জার্মানির গোটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক গবেষক ড. স্টেফানি বক প্রথম আলোকে দেওয়া এক অনলাইন সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে মৃত্যুদণ্ড নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। জার্মানির ন্যুরেমবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত বিচারে দণ্ডিত ব্যক্তিরা রায় প্রদানের পরপরই ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছিলেন। তাঁদের আপিলের সুযোগ ছিল না। ন্যুরেমবার্গে রায় দেওয়া হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর/১ অক্টোবর। আর দণ্ডিতদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ অক্টোবর।
রায় প্রদানের ১৫ দিনের ব্যবধানে ১২ জনের ফাঁসি হয়েছিল।
জার্মানির গোটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনাল ল, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, কম্পারেটিভ ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল-এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাই আমবসের লেখা নতুন বই বের করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। এর প্রকাশকাল ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি। গত ১ অক্টোবর অধ্যাপক আমবসকে লিখেছিলাম, আপনার বই ট্রিটিজ অন ইন্টারন্যাশনাল ল: ভলিউম ১: ফাউন্ডেশনস অ্যান্ড জেনারেল পার্ট’-এ আপনি বলেছেন, বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তার দেশে বলবৎ ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন এবং ১৮৯৬ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) পুরোপুরি প্রয়োগ করেনি। এমনকি আপনি নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের চলমান বিচার প্রসঙ্গে ‘ফেয়ারনেস রেসট্রিকশনস’ বা বিচারের ন্যায্যতা সীমিতকরণ কথাটি ব্যবহার করেছেন।
অনলাইনে তাঁর কাছেই প্রশ্ন পাঠানো হয়। কিন্তু এর উত্তর দেন তাঁর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও সহকারী অধ্যাপক স্টেফানি বক। ড. আমবস সমসাময়িক
বিশ্বে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ভুক্তভোগী দেশগুলোর আইন ও তার প্রয়োগ পর্যালোচনা করেছেন।
কাদের মোল্লার মামলায় ট্রাইব্যুনাল প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পরে আপিলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন করা হয়, এর ফলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কি আন্তর্জাতিক আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন? যদি ঘটে, তাহলে নির্দিষ্ট করে তা বলুন। এর উত্তরে স্টেফানি বক নিশ্চিত করেন, কোনো লঙ্ঘন ঘটেনি।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানির ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বিচারের নীতিগুলো সামনে রেখেই ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সংসদ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করেছিল।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশই কি প্রথম জাতীয় ট্রাইব্যুনাল করল, যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়ে বিচার করা হচ্ছে?
স্টেফানি বক না। তা নয়।
ইরাকি হাই ট্রাইব্যুনাল যা সাদ্দাম হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, তাঁকেও জাতীয় আদালত বলা যায়। উপরন্তু আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের রোম সংবিধির অনেক রাষ্ট্রপক্ষ আন্তর্জাতিক মূল অপরাধসমূহকে তাদের জাতীয় ফৌজদারি আইনে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। জার্মানির দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। এখানে সংশ্লিষ্ট বিধানাবলিকে কোড অব ক্রাইম অ্যাগেইনস্ট ইন্টারন্যাশনাল ল বইয়ে গ্রন্থিত করা হয়েছে। এ মুহূর্তে স্টুটগার্ট ও ফ্রাঙ্কফুর্টের আঞ্চলিক উচ্চ আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধসংক্রান্ত মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
প্রথম আলো কেন একে গোড়াতেই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বলা হচ্ছে? এটা কি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, বা গণহত্যা নয়?
স্টেফানি বক ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ কথাটি সামগ্রিকভাবে প্রযোজ্য, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করে এবং সে কারণে পাবলিক আন্তর্জাতিক আইনে তার সন্নিবেশ ঘটেছে। আন্তর্জাতিক মৌলিক অপরাধগুলো হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আগ্রাসন।
প্রথম আলো বাংলাদেশ সুচিন্তিতভাবে ‘যুদ্ধাপরাধ’ শব্দটি না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ কথাটি ব্যবহার করছে। আপনি কি এর মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন?
