আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাঁসি, বিদ্রোহ ও মনোনয়নের কতকথা

.......অতঃপর মৃত্যুর প্রতীক্ষা

--আপনি কি জাহিদ হোসেনের ফাঁসি চান? এখানে 'না'/'তবে'/'কিন্তু' বলাটা বিপজ্জনক এবং প্রায়শই প্রাণঘাতী। ব্যক্তিত্বের পুরোপুরি নাশ ঘটাতে চাইলে এর বিকল্প কমই আছে। আত্মরক্ষার জন্য আপনাকে 'হ্যা' বলতেই হবে। কারণ 'চিহ্নিত' বলে একটা শব্দ আছে, যেটা বিচার, শালিস সব কিছুর উর্ধ্বে । 'চিহ্নিত' প্রমাণের জন্য খুব কষ্ট করা লাগেও না।

অথবা জাহিদ হোসেন যদি ঠিক 'চিহ্নিত' না হন, তাহলে ফাঁসির বিকল্প শাস্তি কী হতে পারে সেই ভাবনাটা অনেককেই অপ্রস্তুত করে ফেলবে। সেটারও একটা গ্রহণযোগ্য সরলীকরণ করা যায়। ধরুন জাহিদ হোসেন ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ করেননি অথবা আওয়ামীলীগের সমর্থক ছিলেন না--এটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি চুপচাপ বসে থাকার মত নিরীহ হলে আজকে বাংলার মাটিতে রাজনীতি করার সাহস দেখাতেন না। তার মানে নিশ্চিতভাবে তার একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল।

ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন তার সপক্ষে দলিল দেখানো দুস্কর। ভারতে না গিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করে 'শান্ত' হয়ে বসে থাকাটাও পাক-হানাদার বাহিনীর বর্বরতার পক্ষে যায়। নৈতিক সমর্থন দেয়া, জয় বাংলা শ্লোগানে নাখোশ হওয়া, পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো বিবিধ প্রমাণ সাপেক্ষে 'আইনত' ধরে নেয়া যায় তিনি তার এলাকাতেই হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, চুরি,ডাকাতি, লুটপাট আর যা যা অপরাধ কর্ম ছিল সব কিছুতেই জড়িত ছিলেন। সরাসরি জড়িত না হলেও আগের দিন সেখানে রাজাকার বাহিনীর মাঝে দাড়ানো ছিল, অথবা কাধে একটা পাকিস্তানি রাইফেলও ঝুলছিল। ফলে সন্দেহাতীতভাবে তার বিরুদ্ধে ২০০ টা খুন ও ৯ টা ধর্ষণের ২৩ টি অভিযোগ আনা যায়।

রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার মত পবিত্র কাজ করার মত লোকের অভাব কোনকালে বাংলার মাটিতে হবেনা --এটা অন্তত নিশ্চিত। ১ লক্ষ রাজাকার ও শান্তি কমিটির জীবিত সদস্যের মাঝে বিশেষভাবে জাহিদ হোসেনকে ট্রাইবুনালে তুলে দেবার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে যদি তিনি ঠিক 'চিহ্নিত' না হন। তাহলে কারা তার নাম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মনোনীত করল? হয়ত তারাই যারা আন্তরিকভাবে সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চান, কিন্তু বি এন পি বা অন্যদলের কাছে এ ব্যাপারে কোনভাবেই প্রহণযোগ্য ফয়সালা আশা করতে পারছেন না। কাজেই আওয়ামীলীগের ব্যাপারে তাদের সহজ-সরল ভক্তি/বিশ্বাস/আন্তরিকতা সবই আছে। একটা দলীয় সরকার কর্তৃক মনোনীত 'শীর্ষ' বা 'চিহ্নিত' রাজাকার নিজামী-আজম-সাইদি-মুজাহিদের বাইরে এলাকা ভিত্তিক রাজাকারের সনাক্ত করা এবং দেশবাসীর সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেবার মহান দায়িত্ব কাউকে নিতে হয়।

