আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনযুদ্ধে দগ্ধ মানুষেরা

‘আম্মা কাইন্দেন না’—বেলা তিনটার দিকে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিলেন রবিন মাতবর।
বাসে পেট্রলবোমা হামলায় ছেলে রবিনের পুড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে গতকাল শুক্রবার ভোরে মাদারীপুরের শিবচর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আসেন মা আকলিমা বেগম। ছেলের সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে চিকিৎসকেরা তাঁকে বাইরে নিয়ে যান।
আকলিমা বেগম জানতে চান, ‘আমার পোলার কী হইছে?’ কিছু হয়নি—বলে স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে যান অন্য কক্ষে। কিছুক্ষণ পর খবর আসে, রবিন আর নেই।

আকলিমা বেগম চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন।
পোশাকশ্রমিক রবিন মাতবর (২২) ছিলেন বিহঙ্গ পরিবহনের সেই বাসটিতে, যেই বাসের ১৯ যাত্রীকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রলবোমা মেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে রবিনের ফুফাতো ভাই নাহিদ মোড়ল বৃহস্পতিবার রাতেই মারা গেছেন।
আহতদের একজন বৃহস্পতিবার রাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। চিকিৎসাধীন ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জনেরই মাথা, মুখ, গলাসহ শরীরের ওপরের অংশ পুড়ে গেছে।

এদের মধ্যে চারজন নারী। এদের সবার জীবন রক্ষার যুদ্ধ চলছে বার্ন ইউনিটে।
রবিনের স্ত্রী মাবিয়া আক্তার পাঁচ মাসের সন্তানসম্ভবা। স্ত্রীকে দেখতে মাদারীপুর গিয়েছিলেন রবিন। বৃহস্পতিবার ছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের ৭১ ঘণ্টা অবরোধের শেষ দিন।

বাড়ি থেকে নাহিদসহ ঢাকা হয়ে সাভারে কর্মক্ষেত্রে ফিরছিলেন রবিন। পথে এ বীভৎসতার শিকার হন তাঁরা।
রবিনের শ্বশুর নান্দু ঢালি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘এক আগুন কয়ডা পরিবাররে জ্বালাইব?’
গত ২৬ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত আগুন, পেট্রলবোমা ও ককটেল বিস্ফোরণে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। শুধু যানবাহনে দেওয়া আগুন ও পেট্রলবোমা হামলায় পুড়েছেন অন্তত ৫৫ জন। মারা গেছেন আটজন।


শাহবাগের হামলায় দগ্ধ ১৬ জন এখন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। দুজন ছাড়া সবারই শ্বাসনালি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খুবই শঙ্কার বিষয়। সব মিলিয়ে বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক সহিংসতায় দগ্ধ ৩১ জন এখন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এঁদের সবাই বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও যাত্রী।


রবিনের স্বজনদের আহাজারি-কান্নায় বার্ন ইউনিটে হূদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কান্নার শব্দ আর রবিনের মৃত্যুর খবর পৌঁছে যায় পাশের পোস্টঅপারেটিভ ওয়ার্ডে। আতঙ্ক বাড়ে সেখানে চিকিৎসারত দগ্ধ মানুষগুলোর মধ্যে। কাঁদতে শুরু করেন তাঁদের স্বজনেরাও। দগ্ধ লোকগুলোর কেউ কেউ চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করছিলেন, যদিও বেশির ভাগই চোখ খুলতে পারেন না।

তাঁদের কেউ কাঁপছিলেন, কেউ গোঙাচ্ছিলেন।
গতকাল দুপুরে বার্ন ইউনিটের চারতলায় ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুদ্দুস শরীফ আর রাজিয়া খানম। তাঁরা অগ্নিদগ্ধ ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের বাবা-মা। সাবেক সরকারি কর্মকর্তা কুদ্দুসের কোলে শফিকুলের দেড় বছরের ছেলে সাফওয়ান মাহির। মা রাজিয়া খানম মুখে আঁচলচাপা দিয়ে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘ডাক্তার তো বলে ছেলে ভালো।

আমার তো মন কেমন করে। আমার শুকনা ছেলেটার শরীর ফুলে গেছে। আমার নাতিটা (শফিকুলের ছেলে) এখন বাবাকে চিনতে পারছে না। প্রতিদিন অফিস থেকে ছেলে ফিরলে নাতি বাবা বাবা বলে কোলে উঠত। ’ কাঁদতে থাকেন তিনি।


শ্বাসনালিসহ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে চেহারা ফুলে উঠেছে বাসচালক ৪২ বছরের মাহাবুবেরও। তাঁর ছেলে শাহীন বাবাকে এ অবস্থায় দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। জ্বর চলে আসে শিশুটির গায়ে।

চালক মাহাবুবের ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাপের কথা শুনছে থিকাই শাহীনে কিছু খায় না। বাপেরে দেইখা এহন কোনো কথা কয় না, জ্বর চইলা আইছে গায়।

মাহাবুবের স্বজনেরা জানান, গাইবান্ধার নদীভাঙনের শিকার তাঁদের পরিবার। ২৫ বছর আগে যমুনা নদীর ভাঙনে তাঁরা জমি-ঘর সব হারিয়ে রাস্তায় ঘর বানিয়ে থাকা শুরু করেন। এরপর কাজের খোঁজে সব ভাই একে একে ঢাকায় চলে আসেন। মাহাবুবও ঢাকায় এসে প্রথমে বাসে হেলপারের কাজ ও পরে চালক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী শাহনাজ একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।

একটি সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল তাঁদের পরিবার। এ ঘটনার কয়েক দিন আগে তাঁর বাসের কাচ ভেঙেছিল হরতালকারীরা। মাঝেমধ্যেই ঘোরের মধ্যে কথা বলছেন তিনি।

