আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পঞ্চোদশ সংশোধনী এবং অগ্নিদগ্ধ রাজনীতি



পঞ্চোদশ সংশোধনী দিয়ে বাংলাদেশের গনতন্ত্র আরেকবার স্বৈরতন্ত্রের মোড়কে উন্মোচিত হয়েছে। এখন গনতন্ত্রের মূলভাবনার সাথে সংবিধান নিজেই সাংঘর্ষিক। এই সংশোধনীর পরে বাংলাদেশকে আর গনতান্ত্রিক বলা যায় কিনা সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। সাথে সাথেই রাষ্ট্রের চরিত্রের দিক থেকে বাংলাদেশ কোন কালে গনতান্ত্রিক ছিল সেটা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। তা না হলে এখনকার বিবাদমান রাজনৈতিক গোষ্ঠির পক্ষালম্বন ছাড়া অন্য কোন মৌলিক আলোচনা আমরা করতে পারব না।

কোন দলের কি করতে হবে এই ধরনের আলোচনা দিয়ে সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারব না। কারন এদেরকে বলেই যদি আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান হত তাহলে সংবিধানের ১৫টা ধোলাই করার দরকারও পড়তো না। সর্বশেষ পঞ্চোদশ সংশোধনীই আমাদের কাছে ক্ষমতাসীন শ্রেনীর চরিত্র উন্মোচন করেছে। বিবাদমান রাজনৈতিক গোষ্ঠির ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সংবিধান প্রবর্তনের ইচ্ছা ছাড়া জনগনের দিক থেকে একটি গনতান্ত্রিক সংবিধান প্রনয়ন করা লক্ষ্য এদের কারো নেই। শুধু তাই না, অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে গনতন্ত্রের নুন্যতম প্র্যাক্টিক্যাল চর্চার কোন সু্যোগ নেই।

প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী প্রধানের যে সাংবিধানিক পদ আছে আমাদের সংবিধানে তার ক্ষমতা কাঠামোর দিকে চোখ স্থির করলেই সেটা সহজেই অনুমেয়। সাংবিধানিক এই একটি পদের কাছে শুধু অন্যকোন পদ নয়, পদবিহীন অন্যসকলেও তার অধীনস্ত হয়ে যান। নির্বাহী প্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর এই সর্বব্যাপী ক্ষমতা পৃথিবীর আর অন্যকোন দেশের একই পদের আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে যে সকল দেশ নিজেদের গনতান্ত্রিক শুধু দাবীই করে না, কার্যত গনতান্ত্রিক দেশ তারা প্রধানমন্ত্রীর পদকে এতটা স্বৈরতান্ত্রিক করেন নি। যেমন ধরুন বৃটেনের পার্লামেন্টে যখন কোন বিলের ব্যাপারে ভোটের আয়োজন করা হয়, তখন যারা বিলের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকেন তারা যে শুধু একই দলের হন তা নয়।

লেবার পার্টির বিলের ব্যাপারে রক্ষনশীল দলের মেম্বাররা পক্ষে অবস্থান নিতে পারেন, অন্যদিকে লেবার পার্টির মেম্বাররা নিজ দলের বিলের ব্যাপারে বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের পার্লামেন্টে হ্যা বা না ভোটের চরিত্রটা একটু ভিন্নরকম। মানে আসলে সেখানে মেম্বার অব পার্লামেন্টারিয়ানদের সেই সুযোগ নেই। নিজ দলের আনা বিল যতই অগনতান্ত্রিক হোক না কেন তার বিরোধিতা করলে সংসদীয় সদস্যপদ বাতিল বলে গন্য হবে এবং উপনির্বাচনের মাধ্যমে এমন একজনকে নির্বাচিত করে আনা হবে যারা বিলের ব্যপারে দ্বিমত পোষন করবে না। এটাকে কার্যত স্বৈরতান্ত্রিকতার চর্চাই বলা যায়।