সেক্ষেত্রে মনোনয়দানকারী ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়, ব্যক্তিগত রেষ বা আদর্শিক সংঘাত থাকতেই পারে--যেটা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে উহ্য থাকে। সেই অর্থে আমরা কিশোরগঞ্জ এলাকার শীর্ষ রাজাকারের নাম জানতে পারছিনা, বা তিনি ঠিক সরকারের আস্থাভাজন কারো চোখে পড়ছেনা না বলেই মনোনয়ন পাচ্ছেনা। ফরিদপুর এলাকার শীর্ষ রাজাকার বাচ্চুকে ধরিয়ে দিন দাবিটা যিনি প্রথম তুলেছিলেন তাকে প্রথমে এন টিভির ধর্ম জলসা দেখতে হয়েছিল। হয় তিনি 'ধর্ম ব্যবসা' বিদ্বেষী অথবা নিজের 'পবিত্র' ধর্ম হঠাৎ এক মুখ-পরিচিত রাজাকারের বয়ানে শুনে বিবমিষা বোধ করেছিলেন। ফলে বাচ্চু রাজাকারকে রাজনৈতিক 'হয়রানি' মূলক অভিযোগের বাইরেই মনোনীত করা সম্ভব হয়েছিল।

একটি দলীয় সরকার বা তাদের পরম আস্থাভাজনদের দ্বারা মনোনীত রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে আপামর জনগণের ভক্তির অন্ত নেই। ধরুন কাদের মোল্লার 'ভি' সাইন দেখানোর ১০ বছর আগেও বি এন পির আমলে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির প্রসঙ্গ তুললে একটা বড় অংশের মাঝে বিভ্রান্তি, বৈষম্য, বৈপরিত্য পেতেন। ১৯৯২ সালের গণ আদালতের ব্যর্থতার পরে খুব কম তরুণই সেটা বুকে ধারণ করতেন, সজ্ঞানে। বিস্ময়করভাবে ১৯৯২ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে গোটা বাংলাদেশ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে উদ্বেলিত ছিল। ইমরান খানের কর্মকান্ডে বেদনাহত অনেকেই তখন না বুঝেই ইমরান বা ওয়াসিম গোঁড়া ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।

ফাঁসি শব্দটির সাথে যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রবল আবেগ জড়িত তরুণদের উপলব্ধিতে তা ছিল প্রায় বিস্মৃত । গণজাগরণ মঞ্চের উদ্ভব হয়েছে সেই শক্ত পোক্ত ইমানদার তরুণদের হাত দিয়েই । ৩ মাস দেশের রাজধানীর প্রধান সড়ক আটকে রেখে সেটাকে একটা প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকারকে যথেষ্ঠ ধৈর্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হযেছে। গণজাগরণ মঞ্চ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে যারা আমজনতাকে মানসিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি দিবে ফাঁসি আদায় বিষয়ে। দিন-রাত শ্লোগান-গানে মুখরিত করে সেই ভুলে যাওয়া দাবি বা চেতনাকে পুনর্জীবন দেয়া হয়েছে --এবং কাকতালীয়ভাবে সরকার তা ভীষণ আন্তরিকভাবেই চেয়েছে।

বি এন পি মতামত দিতে গিয়ে বারবার কোণঠাসা হয়েছে আর জামাত নিজেই সেখানে খলনায়ক। জনমতকে সংঘবদ্ধ করে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবার অসাধারণ দক্ষতা আছে বলেই আওয়ামীলীগ ভক্তের অন্ত নেই। দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও তারা আওয়ামীলীগেই থাকবেন --একটা ধর্মের মত নেশা । এতটাই ধর্মান্ধ যে এক পর্যায়ে নির্বাচন, গণতন্ত্রকে রীতিমত ঘৃণা করতে শুরু করে। কারণটা উপলব্ধি করা যায়।

এখন কেউ শুধু বি এন পি বলেনা, বলে বি এন পি-জামাত। বিশেষ কারণ ও প্রেক্ষাপটে একে অপরের অঙ্গ হয়ে বেঁচে আছে্ দল দুটি। আওয়ামীলীগ যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর শক্তভাবে একতাবদ্ধ, বি এন পির তেমন কোন আদর্শ-চেতনা নেই। ডান-বাম-মৌদুদ মিলে সুবিধাভোগীর দল যারা দৃশ্যত মধ্যপন্থায় বিশ্বাস করে। তাদের আন্দোলনকে আওয়ামীলীগের মত সাথে 'সমানতালে' জঙ্গি করতে হলে জামাতের মত মরীয়া, অন্ধ, আন্তরিক লোকের দরকার পড়ে।

