঘটনার বর্ণনায় তিনি আরো জানান, ২০০৯ সালের ২১শে অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায় পশ্চিম যাত্রাবাড়ির ১২৩ নং আহমদিয়া রেষ্ট্রুরেন্টে হোটেলবয় হাসানের হাত ফসকে গ্লাস ভেঙ্গে যায়। এই সময় হোটেল মালিক মন্টু ঘোষ গ্লাস ভেঙ্গে ফেলার অপরাধে তাকে বেধম মারধর করেন। শিশু হাসান তখন কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে না বলে তার পাওনা চাওয়ায় হোটেলেই ফেলে তাকে নির্মমভাবে মারধর এবং অমানুষিক নির্যাতন করেন রেষ্ট্রুরেন্ট মালিক মন্টু ঘোষ, মালিকের ছেলে জনী ঘোষ ও ম্যানেজার নয়ন চন্দ্র ঘোষ। নির্যাতনে হাসান গুরুতর জখম হয়ে অচেতন হয়ে পড়ে।
এই খবর পেয়ে আশে পাশের অন্যান্য হোটেল ও দোকানের কর্মচারীরা তাকে শোচনীয় অবস্থায় দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিতে গেলে বাধ সাধেন নির্যাতকরা। এমনকি তারা এই খবর গোপন করেন হাসানের বাবা-মার কাছেও।
এদিকে বিনা চিকিৎসায় হোটেলের অন্ধকার ঘরে প্রায় বন্ধী অবস্থায় হাসানের আরো অবনতি হলে মানবিকতার খাতিরে ২৩শে অক্টোবর ওই হোটেলের দুই কর্মচারী মো. মনসুর ও মো. ওমর ফারুক তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসানের জখম এতই গুরুতর ছিল যে ওই দিনই মৃত্যু হয় তার। অভিযুক্তরা সুকৌশলে হাসানের ঠিকানা ও বাবা-মার পরিচয় গোপন করায় তার লাশটি হস্তান্তর করা হয় আন্জুমান মফিদুল ইসলামে।
অতঃপর আন্জুমান মফিদুল ইসলামের তক্তাবধানে হাসানের মৃতদেহ অজ্ঞাত লাশের পরিচয়ে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।
নির্যাতনের পর বিনা চিকিৎসায় হাসানের মৃত্যুর খবরে সেসময় এলাকার হোটেল দোকান কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হাসানের রহস্যজনক মৃত্যুর বিচারের দাবিতে ওই এলাকায় মিছিল মিটিংয়ের এক পর্যায়ে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মনিরুজ্জামান তখন অভিযুক্ত ওই ৩জনকে (হোটেল মালিক, তার ছেলে ও হোটেল ম্যানেজার) গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করে ছেড়ে দেন তিনি ।
মো. আলমগীর জানতে পেরেছিলেন তখন সাড়ে ৬ লাখ টাকার রফা দফায় অভিযুক্তদের ছেড়ে দিয়েছিল যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশ।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও আসামিদের ছেড়ে দেয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয় জনতা। অন্দোলনে মাঠে নামে রেষ্ট্রুরেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজন। রেষ্ট্রুরেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বহুবার যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করতে গেলেও তখন মামলা গ্রহণ করেনি এমনকি জিডিও নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল থানা পুলিশ। এদিকে থানা কর্তৃপক্ষ হাসানের মৃত্যুর এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো হয়রানি করতে থাকে বিচার প্রত্যাশীদের।
স্থানীয় জনতা ও রেষ্ট্রুরেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজন থানা পুলিশের সহায়তা না পেয়ে হাসান হত্যার বিচারের দাবিতে বাধ্য হয়ে তারা ২৪শে অক্টোবর মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশনের দারস্ত হন।
সংস্থাটির মহা-সচিব মো. আলমগীরসহ অন্যান্য মানবাধিকার কর্মকর্তারা যাচাই বাছাই করে ঘটনাটি হত্যাকান্ড বলে সুনিদিষ্ট আলামত পান তখন।
বিষয়টি সরকারীভাবে তদন্তের জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে ২৯শে অক্টোবর বিজ্ঞ সিএমএম আদালত ঢাকায় মামলা দায়ের করেন (পিটিশন মকদ্দমা নং- ২০৪৭/২০০৯) উক্ত মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন। মহামান্য আদালত হাসানের মৃত্যুরহস্যের ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের নির্দেশ দেন সিআইডিকে।
মো. আলমগীর সংশয় প্রকাশ করে জানান, সিআইডির কাছে আদালত একাধিকবার মামলার ফলাফল সমন্ধে প্রতিবেদন চাইলেও অজ্ঞাত কারণে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেননি সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা। এরই পরিপেক্ষিতে গতকাল ৭ জানুয়ারি সোমবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে চিফ ঢাকা মেট্রো পলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (কোর্ট-১২) বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহরিয়ার খান আগামী ২০ ফেব্র“য়ারী মামলার অগ্রগতি সর্ম্পক্যে অবহিত করতে স্বশরীরে আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ প্রদান করেন সিআইডিকে।
তিনি জানান, দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে আমাদের কাছে কোন সহযোগীতাই চায়নি সিআইডি। এমনকি আমরা জানতেও পারলাম না কে এই আলোচিত মামলাটি তদন্ত করছেন। তাছাড়া অভিযুক্ত হোটেল কতৃপক্ষের কাছে বারবার নিহত হাসানের ঠিকানা কিংবা বাবা-মার পরিচয় জানতে চাইলেও এই বিষয়ে করা হয়নি তাদের কোন সহযোগীতা। ফলে কর্মজীবি শিশু হাসানের মৃত্যুরহস্য শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে পায় কিনা এই নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করেন।
মামলাটির বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামালউদ্দিন জানান, দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কেন এখনো মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়নি, এই বিষয়ে মহামান্য আদালত আগামী ২০ ফেব্রুয়ারী স্বশরীরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য আদেশ প্রদান করেছেন।
এই আলোচিত মামলার সুষ্ঠ প্রতিবেদন প্রত্যাশা করেন তিনি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।