স্টেফানি বক মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ কথাটির মধ্যকার তফাত সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসঙ্গের ওপর নির্ভর করে। যুদ্ধাপরাধ কেবল আন্তর্জাতিক/অ-আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ঘটতে পারে।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে হলে দরকার পড়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত কিংবা ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণের অভিযোগ। যুদ্ধাপরাধের মধ্যেও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। আবার কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করাও একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
প্রথম আলো কতজন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছিলেন?
স্টেফানি বক ন্যুরেমবার্গে ২৩ জন আসামির বিচার হয়েছিল। ২১ জনের বিষয়ে রায় হয়েছিল।
১২ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। তাঁদের অভিন্ন পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিংবা শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠন, পরিকল্পনা, উসকানি, আগ্রাসন ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। এটা উল্লেখ করতে হবে যে, ন্যুরেমবার্গে গণহত্যার অপরাধে কারও বিচার হয়নি। ট্রাইব্যুনাল সর্বদাই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে পার্থক্য সৃষ্টি করেনি।
প্রথম আলো ১৯৭৩ সালে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়ন করা হয়, তখন তাতে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান ছিল না। এরপরে সংসদ একটি সংশোধনী [শাহবাগের গণজাগরণের মঞ্চের পরে] এনে আপিলের বিধান করে। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধী ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দায়ী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না। ’ এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
স্টেফানি বক এটা জাতীয় আইনের প্রশ্ন। এর উত্তর জাতীয় আইন বিশেষজ্ঞরা প্রদান করবেন।
একজন ভিন্নদেশির পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ১ দফায় কার্যপ্রণালিগত নিয়মের ভূতাপেক্ষ পরিবর্তনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রথম আলো ড. আমবস তাঁর বইয়ের (ট্রিটিজ অন ইন্টারন্যাশনাল ল: ভলিউম ১: ফাউন্ডেশনস অ্যান্ড জেনারেল পার্ট) ২০১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার আইনের কিছু ক্ষেত্রে ‘বিচারের ন্যায্যতা সীমিতকরণ’ (ফেয়ারনেস রেসট্রিকশনস) উল্লেখ করেছেন। আপনি কি এই মত অনুমোদন করেন?
স্টেফানি বক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তির তাঁর বিরুদ্ধে আনীত কোনো ফৌজদারি অভিযোগ এবং তাঁর অধিকার ও নৈতিক বা আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণে কোনো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালে সম্পূর্ণরূপে ন্যায্যতা এবং প্রকাশ্য শুনানির মাধ্যমে বিচারের অধিকারপ্রাপ্ত।
প্রথম আলো বাংলাদেশ কি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক জুরিসডিকশন থেকে বিচারক আনতে পারতেন?
স্টেফানি বক এটা প্রথমত এবং সর্বতোভাবে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জাতীয় আইনের ওপর। এখানে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের কোনো বিচারককে বাংলাদেশ চাইলেও পেতে পারত না।
কারণ, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে গিয়ে পেশাদারি বিচারকার্য সম্পন্ন করা আইসিসির আইনের ৪০ ধারায় নিষিদ্ধ রয়েছে।
প্রথম আলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে ‘আন্তর্জাতিক মান’ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সত্যিই কি এ রকম কিছু আছে?
স্টেফানি বক এর উত্তরে আমি সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১০ অনুচ্ছেদ বিষয়ে আগে যা বলেছি তা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই। কতিপয় ক্ষেত্রে কার্যপ্রণালিঘটিত ঘাটতি রয়েছে। অপ্রতুল ডিসক্লোজার রুলস, ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে না পারা, একই বিচারক দ্বারা তাঁরই আদেশ রিভিউ করা, আইনজীবীর সঙ্গে আসামিপক্ষের গোপনীয় যোগাযোগের অধিকার নাকচ করা, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনার আগেই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করার মতো বিষয়গুলো ন্যায্য বিচার-প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।