মাহাবুবের সঙ্গে তিন মাস ধরে একই বাসে কাজ করছিলেন সহকারী হাফিজুল। হাসপাতালের চারতলার বিছানায়ও এ দুজনের স্থান হয়েছে  পাশাপাশি।

অন্যদের তুলনায় হাফিজুলের ক্ষতি কম হয়েছে।
জানতে চাইলে হফিজুল বলেন, ‘আমি ভাড়া কাটতাছিলাম। ওস্তাদে গাড়ি চালাইতাছে। হঠাৎ কইরা সামনে থিকা আগুন। ওস্তাদে হাফিজ কইরা ডাক পাড়ল শুনলাম।

গাড়ি ছিল চাইর নম্বর গিয়ারে। অনেক মানুষ। যে যেভাবে পারছে নামছে। আমি জানলা দিয়া লাফ দিছি। ’
আগুন কোন দিক থেকে আসছে জানতে চাইলে হাফিজুল বলেন, ‘কীভাবে বলব! খালি একটা শব্দ হইছে।

’ হাফিজুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশ থেকে ঘোরের মধ্যেই তাঁকে ধমকে দিলেন চালক মাহাবুব। বলে উঠলেন, ‘এই ব্যাটা হাফিজুলটা একটা বদমাইশ। তুই ভালো হবি না। কালকে থাকি বলতাছি বোমা মারছে সামনে দিয়া, গিলাস ভাইঙা আগুন ভিতরে ঢুকছে। আর ওই ব্যাটা বলে কিছু জানে না।

’ স্বজনেরা ধমকে থামিয়ে দিলেন মাহাবুবকে।
হাফিজুল বলেন, ‘দুই নেত্রী একবার মিট করলেই এইয়া হয় না। আমরা গরিবেরা আগুনে পুড়ি না। ’
মো. শামীমের শ্বাসনালিসহ শরীরের ১৫ ভাগ পুড়ে গেছে। মুখ-হাত-বুকে ব্যান্ডেজ।

যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। চোখ বন্ধ। পাশে থাকা তাঁর ভাই মো. ইকবাল বললেন, কেরানীগঞ্জের গুদারাঘাটে প্যান্টের শোরুমে চাকরি করেন তিনি। কেরানীগঞ্জেই থাকেন। ছোট ভাই মো. ইমরানের নতুন দোকান দেখতে ওই বাসে করে মিরপুর যাচ্ছিলেন তিনি।

মাত্র চার মাস আগেই বিয়ে হয়েছে রুপালি ব্যাংকের কর্মকর্তা মাসুমা আক্তারের। তাঁর শরীরের ১৭ ভাগ পুড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।

ঢাকায় কখনো আসা হয়নি কৃষক রফিকুল ইসলামের। গত বৃহস্পতিবার পাবনার গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেই দেখতে হলো বড় ছেলে মো. রাহাজুলের দগ্ধ-বীভৎস মুখ।

শরীরের ২৫ ভাগ পুড়ে গেছে তাঁর। রাহাজুল পান্থপথে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নিজেই লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছিলেন।

বেডে শুয়ে সংসারের কথা বলতে বলতে বিলাপ করে চলেছেন আবদুর রাজ্জাক। শরীরের ১৫ ভাগ পুড়ে গেছে।

পাশে স্ত্রী ইয়াসমিন বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছেই চলেছেন চোখের পানি।

আবদুর রাজ্জাক বলেন, তাঁর চার মেয়ে কলেজ ও স্কুলে পড়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার গাড়ি চালিয়ে যা উপার্জন করেন, তা দিয়েই চলে সংসার। পরিবার নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। ইস্কাটনে গ্যারেজে থাকা গাড়ি বের করতে যাচ্ছিলেন তিনি।

কাঁচামাল ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেনের শরীরের ২৬ ভাগ পুড়ে গেছে। কাঁচামাল বিক্রির টাকা তুলে সদরঘাট থেকে কারওয়ান বাজার যাচ্ছিলেন তিনি।

ব্যস্ততার কারণে মাকে দেখা হয়ে ওঠে না পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের স্যানিটারি ব্যবসায়ী আবু তালহার। একটু ফুরসত পাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার বাসে চড়ে মিরপুরে মাকে দেখতে যাচ্ছিলেন তিনি। শরীরের ৩০ ভাগ পুড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় এখন তিনি কাতরাচ্ছেন বার্ন ইউনিটে।

পাশে আতঙ্কিত স্ত্রী নূরজাহান বেগম কাঁদতে কাঁদতে টিস্যু দিয়ে স্বামীর রক্ত-পুঁজ মুছে দিচ্ছিলেন।

অবরোধের কারণে ব্যক্তিগত গাড়ি বের করেননি ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী খোদেজা নাসরিন আক্তার। আদালত থেকে বাসে করেই পরিবাগের বাসায় ফিরছিলেন তিনি। শরীরের ২১ ভাগ পুড়ে গেছে তাঁর।

পুলিশের এএসআই ৫৫ বছরের নুরুন্নবীর মাথার খুলিও ফেটে গেছে।

তাঁরও শ্বাসনালিসহ শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

এ দগ্ধ ব্যক্তিদের কেউই শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা। স্বজনেরা চিকিৎসকদের কাছে অবস্থা জানতে চাচ্ছেন বারবার। চিকিৎসকেরা তাঁদের আশ্বাস দিয়ে চলেছেন।

বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল বলেন, ‘আগুনে পোড়া রোগীদের বিষয়ে কিছু বলা কঠিন।

শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তাদের অবস্থা কখন যে খারাপ হয় বলা যায় না। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হচ্ছে না এখানে। ’

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।