আমরা যাদেরকে নির্বাচিত করছি তারা নিজেরা সংসদের নিয়মানুযায়ী হ্যা ভোটের বাইরে যেতে পারেন না! এখন জানা দরকার এই যে সংসদে বিল আনা হয়, সেটা কিভাবে আবার নির্বাহী প্রধানের করুনার আশ্রয় ছাড়া আলোর মুখ দেখে না। বিল পাশের আগে ও পরে প্রধান নির্বাহীই সত্যিকার অর্থে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি। মন্ত্রী পরিষদ নির্বাহী ক্ষমতার কাছে বিলের কপি শুধু পেশ করার দায়িত্ব ছাড়া অন্যকিছুর ক্ষমতা রাখেন না। বিল বানানোর ক্ষেত্রে নির্বাহী প্রধানের ইচ্ছা অনিচ্ছার বাহিরে কাজ করবার এখতিয়ার সাংবিধানিকভাবে মন্ত্রী পরিষদের নেই। শুধু মন্ত্রী পরিষদই নয় রাষ্ট্রপতির পদকে সাব-অর্ডিনেট করে রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পদের কাছে।

হ্যাঁ এর সাথে হ্যাঁ আর না এর সাথে না মেলানোর বাইরে তারও আর কোন সাংবিধানিক গুরুত্ব নেই। "আহবান" ও "অনুরোধ" এই ধরনের দুর্বল শব্দ ব্যবহার ব্যতীত সংবিধানের মাঝে সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রপতির কার্যত কোন আইনী শক্তি নেই। পঞ্চোদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে ১৫ বারের মত সাব-অর্ডিনেট করে রাখা হল। এছাড়াও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের প্রধান নিয়োগের ব্যাপারে নির্বাহী প্রধানের ইচ্ছারই প্রতিধ্বনি শুনা যায়। এই হল নির্বাহী প্রধান পদের সত্যিকার ক্ষমতার চিত্র।

সাংবিধানিকভাবে তার ইচ্ছার বাইরে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কারো টুশব্দ করবারও কোন অধিকার নেই। তাহলে এখন বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের অবস্থান কোথায়। এই উত্তর যখন আমরা খুঁজতে যাব তখন ১৬ কোটি মানুষের এই জনপদের আওয়াজ ম্রীয়মান হয়ে যাবে ক্ষমতার দুই প্রতিপক্ষের আওয়াজের মাঝে। চিৎকার শোনা যাবে বার্ন ইউনিটে। সেখানেই গন্তব্য ধরে যদি নিতে চাই তাহলে গনতন্ত্র বলে চিৎকার করে কি লাভ।

শোককে ক্ষোভে পরিনত করে বিক্ষোভে ফেটে পড়তে হবে। রাষ্ট্র কাঠামোর অগনতান্ত্রিক চেহারা বহাল রেখে যে কোন নির্বাচনের দাবী আমাদের জনগনের দিক থেকে আত্নঘাতী। সংবিধানের গনতান্ত্রিকীকরন ছাড়া অন্য কোন আওয়াজ তোলার সাথে আমাদের দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আমাদের সমস্যা শুধু নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা নয় বরং প্রতিনিয়ত সংবিধান যে নির্বাহী প্রধানের ক্ষমতাকে লাগামহীন করে রাখে তার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের অগনতান্ত্রিক দিককে বহাল রেখে আজকে যারা গনতন্ত্রের উদ্ধারের কথা বলছেন অথবা যারা সংবিধান বহাল রেখে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন তারা সকলেই জনগনের গনতান্ত্রিক অভিপ্রায়কে আরো বেশী করে দমনপীড়নের মুখোমুখি করতে চান।

তাদের শ্রেনী চরিত্র এক। এই সত্যের ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। বামপন্থা কিছু আর জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি এখানে কার্যত এক। রাজনীতির বিদ্যমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করতে এখন আয়োজন চলছে একটি একতরফা নির্বাচনের। এটা করতে গিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের অগনতান্ত্রিক চরিত্রকে আমাদের সামনে আরো বেশী বেশী করে প্রকাশিত হতে দেখছি আমরা সাধারন জনগন।

