এ লেখা যখন তৈরি করে ফেলেছি তখন জানলাম ইতিহাসের কিংবদন্তি, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা আর বেঁচে নেই। ৯৫ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন তার স্বজন, স্বজাতি আর অনুরাগী বিশ্ববাসীকে ছেড়ে। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতার আসনে। এমন বীরের জন্ম প্রতিদিন বা প্রতি মাস অথবা প্রতি বছর বা যুগেও হয় না; হয় হাজার বছরে। দীর্ঘ লড়াকুজীবন ও মহানুভবতা তাকে পরিণত করেছিল জীবন্ত কিংবদন্তিতে।
তার সাহসী ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্বেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বর্ণবাদী শাসনের অবসান হয়েছে। ম্যান্ডেলার নীতির প্রতি অটল থেকে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে বন্দীজীবন কাটিয়েছেন তিনি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম বর্ণবাদমুক্ত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। চরম শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়ে তিনি বিশ্বে স্থাপন করেছিলেন বিরল দৃষ্টান্ত। শত্রুকে তিনি শুধু ক্ষমা করেই দেননি, তাকে করেছিলেন ক্ষমতার অংশীদার।
ক্ষমতার প্রতি কোনো মোহ ছিল না ম্যান্ডেলার। তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি আর দ্বিতীয়বারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এটিও বিশ্বের নেতাদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার দৃষ্টান্তগুলোর অনুসরণে বিশ্বের সমস্যা-সংকুল অনেক দেশেই শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।
ম্যান্ডেলার সংগ্রাম ছিল মূলত মানুষে মানুষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। বর্ণবাদী শাসন ও আইন এক ভয়াবহ বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটির বর্ণবাদী নীতিগুলো ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের দারিদ্র্যের প্রধান কারণ। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তরুণ নেলসন ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলার মহানুভবতা ও বিচক্ষণতার কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকায় শান্তিপূর্ণভাবে অবসান ঘটে বর্ণবাদী শাসনের।
যে শ্বেতাঙ্গরা শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ওপর, তাদের সঙ্গে সমঝোতা বা ঐক্য গড়ে তোলা আর কারও পক্ষেই হয়তো সম্ভব ছিল না। ম্যান্ডেলার সে উদারতা কৃষ্ণাঙ্গরা মেনে নিয়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে নির্যাতিত বর্ণবাদবিরোধী নেতা। নিজেদের মধ্যে হানাহানি একটি দেশকে কীভাবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, পিছিয়ে দেয় নানা ক্ষেত্রে, দক্ষিণ আফ্রিকা তার বড় উদাহরণ। বর্ণবাদের অবসানে সে দেশটি এখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে।
ম্যান্ডেলার জন্য ভালোবাসা।
তাকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়, নির্মল ভালোবাসায়।
দুই
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ফিরে পাওয়ার জন্য শাসক লীগের অকারণে কী দারুণ প্রতীক্ষা! অকারণ বললাম এই কারণে যে, তিনি তো ফিরবেনই। প্রিয় পাঠক, আপনাদের মনে থাকার কথা যে, গত ২৪ নভেম্বর ২০১৩, রবিবার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই 'খোলা জানালা' কলামেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। লেখার শিরোনাম ছিল 'ডিগবাজি খেয়ে এরশাদের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন'। আপনাদের এ-ও মনে থাকার কথা যে, সেই লেখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মিলনের একটা সমীকরণ তুলে ধরেছিলাম।
দুয়ে দুয়ে চার না হয়ে যেমন তিন বা পাঁচ হয় না, তেমনি শেখ হাসিনার ও হু. মু. এরশাদের সম্পর্কের সমীকরণও ওলট-পালট হওয়ার কথা নয়। সমীকরণের মোদ্দাকথা হচ্ছে, দুজনই 'একই পীরের মুরিদ' বা 'একই গুরুর শিষ্য'। 'গুরু' বা 'পীরের' পরামর্শ বা হুকুমের বাইরে নিজস্ব ইচ্ছায় দুজনের কারোই কিছু করার স্বাধীনতা নেই। প্রায় দুই বছরের অধিক সময় এরশাদ ক্ষমতাসীন মহাজোটভুক্ত থেকেও ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন। সবাই এটা ধরে নিয়েছিলেন, ওটা ছিল অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার জ্বালা।
কিন্তু তিনি যখন ঘোষণা করলেন যে, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া তার দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, তখন অনেকেই তাতে বিস্মিত হয়েছিলেন। অনেকে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যখন এরশাদ বললেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি বেহেশতে যেতেও রাজি নন। কিন্তু এই অবস্থানে বেশি দিন তিনি দৃঢ় থাকেননি। সময় মতো ঠিকই পল্টি খেয়েছেন। আগের সিদ্ধান্তে যারা বিস্মিত হয়েছিলেন তারা এবার আর বিস্ময় প্রকাশ করেননি।
