আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাঁসি হল কাদের মোল্লার

অবশেষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের অন্যতম জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার। গত রাত ১০টা ১ মিনিটে জল্লাদ শাহজাহান ভূইয়ার নেতৃত্বে ফাঁসি কার্যকর করেন বলে জানিয়েছে কারা সূত্র।

গতকাল দুপুরে উচ্চ আদালতে আপিল খারিজের পর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিকালে খবর পাঠানো হয় তার পরিবারকে। এর আগে দুপুরে তারা সাক্ষাতের আবেদন করেছিলেন।

এর ভিত্তিতে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে তার স্ত্রী সানোয়ারা জাহান, ছেলে হাসান জামিল, মেয়ে আমানাতুন পারভীনসহ ১০ নিকটাত্দীয় সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা বাসা থেকে ডিমের চপ ও মাছ ভাজা নিয়ে যান। কাদের মোল্লা তার এ পছন্দের খাবার খেতে খেতে কথা বলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। ৭টা ৫ মিনিটে শেষ সাক্ষাৎ সম্পন্ন করে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। ভিআইপি ওই সাক্ষাৎ কক্ষ থেকে পুনরায় কনডেম সেলে ফিরে যান কাদের মোল্লা।

এদিকে, সন্ধ্যা থেকে ফাঁসির মঞ্চ ঘিরে চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলে। লাল কাপড়ে ঘিরে দেওয়া হয় মঞ্চের চারপাশ। নতুন বাতির আলো ছড়িয়েছে চারদিকে। সাবান, মোমবাতি, কর্পূর, আগরবাতি, গোলাপজল, কাফনের কাপড় রাখা আছে সেখানে। মঞ্চের ঠিক পাশেই রাখা হয়েছে একটি কাঠের কফিন।

এ কফিনেই লাশ হস্তান্তর করা হবে স্বজনদের কাছে। রাতেই একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করে কারা অভ্যন্তরে। র্যাব-পুলিশের পাহারায় ওই অ্যাম্বুলেন্সেই লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারাগারের চারদিক ঘিরে অতিরিক্ত র্যাব এবং পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কারারক্ষীরা অবস্থান নিয়েছেন কারাগারের ছাদেও।

বিকাল থেকেই কারাগারের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত রাত সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এমন অবস্থা ছিল কারাগারের বাইরে এবং ভেতরে। কারা সূত্র জানায়, শাহজাহানের নেতৃত্বে ছয় জল্লাদ দুই দিন আগে থেকেই প্রস্তুত। রাত ৯টার দিকে কারাগারে যান জল্লাদ শাহজাহান ও ফারুক। মঞ্চের লিভার (পায়ের নিচের পাটাতন খোলার জন্য লোহর তৈরি হাতল) তারা কয়েক দফা পরীক্ষা করে দেখেন।

এর আগে মঙ্গলবার থেকেই কাদের মোল্লার ওজনের সমান বালুর বস্তা ঝুলিয়ে মহড়া চলে। প্রতিদিনই কয়েক দফা তেল দেওয়া হয় কপিকলে। টানা চার দিন পাকা কলা দিয়ে মালিশ করায় রীতিমতো চিকচিক করছে ফাঁসির রশি 'রোপ ম্যানিলা'। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁসির মঞ্চে জল্লাদের দলে আরও যোগ দেন রাজু, হাফিজ, সানোয়ার ও ফারুক। জল্লাদ শাহজাহান খুনি এরশাদ শিকদার, মুনির এবং দুই জঙ্গি সানী ও মামুনের ফাঁসি কার্যকর করেছিলেন।

রাত সোয়া ৯টার দিকে কারাগারে প্রবেশ করেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইফতেখার আলম, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) এ কে এম শহীদুল হক, ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবদুল মালেক, কারা মসজিদের ইমাম মাওলানা মনির হোসেন। রাত ৯টা ২০ মিনিটে প্রবেশ করেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি উপ-কমিশনার (অর্থ) ইমাম হোসেন। কারা সূত্র নিশ্চিত করেছে, তওবা পড়াতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে কারা মসজিদের ইমামকে। রাত ৮টার দিকে কারা চিকিৎসক শেষবারের মতো সম্পন্ন করেন কাদের মোল্লার স্বাস্থ্য পরীক্ষা। মিরপুরের কসাই বলে খ্যাত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসির রায় কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে বলে নিশ্চিত করেছে কারাগার সূত্র।