এর ফলে বিবাদমান রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মাঝে রাস্তায় রাস্তায় সংঘর্ষের পরিনতি দেখছি আমরা, নিরীহ মানুষও রেহাই পাচ্ছে না সেই সংঘর্ষের দাবানল থেকে। এরা কেউই সংবিধানে ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন চায় না এবং এই ঘটনাগুলো প্রমান করে যে, ক্ষমতাসীন শ্রেনীর আভ্যন্তরিন দ্বন্দ্বকে মিমাংসা করতে খোদ তাদের রচিত সংবিধানই কার্যত অপারগ। এর আগে প্রশাসনে কোন দলীয়করনের যে বিরোধিতাটুকু আমরা দেখতাম এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এখন তা আরো বহাল তবিয়তে রেখে নির্বাচন করতে তারা অবিচল। এর বিরোধিতার প্রয়োজনীয়তা আছে, কিন্তু সাথে সাথে আমাদেরকে বোঝার চেষ্ঠা করতে হবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাহীন দলীয়করন তাদের কার্যকারিতাকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। বিশ্বাসযোগ্যতা তো নেই সাথে সাথে পদলেহনের মানসিকতা লক্ষ্যনীয়।

আমলাতন্ত্রের এই সুবিধাবাদীতাকে প্রতিষ্ঠা করতে সংবিধান কোন কার্যকর বাধা হিসেবে নিজে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। এই সমস্যাগুলো সমাধান করা জন্য যারা আমাদের এখনকার নির্বাচনকে মুক্তিযুদ্ধের সাথে আবার কেউ গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সাথে তুলনা করছেন তাদের চরিত্র এক। তারা রাষ্ট্রের অগনতান্ত্রিক চরিত্রের সুবিধাভোগী। আদর্শের কথা বলে তারা ধোঁকাবাজি করতে চান দেশের গনতন্ত্রকামী জনগনের সাথে। বর্তমান নির্বাচনী সংকটের সাথে না আছে গনতন্ত্র অথবা মুক্তিযুদ্ধের দূরতম সম্পর্ক।

এই দুইটি বিষয় চলমান রাজনীতিতে অনেক আগেই গৌন হয়ে পড়েছে। কিন্তু যারা নিজেদের ব্যাংক ব্যালেন্সের আর অবৈধভাবে সম্পদ আহরনের প্রক্রিয়ার একটি রক্ষা কবচ চান তারা এই মুক্তিযুদ্ধ আর গনতন্ত্রের ফেনা তোলেন। বামপন্থার সুবিধাবাদী কিছু অংশের সংশ্লিষ্ঠতাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। যারা ক্ষমতাসীন বৃহৎ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সাথে জোট বাধাকে রাজনৈতিক কৌশল বলে দাবী করছেন, তাদের অনেকেই কলকাতার গেলো তিরিশ বছরের সিপিত্রম রাজনীতির দ্বারা অনুপ্রানিত। তাই সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তারা লড়াইয়ে অনুৎসাহী হয়েছেন ঠিকই কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় দালালদের সাথে গাট বেধে নির্বাচনে যাওয়াকে খারাপ মনে করেন নাই।

বাক্যের ফুলঝুরি গেধে তারা বোঝাতে চান যে এটা রাজনৈতিক কৌশল। রননীতি আর রনকৌশলের লেনিনের ধারনাকে এরা এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে চান যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা ভারতীয় আধিপত্যবাদ এগুলো আর আমাদের প্রধান সমস্যা নয়। আমাদের সমস্যা জামাত আর বিত্রনপি। কিন্তু খোদ লেনিন যা বলছেন তাতে এদের রাজনীতির ধ্বজা আপনা আপনি খসে পড়ে। (দেখুনঃ লেনিনের উদ্বৃতি Click This Link)।

রনকৌশলে কখনই ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নকে খাট করে দেখা হয় নি। কিন্তু সুবিধাবাদী বামপন্থার ধারার মাঝে শুধু ক্ষমতার সাথে গাট বাধা ছাড়া অন্য কোন বিষয় আমরা পরিলক্ষিত হতে দেখি নাই। অনেক ক্ষেত্রে পার্টির ভেঙ্গে যাওয়াকে তারা মেনে নিয়েছেন কিন্তু মহাজোট ছাড়াকে কর্তব্য হিসেবে দেখেন নি। কৌশল আর নীতির এই তালগোল পাকানোটা কিন্তু সচেতনভাবেই হয়েছে। (প্রথম কিস্তি)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।