বলেছেন, এরশাদের চরিত্রটাই এমন; এটাই এরশাদ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আমি এতে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কিছু দেখি না। আমার মনে হয়, এটা গুরু ও শিষ্যের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও নানা কিসিমের লীগ নেতা আত্দবিশ্বাস নিয়ে বলে আসছিলেন, এটাই এরশাদের শেষ কথা নয়; এরশাদ শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে আসবেন। পরের ঘটনা তো আমরা জানি।
যিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে বেহেশতে যেতেও রাজি নন বলে বলেছিলেন, কিছু সময়ের ব্যবধানেই শেখ হাসিনার সঙ্গে যেন লোটা-কম্বল নিয়ে 'দোজখে' যাওয়ার জন্যও তিনি রওনা দিলেন। গত ৩ ডিসেম্বর তার নতুন নাটকে আমি মোটেও বিস্মিত হইনি। মন্ত্রিসভা থেকে তার দলের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের পদত্যাগের নির্দেশ এবং দলের মনোনীত প্রার্থীদের দশম-সংসদ নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের হুকুম দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত আসন ও অন্যান্য দেনা-পাওনা (মামলা প্রত্যাহারসহ) নিয়ে শেষ বারগেইনিংয়ের সুযোগ নেওয়া ছাড়া ভিন্ন কিছু মনে হয় না। হিসাব-নিকাশ চুকে গেলে 'ঘরের ছেলে আবার ঘরে' ফেরত যাবে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফরকালে যা বলে গেছেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট এবং তাদের সমমনা অন্যান্য বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই যেনতেন প্রকারে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে ফেলার লীগ সিদ্ধান্তের প্রতি ভারতের অনুমোদন আছে।
এই 'লেংড়া-খোঁড়া' নির্বাচনে এরশাদকেও অংশগ্রহণের জন্য বলে গেছেন তিনি। সে নির্দেশ অগ্রাহ্য করার শক্তি ও সাহস কি এরশাদের আছে? মনে হয় না। তা হলে যে সমীকরণে ভুল হয়ে যায়! জাতীয় নির্বাচন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহল এমনকি জাতিসংঘও উদ্বিগ্ন। তারা সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক (সব দলের) নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য বিবদমান পক্ষসমূহের প্রতি বার বার তাগাদা দিচ্ছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো এ উদ্দেশ্যে আবারও ঢাকায় এসেছেন। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য কেউ-ই বলেননি, বলছেন না। বরং তারা বলছেন, সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ নির্বাচন না হলে তা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সীমিত আকারের অবরোধ আরোপ করার আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। অথচ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলে গেছেন উল্টোটা।
তিনি বাংলাদেশের জনগণকে যেন এটাই বলে গেছেন যে, শেখ হাসিনা এবং লীগ সরকার যা করছে তা মেনে নাও। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটা একটা ভয়ঙ্কর বার্তা। সরকার যেভাবে একগুঁয়েমিপনা করছে তাতে দেশে অস্থিরতা আরও বেড়ে যাবে, হানাহানির রাজনীতি আরও ব্যাপকতা পাবে।
এরশাদের বোধদয় হয়েছে, তিনি 'পাপমোচন' করছেন এমন ভাববার কোনো কারণ নেই। নির্বাচনী তফসিল স্থগিত হবে, নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকারব্যবস্থায় লীগ সরকার একমত হবে এবং সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের পছন্দের একটি সরকার গঠিত হবে, দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে_ এই গণআকাঙ্ক্ষা পূরণের সব দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশের এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির জন্য অসুস্থ অপরাজনীতিই দায়ী। এক সময় যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা বলেছেন, এখনো মুখে সেই 'মধুবাণী' উচ্চারণ করলেও গণতন্ত্রের স্বপ্ন বার বার তারাই গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন।
আবারও এরশাদ প্রসঙ্গে আসি। হু. মু. এরশাদের দলীয় মন্ত্রীরা পদত্যাগ না করলে এবং তার মনোনীত প্রার্থীরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 'মুরবি্বদের' সিদ্ধান্ত যদি পরিবর্তন না হয়, লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বা যেমন চাইবেন এরশাদ নিপুণভাবে সে রকম 'অভিনয়-ই' করবেন।
আর এরশাদ যদি জনগণের সন্দেহ অনুযায়ী তার সিদ্ধান্ত পাল্টে আবারও নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তাতে বর্তমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো হেরফের হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, 'আপনি নির্বাচনে না এলে জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় চলে আসবে। ' কোন্ হিসেবে তিনি এটা বললেন বুঝলাম না। সুজাতা সিংয়ের উচ্চারণ কি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার উপকারে এলো না কি ক্ষতি করল? পাঠক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কর্নেল (অব.) ফারুক-রশীদের সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাকশালী শাসনের অবসানের পর একই বছরের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি পাল্টা অভ্যুত্থান হয়েছিল। সেই পাল্টা অভ্যুত্থানে মোশতাক সরকারের পতন হয়েছিল।