ফলে বিভাজনটা আওয়ামীলীগ-বিএনপি না হয়ে আওয়ামীলীগ-জামাত হয়ে যায়। তাই মাত্র ২% ভোট পেয়েও জামাত আওয়ামীলীগের মাথাব্যথার কারণ--যেই অঙ্গীকার নামা ছিলনা ১৯৯৬ নির্বাচনে, বরং ২০০১ নির্বাচনে পরাজয়ের পর সেই শুভ বোধের উদয় ঘটে। এমনকি নিজামীকে মন্ত্রী করার পরেও গণআন্দোলনে সাহসের সাথে এগিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেছে বা সেই পবিত্র কারণে কেউ বি এন পির রক্ষীবাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছে--শোনা যায়নি। জাহিদ হোসেনের মত 'অজ্ঞাতনামা' রাজাকারদের জন্য ফাঁসির বিকল্প কিছু ভাবাও দেশদ্রোহীতা। সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবেই হোক, সরকার-রাষ্ট্র পক্ষের আড়ানিপনার কারণেই হোক, নিরাপরাধী প্রমাণের কারণেই হোক, বা অভিযোগ দুর্বল প্রমাণের পরেও আদালতের রায় আমরা মানিনা।

কারণ একটা দলীয় সরকার কর্তৃক যুদ্ধাপরাধী হবার তকমা যার কপালে জুটে গেছে--তিনি পাকিপাকিভাবেই যুদ্ধাপরাধী--কোন বিচার-শালিসের আগেই জনগণই তাকে যুদ্ধাপরাধী মনোনীত করে ফেলে বলেই তার ফাঁসি হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকেনা। ব্যাপারটা শত্রুকে ক্রসফায়ারে ফেলার মত। দেশের আইন-সংবিধান-দলিল যা যা লাগে পরিবর্তন করেই ফাঁসি দিতেই হবে। মানুষের জন্যই তো সংবিধান। ব্যাপারটা দাড়ায় একটা দলীয় সরকার ও তার আস্থাভাজনেরা মনোনয়ন করবেন যাকে, তাকেই জনরোষে পড়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।

মনোনয়নে এই বিরাট জনসমর্থন দলীয় সরকারের বিরাট সাফল্য। এমনকি কট্টর আওয়ামী বিদ্বেষী লোকও এই মনোনয়নের পক্ষে জোর সমর্থন দিবেন। এতে সরকার তার শত্রুদের বিদায় করতে পারলো এবং জনগণ তাদের বিচার পেল। সরকার + জনগণের + সংবিধানের এমন অসাধারণ বোঝাপড়ার পরেও কেন মানুষ আবার নির্বাচন চায়? নির্বাচনের নামে বি এন পি-জামাতকে পুনর্বাসিত করার সুযোগ করে দিতে চায় ? যুদ্ধাপরাধীদের বাচাঁতে কেন নির্বাচন ও গণতন্ত্রের নামে অবরোধ, আন্দোলন করে? জাহিদ হোসেন, আলাউদ্দিন খান, মোখলেছুর রহমান এমন কত নাম না জানা এলাকা ভিত্তিক শান্তি কমিটির সদস্য আর রাজাকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশে--টিভি পর্দায়, সংবাদ শিরোনাম, রাজনীতিতে সরকারের সাথে টক্কর দিতে আসলেই কেবল ধরা পড়বে। একটা দলীয় সরকার প্রয়োজন মাফিক তাদের মনোনীত করবেন এবং ফাঁসি উপহার-উপলক্ষ পাবে জনগণ।

পরিশিষ্ট: জাহিদ হোসেন বি এন পির নেতা এবং কুখ্যাত 'খোকন' রাজাকার বলে পরিচিত এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বর্তমানে বিচারাধীন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.