২০০৫ অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে লর্ডসে টেস্ট ক্যাপ পেয়েছিলেন কেভিন পিটারসেন। সেই পিটারসেন শততম টেস্ট খেলতে নামলেন এবারের অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে। সোয়া আট বছরেই টেস্ট খেলার সেঞ্চুরি! পিটারসেনের সপ্তাহ তিনেক পরই টেস্ট অভিষেক শাহরিয়ার নাফীসের। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সব টেস্টও যদি খেলতেন, তাঁর সঞ্চয় হতো মাত্র ৪৩ টেস্টের অভিজ্ঞতা! ভুলে যাবেন না, ইংল্যান্ডের সব টেস্টেই কিন্তু খেলেননি পিটারসেন। তাঁর ১০০ টেস্ট খেলার এই সময়ে ইংল্যান্ড খেলেছে ১০৭ টেস্ট।
নিকট অতীত থেকে এবার একটু সামনে তাকানো যাক। বাংলাদেশের বর্তমান দলে সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলা মুশফিকুর রহিম যদি ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সব টেস্টই খেলেন, তার পরও নামের পাশে থাকবে ৭৬ টেস্ট। কিংবা ধরা যাক, অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টেই অভিষেক হয়ে গেল ইংল্যান্ড স্কোয়াডে থাকা গ্যারি ব্যালান্সের। আর বাংলাদেশের পরের টেস্টেই অভিষেক হচ্ছে কারও। ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দুজন যদি নিজেদের দেশের সব টেস্ট খেলেন, ব্যালান্সের ৮২ টেস্ট খেলা হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের পক্ষে অভিষিক্তের এর অর্ধেকেরও কম (৪০ টেস্ট)।
২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে বিবেচনায় নেওয়া আইসিসির চলতি এফটিপির (ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম) মেয়াদ ওই পর্যন্তই বলে। ইংল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশ কম টেস্ট খেলার সুযোগ পাবে যৌক্তিক কারণেই। তাই বলে এত কম! কিন্তু ব্যবধান যদি হয় দ্বিগুণ-তিন গুণ, প্রশ্ন ওঠে তখনই। সবচেয়ে বেশি খেলার সুযোগ পায় বলেই এখানে ইংল্যান্ডের কথা আলাদা বলা।
নইলে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায়ই এফটিপিতে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে বৈষম্যের শিকার। প্রশ্নগুলো অবশ্য নতুন নয়। চলতি এফটিপির মেয়াদ শুরু ২০১০ সালের মে মাস থেকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে প্রশ্নগুলো নানা সময়ে উঠেছে। কিন্তু পারফরম্যান্সের গ্রাফ যখন ঊর্ধ্বমুখী, কিছুদিন ধরে সেই প্রশ্নগুলোই রূপ নিয়েছে হাহাকারে।
কে না জানে, যত বেশি খেলা তত দ্রুত উন্নতির সম্ভাবনা!
চলতি এফটিপির সীমানা ছাড়িয়ে যদি বাংলাদেশের পুরো টেস্ট অধ্যায়ে নজর দেওয়া হয়, ১৩ বছরে বাংলাদেশ খেলেছে ৮১ টেস্ট। এই সময়ে ইংল্যান্ড খেলেছে ১৬৮ টেস্ট, অস্ট্রেলিয়া ১৫৪, ভারত ১৪১। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা নিউজিল্যান্ডও টেস্ট খেলেছে ১০৫টি। এই সময়ে বাংলাদেশের মোট টেস্টের চেয়ে একাই বেশি খেলেছেন ২৬ জন ক্রিকেটার! সবার ওপরে এখানে রিকি পন্টিং (১৩৪ টেস্ট)। সমস্যা হচ্ছে, পারফরম্যান্স যতই ভালো হোক, টেস্ট বেশি খেলতে না পারার এই হাহাকার অন্তত ২০২০ সাল পর্যন্ত চলতেই থাকবে।
এফটিপিতে যে সামনেও বাংলাদেশের টেস্ট সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় রীতিমতো অপমানজনক!