৭ নভেম্বর সংঘটিত হয়েছিল সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব। খালেদের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, "মোশতাক আর মেজরদের উৎখাতের খবর শুনে আওয়ামী লীগার, ছাত্র ও মুজিব সমর্থিত দলগুলো রাস্তায় নেমে পড়ে। ৪ নভেম্বর মঙ্গলবার তারা মুজিব দিবস হিসেবে পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শহীদ মিনারসহ ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসভা অনুষ্ঠিত হয়। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মিছিল বের হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে মুজিবের বাসভবনে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।
...তারপর ৭ নভেম্বর শুক্রবার শেখ মুজিবের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শোকসভার আয়োজন করে। এসব কারণে জনগণের মনে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এই অভ্যুত্থানের সূচনা করা হয় বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তখন জনগণ... দুঃস্বপ্ন সবেমাত্র কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। উপরন্তু ফারাক্কা বাঁধের জন্য তাদের মধ্যে ভারতবিরোধী চেতনাও চরমে উঠেছিল। সর্বোপরি তারা যখন আবিষ্কার করল; আওয়ামী লীগের মিছিলে খালেদের মা ও ভাই নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন তারা বুঝে নেয় যে, তার অভ্যুত্থানের পেছনে ভারত আর আওয়ামী লীগ জড়িত_ এতে কোনো সন্দেহ নেই।
....ভারতীয় পত্র-পত্রিকা ও সরকারি রেডিও প্রচারণায় খালেদ মোশাররফের গুণগানে মুখর হয়ে ওঠে। "
তাতেই খালেদের 'গণেশ' উল্টে যায়। ৭ নভেম্বর মানুষকে আবার আনন্দে উদ্বেল করে। ম্যাসকারেনহাস ৭ নভেম্বরের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, 'উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বেসামরিক লোক নিয়ে কতগুলো ট্যাঙ্ক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার ওই ট্যাঙ্ক দেখে লোকজন ভয়ে না পালিয়ে ট্যাঙ্কের সৈনদের সঙ্গে একাত্দ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উল্লাসে ফেটে পড়ে।
চার দিন ধরে (৩, ৪, ৫, ৬ নভেম্বর ১৯৭৫) তারা মনে করেছিল যে, খালেদ মোশাররফকে দিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এতক্ষণে তাদের সে দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। জনতা সৈনিকদের দেশের ত্রাণকর্তা বলে অভিনন্দিত করল। সর্বত্রই জওয়ান ও সাধারণ মানুষ খুশিতে একে-অপরের সঙ্গে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে রাতভর তারা স্লোগান দিতে থাকে_ আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি।
অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণজাগরণের মতো জনমত আবার জেগে উঠেছে। এটি ছিল একটি স্মরণীয় দিন (বাংলা অনুবাদ গ্রন্থের, পৃষ্ঠা- ১৮, ১৯, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ)। অনেকের ধারণা ছিল বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি এ দেশের জনগণের এই সাধারণ মনোভঙ্গি অনুধাবন করেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নির্ণয় করবে। কিন্তু সুজাতা সিংয়ের বক্তব্য যদি ভারতের নীতিগত অবস্থানেরই প্রকাশ হয়, তাহলে এটা বলা বোধহয় অসমীচীন হবে না যে, দুই দেশের স্বার্থেই ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের জনগণের ভারতকেন্দ্রিক মানসগঠনকে সম্মান জানানো, একাত্তরের মতো এ দেশের সব মানুষের ভালোবাসা অর্জনের লক্ষ্যে তাদের কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে 'প্রীতির বন্ধন' অটুট রাখার নীতিতে পরিবর্তন আনা।
অনেকের ধারণা ছিল, যারা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে শঙ্কিত তারা বিএনপিকে জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল নেবে।
কিন্তু সুজাতা সিংয়ের বক্তব্য যদি তার দেশের নীতিগত অবস্থান হয় তাহলে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক তো আরও নিবিড় হবে। অন্যান্য পরস্পরবিরোধী ধর্মান্ধ দল-উপদল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। তাতে উগ্র সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির আরও ভয়ঙ্কর রূপে আত্দপ্রকাশের সম্ভাবনা কি প্রবল হয় না? হু. মু এরশাদ যদি নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে গুরুর মতি-গতিতে নবচিন্তার উন্মেষ ঘটেছে বাস্তবতার নিরিখে। সে ক্ষেত্রে এরশাদের জন্য শাসক লীগের প্রহর গুনে কোনো লাভ নেই। তিনি এলেও যা, না এলেও তা।
দেশের সব গণতন্ত্রমনা মানুষের ও বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রসমূহের বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং সফল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।