কিছুক্ষণ পরই যবনিকাপাত ঘটবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কসাই কাদের খ্যাত জামায়াতের এই নেতার জীবনের অধ্যায়। অন্যদিকে, 'রিভিউ' আবেদন খারিজের আদেশ হাতে পাওয়ার পর গতকাল বিকালে কারা মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মাঈন উদ্দিন খন্দকার জানান, কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রক্রিয়া যেখানে আটকে ছিল, সরকারের সিদ্ধান্ত পেলে সেখান থেকেই আবার শুরু করা হবে। 'রিভিউ' আবেদন খারিজের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ভিড় করেন গণমাধ্যমের কর্মীরা। দুপুর থেকে কারাগার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, মামলার বিচারিক আদালত, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৮ ডিসেম্বর রায় বাস্তবায়নে কাদের মোল্লার 'মৃত্যুপরোয়ানা' জারি করায় নতুন করে আর কোনো পরোয়ানা জারির প্রয়োজন পড়বে না।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ঘোষিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি। টানা দুই দিন শুনানির পর গতকাল রায়ের রিভিই আবেদন খারিজ করেন উচ্চ আদালত। এর আগে ১৯৭১ সালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। ৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা জারি হয়।

১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে রায় কার্যকর করতে সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছিল কারা কর্তৃপক্ষ।

বিচার হলো যেভাবে : বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ২৫ মার্চ যাত্রা শুরু করেন এ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটি ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল স্থানান্তরিত হয় ট্রাইব্যুনাল-২-এ। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয় গত বছরের ২৮ মে।

এর আগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন মোজাফফর আহমেদ খান। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় এতে। মোজাফফরই ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আরও মামলা হয় একটি। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই গ্রেফতার হন তিনি।

ওই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানো হয় তাকে। অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২১ জুলাই। পরের বছর ১ নভেম্বর দাখিল করা হয় তদন্ত প্রতিবেদন। এতে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগি্নসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। প্রসিকিউশনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ২৮ ডিসেম্বর আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।

প্রসিকিউশনের উদ্বোধনী বক্তব্য গ্রহণ করা হয় গত বছরের ২০ জুন। ওই বছরের ৩ জুলাই থেকে শুরু হয়ে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। এরপর তিনিসহ ছয়জনের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় আসামি পক্ষে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ও গত ১৬ জানুয়ারি প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী। তবে স্কাইপ কথোপকথনের জেরে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের পর দুটি ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হলে কাদের মোল্লা মামলার পুনর্বিচারের আবেদন করেন ৩ জানুয়ারি।

ওই আবেদন খারিজ হয়ে শুরু হয় আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক। শেষ হয় ১৭ জানুয়ারি। ওই দিন থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মামলাটি অপেক্ষমাণ ছিল রায়ের জন্য। এদিন রায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর সাজা বাড়াতে সরকার আপিল করে ৩ মার্চ।

খালাস চেয়ে পর দিন আপিল করে আসামি পক্ষ। মোট ৩৯ কার্যদিবস লেগেছে কাদের মোল্লার আপিলের শুনানিতে। প্রথমে সরকার পক্ষ ও পরে অনুষ্ঠিত হয় আসামি পক্ষের করা আপিলের শুনানি। এর মধ্যে ১ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত, ৬ থেকে ২০ জুন এবং ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৫ কার্যদিবসে সরকার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। অন্যদিকে ২৯ এপ্রিল থেকে ৬ জুন এবং ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ কার্যদিবসে আসামি পক্ষে শুনানি করেন কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক।

এ ছাড়া সাতজন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। সরকার পক্ষে শুনানিতে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেওয়া সাক্ষীদের সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়ার বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তার সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা, ট্রাইব্যুনালের রায় পাঠ, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধনী বিষয়ে বক্তব্য এবং জবাব দেওয়া হয় আসামি পক্ষের যুক্তির। অন্যদিকে আসামি পক্ষ নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন এবং সরকার পক্ষের যুক্তির জবাব দেয় কাদের মোল্লাকে খালাস দেওয়ার পক্ষে। এ মামলার আপিল শুনানি শুরু হয় ১ এপ্রিল। পরে একজন বিচারপতি অবসরে চলে যাওয়ায় শুনানি গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ।

আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন ১৭ সেপ্টেম্বর। ৫ ডিসেম্বর বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুপরোয়ানা পাঠান কারাগারে। ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে দণ্ড কার্যকরের কথা জানানো হলেও চেম্বার বিচারপতির আদেশে তা স্থগিত হয় ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। আসামি পক্ষের রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আপিল বিভাগ তা খারিজ করেন ১২ ডিসেম্বর।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.