এফটিপি সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ এখানেই। বড় দলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা ও ছোট দলগুলোর সঙ্গে বৈষম্য এড়াতেই ১০ বছর মেয়াদি এই মহাপরিকল্পনা। অথচ ভূত তো সরষের মধ্যেই! বৈষম্য করা হয়েছে এফটিপিতেই। এই এফটিপি প্রণয়নের সময় বাংলাদেশকে কম ম্যাচ দেওয়ায় একটা অলিখিত কারণ ছিল, টেস্ট আঙিনায় প্রথম ১০ বছরে বাংলাদেশের বাজে পারফরম্যান্স। অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টো।
শিশু জন্মের পর থেকে হাঁটতে শেখা পর্যন্তই সবচেয়ে অসহায় থাকে। এ সময়টাতেই সহায়তা প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেলে হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। অথচ ঠিকভাবে হাঁটতে না পারার অপরাধে বাংলাদেশকে ছেড়ে দেওয়া হলো আরও বন্ধুর পথে। প্রথম ১০ বছরে বাংলাদেশ খেলেছে ৬৬ টেস্ট।
এত দিনে হাওয়া-বাতাস বোঝার পর সামনে এগিয়ে যেতে যখন প্রয়োজন আরও বেশি টেস্ট, পরের ১০ বছরের এফটিপিতে বরাদ্দ ৫৫ টেস্ট! টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার যুগপূর্তির বছরে (২০১২) বাংলাদেশ খেলতে পেরেছে মাত্র দুটি টেস্ট, ভাবা যায়! প্রথম ১০ বছরে ভারত ডাকেনি বাংলাদেশকে, ভারত সফর নেই এই এফটিপিতেও। ২০১০ সালের মে মাসের পর ১০ বছরে আর সফর নেই ইংল্যান্ডেও। অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা সফর মাত্র একটি করে। সেটাও হয় কি না সন্দেহ। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, শীর্ষ দেশগুলো চাইলেই সফর পেছানোর নাম করে কার্যত বাতিল করে দিতে পারে।
টিভি সম্প্রচার, বাণিজ্যিক চাহিদা আর মুনাফাকে সব সময়ই গুরুত্ব দেওয়া হয় সূচিতে। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায়ও নেই। কিন্তু ম্যাচ কম-বেশির একটা ভদ্রস্থ মাত্রা তো থাকতে হবে! আইসিসি ও ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো শীর্ষ দেশগুলোর দায়টা চলে আসছে এখানেই। সব ছাপিয়ে ব্যবসাই বড় হয়ে উঠলে ছোট দলগুলো ওপরে ওঠার সিঁড়ি পাবে কোথায়! ক্রিকেট কূটনীতিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট-কর্তাদের ব্যর্থতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এতে। আনুষ্ঠানিক সভায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার মতো ব্যক্তিত্বের জোর তো তাঁদের নেই-ই, নেই অন্য দেশের বোর্ড-কর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ক্ষমতাও।
তবে দিন শেষে দায়টা সবচেয়ে বেশি তো আইসিসি তথা শীর্ষ দেশগুলোরই। এফটিপির মাধ্যমে যেন বৈষম্যটাকেই স্রেফ বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আইসিসির ওয়েবসাইটে এফটিপিকে বলা হয়েছে ‘পূর্ণ সদস্যদেশগুলোর একে অন্যের মাটিতে খেলা নিশ্চিত করার পরিকল্পিত কাঠামো। ’ এই সংজ্ঞাকে উপহাস করছে এই লেখার সঙ্গে ছাপা হওয়া তালিকাটি!
এফটিপিতে টেস্ট সংখ্যা
(মে ২০১০-এপ্রিল ২০২০)
হয়েছে বাকি মোট
ইংল্যান্ড ৪৪ ৮২ ১২৬
অস্ট্রেলিয়া ৩৯ ৭৭ ১১৬
ভারত ৩৭ ৭১ ১০৮
পাকিস্তান ৩১ ৬১ ৯২
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩০ ৫৯ ৮৯
শ্রীলঙ্কা ৩০ ৫৭ ৮৭
দক্ষিণ আফ্রিকা ২৯ ৫৭ ৮৬
নিউজিল্যান্ড ২৭ ৫৬ ৮৩
বাংলাদেশ ১৫ ৪০ ৫৫
জিম্বাবুয়ে ১০ ২৬ ৩৬
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।